আশার আলো আঁধারে মিলায়
অশোক কুমার হালদার
_______________________
মানুষ এই প্রকৃতির বৈচিত্র্যময় পরিবেশের ভিন্ন ভিন্ন পরিবারে জন্ম হয়। কিন্তু প্রত্যেক মানুষের মনের ভেতর আশার আলো মিটমিট করে জ্বলে। অনেকে মনের ভেতরে জেগে থাকা এই আশার আলো কে বলে স্বপ্নলোক। ইহা অব্যবহারিক বা অস্পষ্ট কল্পনা মাত্র। কৃতকর্মের দ্বারা স্বপ্ন পূরণ হতে পারে বা মনের আঁধারে স্বপ্ন মিলিয়ে যেতে পারে। অজিত দাস ও অসীম দাস দুই ভাই। পুরনো মালদার সাহাপুর গ্রাম মহানন্দা নদীর পাশ্ববর্তী অঞ্চলের এক বর্ধিষ্ণ গ্রাম দাস পরিবারে জন্ম। পরিবারটি খুব বড় না হলেও, মোটামুটি স্বছল পরিবার। পিতা গোপেশ্বর দাস আর মাতা অনিমা দাস। সুনীল সরকারের ঐ গ্রামেই বাড়ি। সুনীল অবস্থাপূর্ণ ঘরের ছেলে। তাই সমাজে এবং পরিবারে বর্তমান কালে ধনশালীদের গুরুত্ব বেশী থাকে। শুধু বর্তমান কালে বললে কথাটির গুরুত্ব সাদরে রক্ষা করা যাবে না। কারণ সর্বকালের এবং সর্ব পরিবেশের উপযুক্ত হন ঐশ্বর্য এবং ধনবান ব্যক্তিগণ। কারণ সুগ্রাহী গুণ বিশিষ্ট ভাব ধারা সমাজ এবং সংসারে সর্বএই গ্রহণ যোগ্য হয়। আর তার সঙ্গে সমাজও সাদরে গ্রহণ করে। আর অজিতের বাবা সামান্য একটা মাস মাইনের চাকুরী দ্বারা সংসার নির্বাহ করেন। তবু অজিত এবং সুনীল এক স্কুলের ছাএ এবং একই পাড়ায় বসবাস। একই পাড়ার এ প্রান্ত আর ঐ প্রান্ত এই যা তফাত। কিন্তু লেখাপড়ার সুবাদে অজিত এবং সুনীল একই ক্লাসের ছাত্র। সামাজিক দিক থেকে সুনীলের জীবন যাত্রার মান অজিতের জীবন যাত্রার মান অপেক্ষা উন্নতর। কিন্তু স্কুলে একটি সার্বিক নিয়ম আছে। যেখানে অর্থনীতির মানদন্ড দ্বারা স্কুলের নিয়ম কানুন এবং আচার আচরণ সমাজে জীবন যাপনের আচরণ থেকে পৃথক থাকে। স্কুলে গরিব বড় লোক বলে পৃথক কোন ব্যবস্থা থাকে না। প্রত্যেক ছাত্রকেই একই নিয়ম কানুন, আচার, আচরণ মানতে হবে এবং স্কুলের নিজস্ব আদেশ এবং আজ্ঞানুসারে প্রত্যেক ছাত্রকেই অনুসরণ করতে হবে। ছাত্রের নিজের ইচ্ছামত পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান যোগ্য নয়। স্কুল দ্বারা র্নিদেশিত পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করতে ছাত্রগণ বাধ্য থাকবে। সময়ের মধ্যে স্কুলে প্রবেশ করতে ছাত্রগণ বাধ্য থাকবে। এবং নিয়ম অনুসারে প্রত্যেক ছাত্রকেই প্রার্থনা সভাই অংশগ্রহণ করার পরে ছাত্রগণ নিজ নিজ পাঠ কক্ষে এবং নিজ নিজ বসার জায়গায় বসতে হবে যতক্ষণ না শিক্ষক মহাশয় পাঠ কক্ষে প্রবেশ না করেন নীরবতা পালন বাঞ্ছনীয়। শিক্ষক মহাশয় পাঠ কক্ষে প্রবেশ করার পর সব ছাত্রগণ নিজ নিজ বসার জায়গা থেকে উঠে দাঁড়াতে হবে। তারপর শিক্ষক মহাশয় আপন আসন গ্রহণ করার পর সকল ছাত্রগণকে আপন আপন জায়গায় বসার অনুমতি দিলে তবেই ছাত্রগণ আপন আসন গ্রহণ করবে। এই নীতিও নিয়ম গরিব এবং বড়লোক সকল ছাত্রের ক্ষেত্রে একই থাকবে। ছাত্র জীবনে ইহাই হচ্ছে নিয়ম অনুবর্তিতা এবং নৈতিক কর্মকারকীয় একটি প্রথম আচরণের বাহিৃক পাঠ দান। এই শিক্ষা দ্বারা সকল ছাত্রকে একই নিয়ম এবং আচরণের এবং আনুগত্য রক্ষার শপথ গ্রহণ করার প্রথম এবং প্রধান শিক্ষা। তারপর রোল কল হওয়ার পরে পাঠ দানের কার্য শুরু করেন শিক্ষক মহাশয়। আর এই সময় থেকেই প্রত্যেক ছাত্রের পৃথক,পৃথক ভবিষ্যতের স্বপ্ন মনের মধ্যে আসতে শুরু করে। ছাত্র জীবনের এই স্বপ্নগুলি যেন বৃক্ষের চারা সম মনের মধ্যে ভবিষ্যতের আশার আলো মনের মধ্যে জ্বালিয়ে দেয়। বনসৃজনে যখন চারা গাছগুলি মাটিতে পোতা হয়। তখন আর চারা গাছগুলি মালিকের অধীন থাকে না। তখন চারা গাছগুলি ভূপ্রকৃতি এবং বায়ুমন্ডলের অধীন হয়ে যায়। প্রকৃতিই কেবল বলতে পারে যে কোন চারা গাছটি প্রকৃতিতে বেঁচে থাকবে আর কোনগুলি অচীরেই বিনাশ হবে বা কোন চারা গাছে পোকা লেগে বেঁচে থাকবে কি থাকবে না বা কোন চারা গাছটি বৃক্ষ সমান আকার ধারণ করে প্রকৃতি পরিবেশকে ছায়া দান করবে না অক্সিজেন দান করবে। এতকালের গর্ভে থেকে গেল। তবে হ্যাঁ পরিচর্যা এবং যত্ন করা অবশ্য কর্তব্য।তদ্রুপ ছাত্র জীবনে প্রত্যেক ছাত্ররাই পৃথক পৃথক আশা ও বিশ্বাস মনের মধ্যে ঠিক যেন মাটিতে চারা পোতার মত অবস্থায় থাকে। কারণ আশা বা স্বপ্ন যেটাই হোক সেটা অস্পষ্ট বা অব্যবহারিক থাকে। কারণ এই স্বপ্ন সার্থক করতে আরো অনেক দুর্গম পথ অতিক্রম করতে হবে। তখন পরিস্থিতি এবং পরিবেশ সেই স্বপ্নের অনুকূল থাকবে না প্রতিকূল হবে। সেটাতো সময় বলতে পারবে। এদিকে অজিত এবং সুনীল দুই বন্ধু একই স্কুলের দুইজন সহপাঠী। একদিন সুনীল অজিতকে বলছে তুই পড়াশোনাতো ভালোই করছিস, ভবিষ্যতে তোর মনে কি স্বপ্ন রয়েছে বা তুই কি হতে ইচ্ছা করিস। অজিত তখন তার বন্ধু সুনীলকে বলছিল ভাই সুনীল শুধু ইচ্ছা থাকলেই তো হয়ে যাবে না তার জন্য অনুকূল পরিবেশ এবং পরিস্থিতি এবং সঙ্গে অর্থের জোগান চাইতো না হলে স্বপ্নপূরণ হবে কি করে? সুনীল বলেছিল যে তোর ভবিষ্যত স্বপ্নটা কী? আর আমি শুনেছি ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। অজিত তখন তার বন্ধুকে বললো ভাই সুনীল কখন কখন ইচ্ছা থাকলেও উপায় হয় না। কারণ জীবনে চলার পথে অনেক আঁকাবাঁকা বা চড়াই উওরাই থাকে। কারণ উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেক বাধা বিপত্তি থাকে। বিশেষ করে আর্থিক জোগান সব থেকে বড় বাধা বা বিপত্তির কারণ হতে পারে। আমাদের আর্থিক অবস্থা সংসার অতটা সচ্ছল নয়। কারণ বাবার মাস মাইনের গোনা পয়সা, তার উপরে আমাদের দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ জোগানো এবং সংসারে খেয়ে পরে বেঁচে থাকা। আর সবই বাবার মাইনের টাকাতেই চালাতে হয়। কারণ অন্য কোন অর্থের সংস্থান নেই। সুনীল আবারও অজিতকে জিজ্ঞাসা করলো তোর জীবনের উদ্দেশ্য কি? তার ভবিষ্যত স্বপ্ন কি? আমার ভবিষ্যত স্বপ্ন তো অনেক বড়ো, সুনীল আবার জিজ্ঞাসা করলো ভাই অজিত খুলে বল না তোর ভবিষ্যতে কি হবার স্বপ্ন? অজিত বললো ভবিষ্যত তো এখনও অনেক দূরে রয়েছে। আর তুই যখন বলছিস তাহলে শোন, ভবিষ্যতে একজন ডাক্তার হয়ে সমাজ সেবা করার আশা তো মনে রয়েছে। এবার তোর ভবিষ্যতের স্বপ্নের কথা বল। সুনীল বলছিল ভাই অজিত, আমি কোন স্বপ্নে বিশ্বাস করি না বা মনেও আশা রাখি না। তবে হ্যাঁ আমার বাবা বলছিলেন আমাকে ডাক্তার করার স্বপ্ন বাবার মনে রয়েছে। কিন্তু আমার কোন নিজস্ব স্বপ্ন মনে নেই। তবে বি.এ পাশ করার পরে, আমি বাবার ব্যবসাই করবো। ব্যবসা স্বাধীন কোন বাধ্য বাধকতা থাকবে না। কিন্তু হ্যাঁ এখন ভবিষ্যতে যা হয় হবে ক্ষণ। অজিত এবং সুনীলের মধ্যে ভবিষ্যত জীবনের ভাবনা নিয়ে আলাপ আলোচনা চলতো। তারপর স্কুল শেষে যে যার বাড়ি চলে যেত। একদিন সুনীলের বাবা রতিকান্ত সরকার ছেলের ভবিষ্যত গড়ার একটা বিরাট আকাঙ্খা ছিল যে সুনীলকে সে ভবিষ্যতে ডাক্তার বানাবে। রতিকান্ত বাবুর টাকা পয়সার অভাব নেই। কারণ ট্রাস্নপোর্টের বড় ব্যবসা। স্থাবর এবং অস্থাবর সম্পত্তি রয়েছে। আম বাগন এবং চাষযোগ্য জমিও রয়েছে। ছাত্র জীবনে প্রত্যেক ছা্ত্রের মনেই ভবিষ্যতে কোন না কোন আশা বা স্বপ্ন থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কখন কখন ছাত্রের পিতা ও মাতার মনের অসম্পূর্ণ আশা বা স্বপ্ন তাদের পুত্র ও কন্যাদের মাধ্যমে অসম্পূর্ণ স্বপ্ন বা আশা পূরণ করার ইচ্ছা কখন কখন প্রকাশ পায়। সুনীলের পরিবারে ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি প্রকাশ। অথচ ছাত্র সুনীলের নিজের কোন ইচ্ছা বা আকাঙ্খা নেই নিজের ভবিষ্যত গড়া। ব্যাপারটা এইরূপ যে কোন মানুষের খাবার ঘরে আছে খাবার ইচ্ছা নেই খেতে পারে না। আবার কারোর ঘরে খারার নেই কিন্তু খাবারের ইচ্ছা এবং চাহিদা দুটোই আছে। প্রকৃতির কি বৈচিত্র্যময় খেলা এই সংসার জীবনে। এদিকে অজিত তার বাবা গোপেশ্বর বাবুর কাছে তার ভবিষ্যতে মনের আশা এবং স্বপ্নের কথা একদিন জানালো। অজিত বলছিল বাবা, ভবিষ্যতে আমি ডাক্তার হতে চাই। গোপেশ্বর তার ছেলেকে তার কাছে ডেকে বলেছিল যে বাবা অজিত ডাক্তারি পড়ার অনেক খরচ বড় ব্যয় সাধ্য ব্যাপার। আমাদের মতো ছাপোষা ঘরের ছেলেদের পক্ষে অলীক স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু নয়। তাছাড়া বাবা অজিত বয়স হয়েছে শরীর সাথ দিচ্ছে না। ডাক্তার বাবুকে শরীরটা দেখালাম। চিকিৎসক কয়েকটা পরীক্ষা করানোর কথা বলেছে। পরীক্ষা করার পরেই জানা যাবে রোগটা কি হয়েছে। এর মধ্যেই অসী্ম ডাক্তারি পরীক্ষার কাগজটা নিয়ে গম্ভীর মুখে ঘরে প্রবেশ করার পরে, অজিত তার ভাইয়ের কাছ থেকে কাগজ নিয়ে জানতে পারলো। তার বাবা গোপেশ্বর বাবুর ক্যান্সার রোগ ধরা পড়েছে। আর সেই দিন থেকেই অজিতের মিটমিটে মনের আশার আলো আঁধারে হারিয়ে যেতে শুরু করল।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct