বৈশাখ মানেই শুধু দোকানে দোকানে হালখাতা নয়, বৈশাখ মানেই কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রকাশ, বৈশাখ মানেই কামিনীর সুবাসে মুখরিত বাংলার বাতাস, বৈশাখ মানেই কাঁঠালের গন্ধ আর মনকে ভরিয়ে দেওয়া আমের ঘ্রাণ, বৈশাখ মানেই কাল বৈশাখীর বিকেল বেলায় আম কুড়ানো ছেলে বেলার স্বপ্ন তাড়া করা। বৈশাখ মানেই মাঠ ভরা বোরো ধানের মেলা, ঢেলার মতো জমিতে তরমুজের লুটোপুটি খাওয়া আর গাঙ শালিকের তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে যাওয়া। লিখেছেন সনাতন পাল।
এসো হে বৈশাখ, এসো এসো।...
তাপস নিঃশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক যাক।...
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,
অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।...’
গানটি রবীন্দ্রনাথ ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ৪টা মার্চ শান্তি নিকেতনে বসে লিখেছিলেন। গানটির রাগ ইমনকল্যাণ, তাল কাহারবা এবং স্বরলিপিকার হলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয়। আজও পয়লা বৈশাখ এলেই এই গানের কথা দোলা দেয় বাঙালির মনে, আপন হরষে জাগিয়ে আমাদের চিত্তকে। পয়লা বৈশাখে আমরা মনের যে ব্যাকুলতা গুছিয়ে প্রকাশ করতে পারি না তারই যেন প্রকাশ কবি গুরুর এই গান। বাংলা নববর্ষকে রবীন্দ্রনাথই প্রথমে এই গানের মাধ্যমে আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে বাংলার নববর্ষকে আপন হরষে বরণ করে নেওয়ার ভাবনা প্রকাশ করেছেন। বাংলা নববর্ষ বরণে বাঙালি আজও আবেগে উচ্ছ্বাসে ভেসে যান। ইংরেজি নববর্ষ আজকাল বরণ করা হয় অনেকটাই সাহেবি কায়দায় কিন্তু পয়লা বৈশাখকে বরণ করা হয় পুরো স্বদেশী আনায়। বৈশাখ মানেই শুধু দোকানে দোকানে হালখাতা নয়, বৈশাখ মানেই কৃষ্ণচূড়ার অপরূপ সৌন্দর্যের প্রকাশ, বৈশাখ মানেই কামিনীর সুবাসে মুখরিত বাংলার বাতাস, বৈশাখ মানেই কাঁঠালের গন্ধ আর মনকে ভরিয়ে দেওয়া আমের ঘ্রাণ, বৈশাখ মানেই কাল বৈশাখীর বিকেল বেলায় আম কুড়ানো ছেলে বেলার স্বপ্ন তাড়া করা। বৈশাখ মানেই ভোরে পুবের হাওয়ায় আর গরমে আকাশ ভর্তি নক্ষত্রের নিচে অনেক রাত ধরে জেগে থেকে শরীরটাকে একটু জিরিয়ে নেওয়া আর মাঠ ভরা বোরো ধানের মেলা, ঢেলার মত জমিতে তরমুজের লুটোপুটি খাওয়া , বাঁশের খুঁটি বেয়ে পটলের গাছ লতিয়ে উঠে মাচার উপর লুটিয়ে পড়া আর গাঙ শালিকের তেষ্টায় গলাটা শুকিয়ে যাওয়া।
পয়লা বৈশাখে ভোজন রসিক বাঙালির একটু কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া আর বাড়ীর বৌ-দের নতুন ছাপা শাড়ি পড়ে নিজ নিজ ইষ্ট দেবতার কাছে জগৎ সংসারের সকলের এবং নিজ পরিবারের সকলের মঙ্গল কামনা করা আর বিগত-দিনের গ্লানি মুছে ফেলে ভবিষ্যতের জন্য মনে মনে নতুন স্বপ্নের ছবি আঁকা এবং আশায় বুধ বাঁধা। বৈশাখকে বাঙালি আজও নববধূ রূপে বরণ করেন। কিন্তু গত দু-বছর ধরে অতিমারীতে বৈশাখে বাঙালি আনায় কিছুটা হলেও খামতি পড়েছে কিন্তু এবারে অতিমারীর খানিকটা নিয়ন্ত্রণে থাকায় গত দু বছরের নির্বাসিত আল্লাদ-কে বাঙালি এবার যেন একটু পুষিয়ে নিতে চাইছেন। সবাই চাইছেন পৃথিবী যেন এবারের অগ্নি স্নান করে শুদ্ধ হয়ে যায় পয়লা বৈশাখের এই পুণ্য লগ্নে। তারুণ্যের জোয়ারে যৌবনের স্নিগ্ধতা আর বার্ধক্যের আড়ষ্টতা সব যেন মিলে মিশে এক হয়ে যায় এই বর্ষ বরণে, যেখানে জীবনের সমস্ত প্রতিকূলতা কে মনের ব্যাকুলা ফুলের গন্ধের মত জড়িয়ে ধরে চঞ্চল হৃদয়কে শান্ত করে দেয়। আগামী দিনের মঙ্গলের স্বপ্ন পুরোনো বছরের দুঃস্বপ্ন কে যেন হার মানিয়ে দেয়। জীবনের ভার বোধ থেকে জন্ম নেয় নতুন দিগন্তে ছোটার আশা। শুষ্ক প্রকৃতিও যেন অপেক্ষা শুরু করে দেয় কবে আসবে আষাঢ়ের বারি ধারা। হাঁটু জল থাকা নদী গুলিও যেন স্বপ্ন দেখতে শুরু আগামী দিনে ভরা যৌবনে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে দু-কূল ছাপিয়ে যাওয়ার। মহানন্দা থেকে আত্রেয়ী, পুনর্ভবা থেকে টাঙন, তোর্সা থেকে জলঢাকা দামোদর থেকে অজয় সবখানেই খেয়া পারাপারের ঘাট কিছুটা যেন এগিয়ে আসে। নদীর জল রাশির প্রস্থ কমে যাওয়াতে ঘাটের মাঝি ভাইদেরও যাত্রী পারাপারে অনেকটা কম বৈঠা চালাতে হয়। জেলেরা ছোটো ছোটো ডিঙি নৌকা নিয়ে কাঠাতে মাছ ধরে। বিল শুকিয়ে যায়, হাঁটু জলে নেমে চলে মাছ ধরা। সাপেরা শীতের পরে গরমে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। আমরা সকলেই চাই যে শুভ নববর্ষের ঝরে যাওয়া বসন্তের পাতার সাথে সাথে যেন সব মলিনতা চলে যায়, সকলের মনে যেন আনন্দের স্পর্শ লাগে। মোরা সকলেই যেন ভাবি “ বৈশাখি মেঘ ঢেকেছে আকাশ, পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায় ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন ? নীল অভিমানে পুড়ে আর কতোটা জীবন? কতোটা জীবন!!” “ দিন চলে যায় ঋতুর খেয়ায়, আসে ও যায় বছর ও মাস কারো কাটে কষ্টে আবার কেউ বা করে সুখেই বাস বদল করে খেলায় রঙিন আলোয় সবুজ পাতায় লাগে দোল বছর ঘুরে বোশেখ আসে একতারা ও বাজে ঢোল।” যত যাইহোক না কেন! দেশি পোষাকে বর্ষ বরণ মাতৃভাষায় নববর্ষের সম্ভাষণ আর চিঁড়ে- মুড়ি দিয়ে দিন শুরু , বাংলা নববর্ষ যেন বাঙালির আবহমানকালের সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসব । বাংলা নববর্ষের বাঙালির পরম্পরা বাঙালির গর্ব এপার বাংলা এবং ওপার বাংলার ঐতিহ্য।
(লেখক শিক্ষক ও বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct