২০০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতিবছর নতুন ৮ দশমিক ১ মিলিয়ন ক্যানসারে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়। প্রতিবছর প্রায় ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই আমাদের মতো দেশের মানুষ। ক্যানসারের সুদির্দিষ্ট কারণ এখনও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। এটি নিয়ে গবেষণা চলছে সচেতনা সৃষ্টির। এ নিয়ে লিখেছেন ডা. সৌরভ বিশ্বাস। আজ প্রথম কিস্তি।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ২২তম বিশ্ব ক্যানসার দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে ‘ক্লোজ দ্য কেয়ার গ্যাপ’। ২০০০ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড সামিটে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি সম্মিলিতভাবে ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতিবছর নতুন ৮ দশমিক ১ মিলিয়ন ক্যানসারে আক্রান্তের তথ্য পাওয়া যায়। ২০১৮ সাল নাগাদ বছরে ১৮ দশমিক ১ মিলিয়ন নতুন রোগীর তথ্য পাওয়া যায়। এটি এমন একটি রোগ, যার কারণে প্রতিবছর প্রায় ৯ দশমিক ৬ মিলিয়ন মানুষ মারা যাচ্ছে এবং এর মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই আমাদের মতো দেশের মানুষ। ক্যানসারের সুদির্দিষ্ট কারণ এখনও আমাদের কাছে অজ্ঞাত। এটি নিয়ে গবেষণা চলছে। তবে সাধারণত খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে ধূমপান বা মদপান ও অন্য কিছু কারণে এ ধরনের রোগের ঝুঁকি বাড়ে।
আমাদের দেশে তামাকজনিত ক্যানসারে পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয়। এ ছাড়া খাদ্যনালি ও কোলন ক্যানসারেও পুরুষরা বেশি আক্রান্ত হয়। প্রোস্টেট ক্যানসার তুলনামূলক কম হয়। আর নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসার, জরায়ুমুখের ক্যানসার, খাদ্যনালি, কোলন ক্যানসার, ডিম্বাশয়ের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে আজকাল নারীদের ফুসফুস ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যাও বাড়ছে। অথচ বেশিরভাগ নারীই ধূমপান করেন না। এ জন্যই বলা যায়, ক্যানসারের সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও অজ্ঞাত। আর নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই নাক-কান-গলার ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার হার বেড়ে চলেছে। বর্তমানে মানুষের মধ্যে পাওয়া ক্যানসারের ৪০ শতাংশেরও বেশি নিরাময়যোগ্য। প্রাথমিক অবস্থায় ধরা পড়লে এই রোগ সারানোর সম্ভাবনা অনেকাংশে বেড়ে যায়। ২০০ প্রকারেরও বেশি ক্যানসার রয়েছে। প্রতিটি ক্যানসারই আলাদা এবং এদের চিকিৎসা পদ্ধতিও আলাদা। শরীরে অসংখ্য ছোট ছোট কোষের মাধ্যমে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মারা যায়। এই পুরোনো কোষগুলোর জায়গায় নতুন কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে এবং নিয়মমতো বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়। যখন এই কোষগুলো কোনো কারণে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তে থাকে তখনই ত্বকের নিচে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। একেই টিউমার বলে। এই টিউমার বিনাইন বা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারকেই ক্যানসার বলে। কোষ আশপাশের কলাকে ভেদ করতে না পারলে তাকে বলে নিরীহ বা বিনাইন টিউমার। বিনাইন টিউমার ক্যানসার নয়। অনেক ক্যানসার প্রথমে বিনাইন টিউমার হিসেবে শুরু হয়, পরে তার মধ্যকার কিছু কোষ পরিবর্তিত (ট্রান্সফরমেশন) হয়ে ম্যালিগন্যান্ট (অর্থাৎ ভেদক ক্ষমতাযুক্ত) হয়ে যায়। তবে বিনাইন টিউমার ক্যানসারে পরিবর্তিত হবেই- তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছু বিনাইন টিউমারসদৃশ ব্যাধি আছে, যাতে ক্যানসার হওয়া অবশ্যম্ভাবী, যাকে প্রি-ক্যানসার বলে। নামে বিনাইন অর্থাৎ নিরীহ হলেও বিনাইন টিউমারও চাপ দিয়ে আশপাশের কলার ক্ষতি করতে পারে।জরায়ু ক্যানসারের প্রধান কারণ এইচপিভি (হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস)। একইভাবে লিভার ক্যানসারের কারণ হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। যদিও জরায়ুমুখে ক্যানসারের জন্য আরও একাধিক কারণ রয়েছে। স্তন ক্যানসারের জন্য দায়ী অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি, বায়ুদূষণ, খাদ্যাভ্যাস, পারিবারিক ঐতিহ্য ও অনিয়ন্ত্রিত জন্মবিরতিকরণ পিল সেবন। দীর্ঘ সময় ধরে ক্লান্তিবোধ বা অবসাদে ভোগা ক্যানসারের উপসর্গ হতে পারে। মলাশয়ের ক্যানসার বা রক্তে ক্যানসার হলে সাধারণত এমন উপসর্গ দেখা যায়। কোনো কারণ ছাড়া হঠাৎ দ্রুতগতিতে যদি ওজন বাড়ে, দীর্ঘদিনের ব্যথা, অস্বাভাবিক মাংসপিণ্ড, ঘন ঘন জ্বর, ত্বকে পরিবর্তন, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, অকারণে রক্তক্ষরণ, খাবার গ্রহণে সমস্যা ক্যানসারের বিশেষ উপসর্গ। এর বাইরেও অনেক লক্ষণ আছে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যক্তির সচেতনতা। এগুলোর মধ্যে আছে পা ফুলে যাওয়া, শরীরের আকারে বা অনুভূতিতে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ইত্যাদি। (ক্রমশ...)
আমাদের দেশে বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানের ক্যানসার চিকিৎসা হচ্ছে। কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত জনবল ও কারিগরি সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তিগত সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে বিদেশগামিতা কমিয়ে দেশেই এ রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে।
ডা. সৌরভ বিশ্বাস: রেসিডেন্ট চিকিৎসক, ক্লিনিক্যাল অনকোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct