আমাদের দেশে রাজনীতি, ধর্ম, জাতি, ভাষা নিয়ে তৎপরতার শেষ নেই বললেই চলে। রাজনীতির জন্য লড়াই - হিংসা খুব সাধারণ ব্যাপার, আর আমরা এই পরিবেশে নিজেকে এমন ভাবে দাঁড় করে ফেলেছি যে এতো হিংসা-লড়াই-হানাহানি এই সবকে খুব ছোট ঘটনা এবং স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছি। সমাজের কিছু মানুষ এখনো আছে যাদের কাজ এই ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করতে ভয় করে না। তাদের আমরা খুব খারাপ নজরে দেখতে ভালোবাসি। লিখেছেন আজাবুল বিশ্বাস। আজ শেষ কিস্তি।
আমাদের দেশে শিক্ষা বা কোয়ালিটি এডুকেশনের কথা বললেও কোথাও হয়তো কেউ বলে থাকে কিন্তু “কোয়ালিটি টিচিং”? শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতিটা জিনিস একে অপরের সাথে জড়িত তার মানে হলো, আমি যদি শিক্ষা বা আক্ষরিক অর্থে ফর্মাল এডুকেশন যেভাবে পাবো সেই ভাবেই কিন্তু ভবিষ্যতে শিক্ষাকে বা সমাজকে বা দেশকে দেখার চেষ্টা করবো। সাধারণতঃ এই জিনিসটাই লক্ষণীয়। নতুন শিক্ষা নীতি ১৯৮৬/১৯৯২ এবং জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা ২০০৫ যেভাবে তৈরি হয়েছিল সেটা সেই সময় উপযুক্ত একটা গম্ভীর পলিসি ছিল এবং আজকের জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ সেই পলিসির উপর নির্ভর করে একটা নতুন রূপ দেওয়া হয়েছে। যাই হোক, সেই সময়ে একটা সময়পোযোগী শিক্ষা নীতি বানানো হলেও অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাই যে দেশ যে স্বপ্ন নিয়ে চলেছিল সেই স্বপ্ন পূর্ণ হয়নি। কারণ, কোনো এক দার্শনিক বলেছেন যে স্বপ্ন দেখো কিন্তু তারজন্য সমস্ত শক্তি লাগাতে হবে তাহলেই হয়তো স্বপ্ন পূর্ণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা আছে। কিন্তু যদি এই রকম হয় স্বপ্ন দেখবো কিন্তু চেষ্টা করবোনা এবং সেটা পূর্ণও হয়ে যাবে সেটা তো সম্ভব নয়। জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা ২০০৫ হলো সেই একটা স্বপ্ন, স্বপ্ন আমরা দেখেছিলাম কিন্তু যে শক্তির দরকার ছিল সেটা হয়তো আমরা দিতে পারিনি যতটা দেওয়ার দরকার ছিল। “জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা ২০০৫” কাগজ কলমে অদ্বিতীয় একটা খসড়া ছিল কিন্তু সেটা শিক্ষা ব্যবস্থার নিম্ন সিঁড়ি বা হয়তো বলতে পারেন শিক্ষা ব্যবস্থার আসল কারিগরের কাছে ঠিক ভাবে পৌঁছায়নি। আর এর জন্য শিক্ষকরা দায়ী নয়। শিক্ষা ব্যবস্থা আজ “কাগজ কলমে” যেমনটা জাতীয় পাঠক্রমের রূপরেখা ২০০৫ ছিল। শিক্ষা যার জন্য তার কাছে এখনো ঠিক ভাবে বা বলতে পারি কোয়ালিটেটিভলি শিক্ষা এখনো শ্রেণী কক্ষে পৌঁছায়নি। বর্তমানে অনেক সমস্যায় জর্জরিত আমাদের সমাজ, দেশ তার সমাধানে সবাই ব্যস্ত, সবাই আসল পথ খোঁজার পথে বড়ো বড়ো রিসার্চ কিন্তু সমাধান যে ঐ বিদ্যালয়ের শ্রেণী কক্ষে রয়েছে এইদিকে খেয়াল নেই। কোলাইটি এডুকেশন হলো একমাত্র রাস্তা যেটা আমাদের সমাজের সমস্যা দূর করতে পারে। কিন্তু যদি সেই কোয়ালিটি এডুকেশন কাগজ কলমে থেকে যায় তাহলে হয়তো দেশের বা সমাজের এই প্রকার সমস্যা চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে বা হয়তো সমস্যা আমাদের আরো জটিলভাবে জড়িয়ে ধরবে।
জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০, তিন দশক পর একটা ডক্যুমেন্ট যা এই সব সমস্যার মধ্যেই উপস্থিত, একটা স্বপ্ন নিয়ে। সেই স্বপ্নের অবস্থাও সেই রকমই যেটা ১৯৮৬/৯২ সালে ছিল। কারণ, আমাদের নীতিগুলো কাগজ কলমে অদ্বিতীয় হলেও যখন বাস্তবায়ন করার সময় আসে তখনি আমরা তামাশা দেখি। ১৯৬৪ সালে কোঠারি কমিশন শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপারে এবং দেশের স্বপ্ন পূর্ণ করার স্বার্থে আমাদের জিডিপি এর ৬ শতাংশ খরচের কথা বলেন কিন্তু ৬০ বছরের মতো সময় পেরিয়ে গেলেও সেই দিকে আমরা যেতে পারিনি কারণ আমরা কাগজ কলমের উন্নয়ন দেখতে এবং শুনতে ভালোবাসি। সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা ক্ষেত্রে বাজেট কাট একটা স্বাভাবিক ঘটনা বলেই মেনে নিয়েছি। গত তিন বছরের বাজেট দেখলে বোঝা যায় যে আমরা কতটা সক্রিয় আমাদের দেশকে বিশ্বের সামনে সমৃদ্ধশালী বানানোর জন্য। ৩১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনের দ্বারা উপস্থাপিত অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুসারে, জিডিপির শতাংশ হিসাবে শিক্ষার ব্যয় ছিল: ২০১৯-২০: ২.৮%, ২০২০-২১: ৩.১% (সংশোধিত অনুমান অনুযায়ী) ২০২২-২১: ৩.১% (বাজেট অনুমান অনুযায়ী) জিডিপির ৬% মানদণ্ড পূরণ করতে, ২০২২-২৩-এর শিক্ষা বাজেট গত বছরের বরাদ্দের প্রায় দ্বিগুণ হওয়া উচিত ছিল। এই দৃশ্য দেখে নিজেদের স্বপ্ন দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় আমরা হতো কাল্পনিক উন্নয়ন বা কাল্পনিক সাকসেসে অনেকটা বিশ্বাসী। আর এই সব আমাদের জন্য স্বাভাবিক। এই সব দেখে দেখে আমরাও শিখে গেছি যে শ্রেণীকক্ষে আমাদের কি করণীয়? আমাদের কি দেখানো দরকার আর কি নয় ? দেশের বিদ্যালয় গুলোর অবস্থা সেটা নিয়ে না লিখায় ভালো কারণ সেটার ব্যাপারে হয়তো সবাই অবগত। দেশকে সমৃদ্ধশালী করার জন্য যেমন পলিসি দরকার, সেই রকমই আমাদের পলিসিকে বাস্তবায়ন করাও দরকার। পলিসি থেকে শ্রেণীকক্ষে এবং সেই শ্রেণীকক্ষে বাস্তবায়নের জন্য শক্তিশালী শিক্ষক বাহিনীও প্রয়োজন। আর যদি আমরা কাগজ কলমের উন্নয়নে অভ্যস্তই থাকি তাহলে হয়তো শিক্ষার ক্ষেত্রে বাজেট কমিয়ে শূন্য করে দিলেও হয়তো আমাদের স্বাভাবিক মনে হবে। (সমাপ্ত...)
(লেখক সিনিয়র লেকচারার,আজিম প্রেমজি ইউনিভার্সিটি, ব্যাঙ্গালুরু)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct