মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচার যে বনভূমি ধ্বংস করে চলছে, বনভূমি ধ্বংস করার এ প্রক্রিয়াকে বনভূমি উজাড় বলে। পৃথিবীপৃষ্ঠের ৩০ শতাংশ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটিকে আর্দ্র রাখে। চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে।কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতা কমে যায়। যার ফলে গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। এ নিয়ে লিখেছেন কাজী ফারহানা ইসলাম।
সমগ্র পৃথিবীকে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে রক্ষা করে থাকে বনভূমি। তবে বর্তমান সময়ে বনভূমি উজাড়ের ফলে এ পরিবেশ ও জনজীবন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। রাষ্ট্রসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) মতে, প্রতি হেক্টর জমিতে কমপক্ষে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ হেক্টরে বিভিন্ন ধরনের গাছপালার সমাবেশকে বনভূমি বলে। বনভূমি উজাড় বা বন নিধন বলতে সাধারণত আমরা বন পরিষ্কার করার জন্য বা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো গাছপালা কেটে ফেলা বা পুড়িয়ে ফেলাকে বুঝি। অন্যভাবে বলতে গেলে মানুষ তার নিজস্ব প্রয়োজন মেটাতে নির্বিচার যে বনভূমি ধ্বংস করে চলছে, বনভূমি ধ্বংস করার এ প্রক্রিয়াকে বনভূমি উজাড় বলে। আমরা জানি যে পৃথিবীপৃষ্ঠের ৩০ শতাংশ বনভূমি দ্বারা আচ্ছাদিত। বনভূমি পৃথিবীর ফুসফুস। গাছপালা কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে অক্সিজেন ত্যাগ করে এবং ছায়া সরবরাহের মাধ্যমে মাটিকে আর্দ্র রাখে। চারপাশের পরিবেশকে সুরক্ষিত রাখে। কিন্তু যখন কোনো বন কেটে ফেলা হয় বা পুড়িয়ে ফেলা হয়, তখন আর্দ্রতা কমে যায়। যার ফলে গাছপালা শুকিয়ে যায় এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে। বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগব্যাধি এবং গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট শুকিয়ে আগুনের সূত্রপাত ঘটে এবং তার থেকে দ্রুত বনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। মানুষের পাশাপাশি বনভূমিতে বসবাসকারী প্রাণীরা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সংক্রামক ব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা দুই দশক ধরে এ বিষয়ে বারবার সতর্ক করেছেন। তাঁরা বলেছেন, মানুষ যত সীমালঙ্ঘন করে বনে প্রবেশ করবে, বুনো প্রাণীদের হওয়া নানা রোগব্যাধি মানবজাতিকে তত বেশি সংক্রমিত করবে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর একটুও অবাক হননি ব্রাজিলের ফেডারেল ইউনিভার্সিটি অব মাতো গ্রাসোর ইকোলজিস্ট আনা লুসিয়ে তোউরিনহো। তিনি পরিবেশ ভারসাম্য বিনষ্ট হলে কীভাবে বন এবং সমাজ অসুস্থ হয়ে পড়ে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বলেছেন, যখন কোনো নতুন ভাইরাস সেটির প্রাকৃতিক আবাস ত্যাগ করে মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তখন ভীষণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। করোনাভাইরাস সেইটাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছে। করোনার প্রাদুর্ভাবের আগেই বেশ কয়েকটি বৈজ্ঞানিক গবেষণায় বন উজাড়ের কারণে বাদুড়ের আবাস বিনষ্ট হওয়া এবং সেগুলোর চারদিকে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে নতুন মহামারির বিস্তার সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছিল। পোল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব ওয়ারশর গবেষক আনিতা আফেল্ট তার গবেষণায় পরবর্তী মারাত্মক সংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাব এশিয়া মহাদেশ থেকে হবে বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গত ৪০ বছরে এশিয়া মহাদেশে মারাত্মকভাবে বন উজাড় করা হয়েছে।
এফএওর হিসাবে, বিশ্বব্যাপী ২০০০-২০১৫ সময়কালে প্রায় ১ দশমিক ৪ শতাংশ বন উজাড় হয়েছে। বাংলাদেশে তা ২ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশে বছরে ২ হাজার ৬০০ হেক্টর বন উজাড় হয়। এ উজাড় হওয়া থেকে সংরক্ষিত বনও রক্ষা পাচ্ছে না। বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে পরিচিত দেশের সংরক্ষিত বন ‘সুন্দরবন’–এর বিস্তার ও ঘনত্ব কমেছে। বেসরকারি সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের এক গবেষণায় বলেছে, গত দুই দশকে সুন্দরবনের গাছপালার পরিমাণ মারাত্মক হারে কমেছে। কমেছে বনের ঘনত্বও। বন উজাড় হয়ে ফাঁকা ও পতিত জমির পরিমাণ বাড়ছে। সুন্দরবন আগের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। দিন দিন জনসংখ্যা বৃদ্ধির চাপ, শিল্পায়ন, নগরায়ণ ও কৃষি সম্প্রসারণ ও বিভিন্ন দুর্যোগ ফলে সমগ্র বিশ্বব্যাপী বনভূমি কমছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যার ফলে মেরু অঞ্চলে বরফ গলতে শুরু করেছে। বিশ্বব্যাপী উপকূলীয় নিম্ন এলাকা তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় নিম্ন এলাকা সাগরের লোনা জলে তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে সব থেকে বেশি। উপকূলীয় অঞ্চলের মাটি-পানি ক্রমেই লবণাক্ত হয়ে পড়েছে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলার কারণে নতুন নতুন অণুজীব অবমুক্ত হচ্ছে। যার ফলে সংক্রামক রোগব্যাধির উৎপত্তি হচ্ছে। বনভূমি রক্ষার্থে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক বনের বাইরে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৃক্ষরোপণ, বাণিজ্যিক বাগান ও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে গাছের সংখ্যা বেড়েছে। বনভূমি সংরক্ষণে আমাদের সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। যত্রতত্র নির্বিচার গাছ কাটা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে বন উজাড়কারীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct