মাতলা
হাবিবুর রহমান
_________________
মনে হয় এই তো সেদিন।অবিভক্ত গোসাবা থানার ওসি ছিলুম। থানায় সন্ধ্যা ছ টা থেকে দশটা সোলার লাইট জ্বলতো। বাকী সময় আলোবিহীন।থানার নিজস্ব কোনো গাড়ি ছিলনা।থানার দুখানা লঞ্চ, একটা ভুটভুটি নৌকা। অনেকগুলো দ্বীপ নদীনালা জঙ্গলে ঘেরা এলাকা। সদর ক্যানিং। আর আলিপুর ছিল হেড কোয়াটার। সাহেবদের কনফারেন্সে মাসে এক বার যেতে হতো। জোয়ারে মাতলা নদী সাঁতরে লঞ্চ লাগতো ক্যানিং ডগঘাটে। সি আই সাহেবের গাড়িতে যেতুম আলিপুর। সেদিন আর আসা হতো না। পরদিন বাড়ি হয়ে থানায় আস তুম। সেবার কনফারেন্সে এসপি সাহেব হুকুম দিলেন,এখন ধান রোয়ার সিজেন চলছে। রুরাল থানার সব ওসি কনফারেন্স শেষে নিজ নিজ এলাকায় চলে যাবে।রাত নটার পর থানার ফোন থেকে আমাকে। জানাবে। রুরাল থানার ওসিদের মুখ চুন। কিচ্ছু করার নেই, সাহেব খুব কড়া। রাত সাতটা ডকঘাটে এলুম। নদী শুকনো ,ভাটা চলছে। থানার লঞ্চও নেই। ঘাটের পারানিদের ধরলুম, হ্যাঁরে ভাই, কী করা যায়? ঘাটের ইজারাদার বললে, স্যার,এখন কিছু করার।নেই। এক কাজ করুন না স্যার। হেঁটেই নদীটা পর হয়ে যান না। দেখুন,সবাই তো তাই করছে। পাশে একজন বললে,সাহেব, চলুন না আমার সাথে।আমিও গোসাবা যাব ।তবুও ইতস্ততঃ করছিলাম। পারানি অভয় দিলে, স্যার,জোয়ার শুরু হতে রাত দশটা বেজে যাবে। কেনো বসে থাকবেন এই ঘাটে?মনে সাহস সঞ্চার হলো। পরার প্যান্ট সেঁটেসুটে দিলুম রওনা নদীতে।কপাল খারাপ। টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হলো।আর সাথে দমকা হাওয়া। তার সাথে ঘুটঘুটে অন্ধকার। টর্চ লাইট লঞ্চে রয়ে গেছে।ভাগ্য ভাল, সংগের লোকের হাতে ছোট লাইট ছিল। নদীর নীচে নেমেছি। শুরু বৃষ্টির দাপট। সেই সঙ্গে জোয়ারের শুরুয়াত সঙ্গের লোকটি আক্ষেপ করলে,মহামুস্কিল তো। স্যার,এই জোয়ারের জলে মোটেই সাঁতরাতে যাবেন না।তলিয়ে যাবেন। গা ভাসিয়ে আস্তে চলুন, দূরে কোথাও ঠিক পৌঁছে যাবো। তাই সই। জল হাঁটু ছেড়ে গলা। পা আর মাটি পাচ্ছে না। লোকটি তখনও ভরসা দিচ্ছে,কোনো ভয় নেই,ঠিক ওপারে উঠে যবো স্যার। আর স্যার! স্যারের তখন ‘ রাম নাম সত্য হ্যায়।’ জোয়ারের টান,আর মেঘ ভাংগা বর্ষা। আমি আর আমাতে নেই। স্রোত আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। অন্ধকারে লোকটি হাঁকল,খবরদার,একদম সন্ত্রানোর চেষ্টা করবেন না স্যার। তলিয়ে যাবেন।। মনে রাখবেন, নদীটার নাম মাতলা। জোয়ারে এখনো ও মাতাল। এরপর আমার অবস্থান দেখতে সে টর্চ লাইট অন করলো। স্বচক্ষে দেখলাম কিছু দূরে জলে কুমির।ভয়ে চক্ষু চরক গাছ। লোকটা মরণ হাঁক হাঁকল, স্যার,কুমির! একটু ডানদিক চেপে চলুন। আওয়াজ কানে পসিল,কিন্তু পোড়া চোখ দুটো আর খুললো না। ডক ঘাটের মাইল দুই পরে এক ইট ভাটার চরে আমাকে উদ্ধার করা হয়। পরে শুনেছি, ঐ লোকটি আমার খবর আমাদের লঞ্চের লোককে দিলে তারাই আমাকে উদ্ধার করে। থানায় পৌঁছে বড় সাহেবকে ফোনে বললুম, স্যার,ভগবান আজ আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। তারপর ঘটনা শুনে সাহেব আমাকে বকা দিলেন,বকা ছেলে! এতো রিস্ক কেন নিলে? আমি চোখ কান বুজে বললুম, স্যার, আপনার ভয়ে। বড় সাহেব সহাস্যে বললেন,যাও,তোমার তিনদিন ছুটি।আমার তরফ থেকে তোমাকে রিওয়ার্ড।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct