জ্বালানি নেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়াতে গিয়ে মানুষের মৃত্যুর থেকে শুরু করে স্কুলের পরীক্ষা গ্রহণের জন্য সময়মতো কাগজ না পাওয়া এবং বিদেশে দূতাবাস বন্ধ করে দেওয়া—এই সব ঘটনা শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশাকে তুলে ধরছে। এই সময়ে ডলারের বিপরীতে লঙ্কান রুপির দাম রেকর্ড পরিমাণ কমতে দেখা যাচ্ছে। জ্বালানি সঙ্কটের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার আগামী আরও আশঙ্কাজনক পরিস্থিতি হওয়অর সম্ভাবনা উজ্জল হয়ে উঠছে। এর ফলে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। খোদ প্রেসিডেন্টের বাসভবনের সামনে মানুষ বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এবং সরকারের পদত্যাগের দাবি উঠেছে। এসব নিয়ে লিখেছেন আনসা বিনত-ই-ফায়াজ। আজ শেষ কিস্তি।
শ্রীলঙ্কা সরকার চাপে থাকা অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যেই সার্ক কভিড-১৯ জরুরি তহবিলে পাঁচ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করে। এর পাশাপাশি কভিড ত্রাণের জন্য ১০০ মিলিয়ন রুপির রাষ্ট্রপতি প্যাকেজও ঘোষণা করে। এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনে সামরিক হস্তক্ষেপ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে সুনামির মতো আঘাত হানে। রুশ তেলের ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পর আন্তর্জাতিক বাজারে পেট্রলের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়া শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যায়। কারণ দেশটির আমদানিসামগ্রীর ২০ শতাংশই তেল। দেশটির এই ক্রমাবনতিশীল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির ফলে রাজাপক্ষের সরকারের পদত্যাগ একটি জনপ্রিয় দাবি হিসেবে দেখা দিয়েছে। কারণ দেশটিতে এখন রেকর্ড ১৭.৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতি চলছে। ফলে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি, বিদ্যুৎসহ দৈনন্দিন ব্যবহারের সামগ্রীগুলো ক্রয় করতে পারছে না মানুষ। সরকার জনসাধারণের মধ্যে জ্বালানি বিক্রির নজরদারি ও অস্থিরতা দমন করার জন্য গ্যাসস্টেশনগুলোতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করেছে। এ ছাড়া খাদ্য মজুদ প্রতিরোধ করার জন্য ক্রয় করা সামগ্রীর পরিমাণেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানির অভাবের কারণে সরকার দেশব্যাপী ১৩ ঘণ্টার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখার ঘোষণা বাস্তবায়ন করছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, লঙ্কান বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৪০ শতাংশই জলবিদ্যুৎ; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণটি জলাধারগুলোতে পানির পরিমাণ কমে গেছে। ফলে দেশটির প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ ক্ষমতা আরো কমে যায়। এর ওপর চিকিৎসা যন্ত্রপাতি সরবরাহের অভাবের কারণে একাধিক হাসপাতাল নিয়মিত ডায়াগনস্টিক পরীক্ষা স্থগিত করেছে, কেউ কেউ কেবল জরুরি ব্যবহারের জন্য নির্ধারিত অস্ত্রোপচার স্থগিত করেছে।
এই পরিস্থিতির শুরুর দিকে শ্রীলঙ্কা সরকার আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা চাওয়ার ব্যাপারে অনিচ্ছুক ছিল। এর পরিবর্তে তার প্রত্যাশা ছিল ভারতের কাছ থেকে ১.৫ বিলিয়ন ডলার ক্রেডিট লাইন এবং চীন থেকে সম্ভবত ২.৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিশ্চিত করা। এর মধ্যে চীন কলম্বোর খাদ্য সহায়তার আহ্বানে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে, ২০ মেট্রিক টন চাল সরবরাহ করেছে, পাশাপাশি দেশটিকে আরো অর্থনৈতিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। লঙ্কান সরকার বর্তমান অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলার জন্য ঋণদাতাদের সঙ্গে ঋণ পুন তফসিল করার চেষ্টাও করেছে। এই অবস্থায় বেশির ভাগ আন্তর্জাতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়ার পূর্বাভাস দিয়েছেন। কেউ কেউ এমনকি ধ্বংস হয়ে যাওয়াকে কেবল ক্ষণগণনার বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। সরকার আন্তর্জাতিক সহায়তা ও ঋণ নিয়ে বর্তমান সংকটকে স্বল্প মেয়াদে প্রশমন করতে পারে; কিন্তু দরকার রাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও কল্যাণের জন্য বিবেচনাপ্রসূত পরিকল্পনা ও রাষ্ট্র পরিচালনা। (সমাপ্ত...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct