ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপের একটি অংশে হলেও মিশর ও আরব বিশ্বের কিছু দেশে তার বিষ নিঃশ্বাস পড়ছে। দরিদ্র মিশরীয়রা গমের রুটি খেয়েই জীবন ধারণ করেন। মূলত মিশরীয়দের কাছে গমের রুটি প্রিয় খাবার। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, মিশরে বছরে ৯৩ মিলিয়ন রুটি উৎপাদিত হয়। মিশরকে ফি বছর প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন গম আমদানি করতে হয়। প্রায় সবটুকুর উৎস হল রাশিয়া-ইউক্রেন। তাই গম আমদানির ক্ষেত্রে চরম সঙ্কটের মধ্যে পড়তে হবে মিশরকে। কারণ, গম আমদানি করতে না পারলে মিশরের জনগণের জন্য সমূহ বিপদ। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে লিখেছেন বজলুর রশীদ। আজ দ্বিতীয় কিস্তি।
গবেষকরা বলছেন, তেলের দাম ২০০ ডলারে উঠতে পারে! মিশরীয় প্রবাদ আছে, ‘যারা দরিদ্রদের জীবিকাকে টার্গেট করে তারা জিতে না’; রুটি আছে তো পরিবারে শান্তি আছে। ফরাসি বিপ্লব থেকে ১৯৭৭ সালে আনোয়ার সাদাতের বিরুদ্ধে মিশরীয় বিদ্রোহের অন্তরালে কাজ করেছে রুটি। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, আইএমএফের প্রেসক্রিপশন অনুসারে অর্থনীতির ধকল সামলাতে রুটির দাম বাড়ানো হয় ১ শতাংশ। একই সাথে আরো কিছু কৌশলগত পণ্যের দাম বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি মোকাবেলার জন্য এবং মিশরকে সেই ঘাটতি মোকাবেলায় সহায়তা করার জন্য আর্থিক ঋণ দিতে সম্মত হয় আইএমএফ। রুটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত রেডিও স্টেশনগুলোর মাধ্যমে সব মিশরীয়ের কাছে পৌঁছানোর সাথে সাথে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং পুলিশ তাদের মুখোমুখি হতে অক্ষম হয়। সরকার এই মূল্যবৃদ্ধি থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল, তবে তা কিছু সময়ের জন্য, আজকের বিশাল মূল্য বৃদ্ধির সাথে তুলনীয় নয়।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নাগরিকদের ক্লান্ত-অবসন্ন করে দেয়, কেবল দরিদ্রই নয় বরং মধ্যবিত্ত শ্রেণীও ভুক্তভোগী হয়। তবে দ্রুত মিশরে মধ্যবিত্ত শ্রেণী হ্রাস পাচ্ছে; কেননা এই শ্রেণী দরিদ্র শ্রেণীর সাথে যোগ হচ্ছে। বলা হয়, কোনো সমাজে, মধ্যবিত্ত শ্রেণী হচ্ছে সেই দেশের স্তম্ভ যা ভারসাম্য বজায় রাখে। কিন্তু মিশরে বলতে গেলে এখন মাত্র দু’টি শ্রেণী রয়েছে- ধনী, উচ্চ ও পরাক্রমশালী, যারা ১ শতাংশের মতো, অপরটি দরিদ্র শ্রেণী যারা মিশরীয় জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠকে প্রতিনিধিত্ব করে। মূল্যবৃদ্ধি, সেই আদি থেকে অর্থনৈতিক সঙ্কট মিশরের স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়। অর্থ ও আরো অর্থের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, আমিরাত ও সৌদির ওপর ভরসা করে দিন কাটায় মিশর। আল-সিসি মিশরীয়দের অবাক করে দিয়ে ভর্তুকিযুক্ত রুটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ৬৭ মিলিয়ন নাগরিক ভর্তুকি রুটি সরবরাহ থেকে উপকৃত। তাদের এখন মাথায় হাত দেয়ার অবস্থা। মিশরীয়দের জন্য রুটি-সমস্যার চেয়ে বিপজ্জনক আর কিছুই নেই; এটি কেবল সাদাতের দিনগুলোতেই নয়, ২০০৮ সালে হোসনি মুবারকের শাসনামলেও বিক্ষোভ সৃষ্টি করেছিল। রুটি ভর্তুকির সুবিধাভোগীর সংখ্যা সাত কোটি ১০ লাখ মানুষ, যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। রুটি ভর্তুকির মূল্য ২৫০ কোটি ডলার এবং ২০ বিলিয়ন ডলারের সাধারণ বাজেটে মোট সহায়তার ১৬ শতাংশ হলো রুটির ভর্তুকি!
আইএমএফ ঋণের শর্ত বাস্তবায়নে ভর্তুকির চূড়ান্ত বিলুপ্তির জন্য প্রতি বছর এটি হ্রাস করা হয়। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অনেক কৌশলগত পণ্যসহ সব ভর্তুকি হ্রাস করা এক চলমান বিষয়। দরিদ্রদের জন্য এ পদ্ধতি এক অশনি সঙ্কেত। প্রায় ৩০.৩ মিলিয়ন মিশরীয় নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। মহামারী বিস্তারের কারণে, দারিদ্র্যের হার আরো বৃদ্ধিই পেয়েছে। সহায়তার কথা বলা হচ্ছিল। এটি নাগরিকের একটি অন্তর্নিহিত অধিকার, যেমন- শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সহায়তা তহবিল, যা করদাতারা সম্পূর্ণরূপে অর্থায়ন করে, জনগণের পকেট থেকে, সরকারের পকেট থেকে নয়। একটি রুটির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যে ৪৪৬ মিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করতে চায়, তা অর্জনের জন্য সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণের অন্য অনেকগুলো বিকল্প ব্যবস্থা অবলম্বন করতে পারে। মিশরে রুটিই ‘বসবাসের ভার’, খাদ্যই দেশের কোটি কোটি নাগরিকের মর্যাদা রক্ষা করে। ইউক্রেন-যুদ্ধ কয়েক হাজার মাইল দূরে ‘রুটির যুদ্ধ’ ছড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে খাওয়ার টেবিলে যুদ্ধের বোমা পড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায় যখন একটি রুটি ডিনার টেবিলে ভাগাভাগি করে খেতে হয়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct