ফিরে যায় একুশে
শাহনাজ পারভীন
_____________________
কি রে, কোথায় গেলি বেণী?------এই বেণী,ডাকতে ডাকতে মা সারা বাড়ি মাথায় করছে।নাহ, মেয়েটাকে নিয়ে আর পারিনা।এদিকে দুপুর গড়িয়ে গেলো।মেয়েটা এখনও ভাত খেলো না।কোথায় যে গেল-------। লাল ফ্রক আর হাফপ্যান্ট পরা। ফ্রক ভর্তি শিমুল ফুল।খালি পায়ে ধিং ধিং করে নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরছে বেণী। মা একটু বকাবকি করলো।কোথায় গিয়েছিল মুখপুড়ি? দেখি, দেখি জামার ভিতর কী? মা অবাক হয়ে গেলো বেণীর কান্ড দেখে। কি রে!কি করবি এত ফুল? বেণী বলল,তোমার মনে নেই? কাল ২১ শে ফেব্রুয়ারী। ভোর বেলায় ফুল দিতে যেতে হবে স্কুল থেকে। বেণী ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। ২১ শে ফেব্রুয়ারীর জন্য তাই তার ঘুম, খাওয়া নেই। কোন কবিতা পাঠ করবে,ফুল কোথা থেকে পাবে এই নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই। উস্তাজি তাকে শহীদ ভাইদের স্মরণে এক পৃষ্ঠার একখানা বক্তৃতা লিখে দিলেন,তাই সে দুই দিন ধরে মুখস্ত করে যাচ্ছে। বিকাল হতেই পারু,চম্পা,রিতা,সবাইকে নিয়ে বেণী বেরিয়ে পড়লো ফুল চুরি করতে।ও পাড়ায় রমেচ চাচাদের বাগানে।রমেচ চাচা জানতো,২১ ফেব্রুয়ারী আসলে তার বাগান ফাঁকা হয়ে যায়,তাই সে বিকেলের আগ থেকেই টহল দিতে থাকে।রমেচ চাচাকে ওরা দাদু বলে ডাকে। বেণী বলল,এই সেরেছে। পারু বলল, কী? ঐ দ্যাখ রমেচ দাদু। বাগান চৌকি দিচ্ছে। কি হবে এখন?তাহলে ফুল নেওয়া হবেনা?তাই বলে কেঁদে ফেলল। পারু বলল,উপায় একটা বের করতে হবে। চম্পা, বেণী,রিতা বলল, কি উপায়।তারপর কানে কানে শলা পরামর্শ করলো।।বেণী আর রিতাকে বসিয়ে রেখে ওরা দুজন কামাল চাচার দোকানে গেলো। সেখান থেকে দু’টাকার বাদাম,দু’টাকার মুড়ি ও দু’টাকার চানাচুর কিনলো। তারপর চানাচুর, মরিচ,পেঁয়াজ দিয়ে মুখরোচক করে মুড়ি মাখালো। চম্পা রিতাকে বলল,শোন রিতা,তুই আর পারু এই মুড়ি মাখা নিয়ে দাদুর সাথে খাবি আর চুটিয়ে গল্প করবি। আমি আর বেণী ফুল চুরি করবো। ফুল চুরি হয়ে গেলে আমি কুহু করে শব্দ করবো তখন তোরা দুজন চলে আসবি। যথাযথ সময়ে রিতা আর পারু মুড়ি মাখা খেতে খেতে দাদুর কাছে গেলো।
দাদু বলল,কি রে পারু,কোথায় যাচ্ছিস তোরা?
পারু বললো,এই তো এইদিকেই যাচ্ছিলাম।
বলতে বলতে মুড়িমাখা খাচ্ছে দু,জন।
কী খাচ্ছিস তোরা?
দাদু জিজ্ঞেস করলো।
রিতা বলল,মুড়িমাখা।
খাবে দাদু?
তাই বলে দাদুর হাতে প্রায় সব মুড়িমাখা তুলে দিলো রিতা। আরে আরে,--এতো দিচ্ছিস কেন? তোরা খাবিনে। দাদু বলল, পারু বলল,না দাদু। আমরা অনেক খেয়েছি।এগুলো তুমি খাও। আর আমাদের মজার মাজার গল্প শোনাও। ওরা দু,জন ইনিয়ে -বিনিয়ে,এ কথা -সে কথা বলে বলে দাদুকে ব্যস্ত রাখলো। দাদু খুশীমনে মুড়ি মাখা খাচ্ছে আর উত্তর দিচ্ছে। বাগানে ঢুকলো বেণী।কী খুশী। হরেক রকম ফুল দেখে।তড়িঘড়ি করে এক জামা ভর্তি ফুল তুললো। ফ্রকের কুচিগুলো মাজার সাথে বাঁধলো চম্পা তারকাঁটা উচু করে ধরলো।বেণী পার হতে গিয়ে তারকাঁটা পিঠে বিঁধে রক্ত পড়তে লাগলো। চম্পা তাড়াতাড়ি গাঁদাফুলের পাতা রস করে কাটা জায়গায় দিয়ে দিলো।তারপর চম্পা কুহু কুহু করে শব্দ করলে পারু ও রিতা চলে আসলো। বাড়ি এসে ওরা চারজনে চারটা মালা গাঁথলো।তারপর একসাথে গান গাইতে থাকলো।সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের স্বরণে-------।
কী আনন্দ! কী শিহরণ! যেন চারিদিকে উৎসবমুখর পরিবেশ। রাত্রে ভালো ঘুম হলো না বেণীর।কখন সকাল হবে। । আধো ঘুম আধো জাগরণ।এভাবে রাতটা কাটলো।সকালে উঠে বাড়ীর যার পায়ে স্যান্ডেল দেখছে, টেনে টেনে খুলে দিচ্ছে। নিজেও স্যান্ডেল পরছেনা কাউকে পরতেও দিচ্ছে না। তারপর খালি পায়ে চারজন মালা চারটি নিয়ে স্কুলে রওনা হলো। বেণীর স্কুল ও কলেজ পাশাপাশি। জাতীয় কোনো অনুষ্ঠান হলে স্কুল ও কলেজ একসাথে মিলে হয়। তারপর রাস্তার দুইপাশে দুই লাইন দিলো।বিশাল লম্বা দুই লাইন।এক লাইনে ছেলেরা আর এক লাইনে মেয়েরা। সবার হাতে দু’একটা ফুল থাকতো।একটা গ্রাম পার হয়ে ফুল দিতে যেতে হতো।বড় ভাইয়েরা শ্লোগান দিতো----- শহীদের রক্ত,বৃথা যেতে দেবো না। অন্যদেরও বলতে হতো। ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২১ শে ফেব্রুয়ারী। অমর হোক। অমর হোক। আবার কখনও কখনও ছোট ছোট গানের কলি সবাই মিলে একসাথে গাইতে গাইতে যেতো।সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের স্বরণে---গ্রামের সমস্ত লোকজন রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দাঁড়িয়ে থাকতো দেখার জন্য। সে কী অনুভূতি, সত্যই ভোলার নয়।মালা প্রদান শেষ হলে স্কুলের মাঠে শুরু হতো সাংস্কৃতি অনুষ্ঠান। গান,কবিতা আবৃত্তি, বক্তৃতা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
এবার বেণীর পালা।মাইক এ বেণীর নাম ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথে বেণী মঞ্চে হাজির হলো।বেণীর বক্তৃতা শেষ হলে চারিদকে করতালি শুরু হলো। বেণী খুব ছোট ছিল তাই স্যার তাকে উুচ করে ধরলেন টেবিলের উপর। মাঠভর্তি লোকের সামনে বেণী নির্ভয়ে বক্তৃতা দেওয়াতে চারিদিকে প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো। এত আনন্দ, এত খুশী সে কখনও হয়নি।বেণীর মনে হলো,ফুলে ফুলে ভরা শহীদমিনারটাও যেন তাকে দেখছে।বেনী গৌরববোধ করলো।হাতে একটু ধুলা নিয়ে মাথায় ছোঁয়ালো।আবারও স্যালুট জানালো শহীদদের প্রতি। বেণী আজও খুঁজে বেড়ায় সেই একুশ,যে একুশে মিশে ছিলো মায়ের ঘ্রাণ,যে ২১শে মানুষের চোখে মেখে থাকতো একই স্বপ্ন।যে ২১শে মিছিলে মিছিল প্রতিবাদে মুখরিত থাকতো রাজপথ।এখনও বার বার ফিরে যায় সেই রক্তাক্ত কৃষ্ণচুড়ার গাছের নীচেই।যেখানে মানুষের আবেগ, অনুভুতি,ভালবাসায়, ভক্তি শ্রদ্ধায় মাথা উচু করে দাড়িয়ে থাকে শহীদ মিনার।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct