জীবন সংগ্রাম
বারী সুমন
___________
মহাকালের চিরায়ত নিয়মে নতুন সূর্যদোয়ের মাধ্যমে শুরু হয় একটা নতুন দিনের। সেই সাথে শুরু হয় আর একটা দিন বেঁচে থাকা জীবন যুদ্ধের। সমগ্র প্রানীকূল পায়ে পায়ে শামিল হয় সে মহাসংগ্রামে। তেমনি একটা জীবনযুদ্ধ শুরু হয় বাংলার কোন মফস্বলের ছোট রেলস্টেশনে,খেটে খাওয়া কুলি মজুরদের। যেখানে জীবন শুরু হয় একরাশ হতাশা আর একটু বেঁচে থাকার আকাঙ্খা নিয়ে। ট্রেনের হুইসেলে ঝিমিয়ে পড়া স্টেশনে প্রাণের সঞ্চার হয়। নানান কথকতায় মুখর হয়ে উঠে স্টেশন চত্বর। একটা নতুন ট্রেন হাজারো মানুষের আশা নিয়ে ভিড়ে স্টেশনে। স্টেশনে থাকা প্রতিটি মানুষ তার আপন কাজ গোছাতে ব্যস্ত। হকার থেকে চা বিক্রেতা এমনকি সাধারণ জনতাও নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। স্টেশনে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন তেমনি এক চিরন্তন পেশা “কুলি”। মানুষ সবসময়ই তাদের অবজ্ঞার চোখে দেখে, অথচ তাদের বোঝা টেনেই তাদের কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে দেন এই কুলি নামক পেশার মানুষটি। প্রতিটি মানুষের মতো এ মানুষটিরও রয়েছে পরিবার-সন্তান। হয়তো তার এই উপার্জনেই ভাত জোটে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের। রোদ, ঝড়, বৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিদিন স্টেশনে হাজির হয় সে ব্যক্তিটি। কোনদিন স্টেশনের ছোট্ট প্ল্যাটফর্মেই ঘুমিয়ে পড়ে মানুষটি। কোন কোন সময় রাত্রি শেষ প্রহরে এসে প্ল্যাটফর্মে শুয়ে থাকেন সে কুলি নামের মানুষটি, কেননা যদি ট্রেন এসে চলে যায় তার রোজগারের কিছুটা অংশ কমে যাবে। তাই কিছুটা ঘুম বিসর্জন দিয়ে স্টেশনেই শুয়ে থাকেন ট্রেনের দীর্ঘ প্রতিক্ষায়। ট্রেন স্টেশনে প্রবেশ করলেই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে মাথায় গামছা বেঁধে লেগে পড়ে মালামাল উঠা নামার কাজে। অল্প সময়ের জন্য ট্রেন থামে, সেই সময়ের মধ্যেই মালামাল উঠানো বা নামানোর কাজ শেষ করতে হয়। যার মালামাল বুঝিয়ে দিয়ে পাওনা আদায়ের জন্য যান তার কাছে। উপযুক্ত পারিশ্রমিক কেউই দিতে চান না, বরং অনেক সময় হতে হয় বঞ্চনার স্বীকার। তবুও যা পান হাসিমুখে পকেটে পুরে চলে যান চায়ের স্টলে। অল্প দামের রুটি দিয়ে পেটের একাংশ পূরণের চেষ্টা করেন।
কোন কোন সময় ট্রেন আসা যাওয়ার মাঝে থাকে দীর্ঘ বিরতি স্টেশনের পাটাতনে বসে কখনও বিড়িতে টান দেন উদাস মনে। ধোঁয়া ছেড়ে ট্রেন যেমন চলে যায় দূর থেকে বহুদূর কুলি লোকটিও বিড়ির ধোঁয়া ছেড়ে মনের কষ্টকে বহুদূরে ঠেলে দিতে চান। কিন্তু সত্যিকার অর্থেই কি তিনি পাড়েন কষ্টকে দূর করতে? তারাও সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতে চান একে অপরের সাথে। একজন দুজন নয় বেশ কিছু কুলি থাকে স্টেশনে। তারা গল্প করেন সবাই মিলে। যে গল্প হয়তো স্থান পাবেনা কোন ভদ্র সমাজে, কিংবা উচ্চবিত্ত মানুষের মনে। মাথায় বোঝা টেনে কুলি লোকটি যে আমাদের মনুষত্বের বোঝাকে আরও বাড়িয়ে দেয় সে কথা কি আমরা কখনও ভাবি? ভাববার সময়ই বা কোথায়? যখন শুধু ভারী বোঝা বইবার জন্য কাউকে প্রয়োজন তখন মনে পড়ে কুলিকে। কাজ শেষ হলেইতো পুনরায় বাবুসাব। পরের বোঝা বয়ে তার জীবন পাড়ি দিতে হয়, সেই সাথে রয়েছে পুরো পরিবারের বোঝা বইবার এক অনন্য ধৈর্য্য। স্ত্রী-সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মাও হয়তো প্রতীক্ষায় থাকেন কখন ফিরবে ঘরে। ঘরে ফিরবে হয়তো সেদিনের রান্নার চাল, ডাল, তেল, নুন নিয়ে। নিতে হয় বাবা-মায়ের ঔষধ।
---”বৌ মা, ওকি ফিরেছে?”
---”না বাবা, হয়তো এক্ষুণি ফিরবে।”
ছেলের স্কুলের বেতন আজ নয় কাল করে করে হয়তো তিন মাসের জমে গেছে।
---বাবা, মাস্টার মশাই বলেছেন, স্কুলের বেতন না দিলে পরীক্ষা দিতে দিবেনা এবার।
---এইতো বাবা আর কয়টা দিন, পরীক্ষার আগেই সব শোধ করে দিবো।
নিজের জন্য একটা জামা কিনি কিনি করে কেনা হয়নি পরিবারের অন্য সবার সুখের কথা চিন্তা করে। তবুও তাতে সুখ, নিজেকে কষ্টের অনলে পুড়িয়ে আরও খাঁটি করেন। ট্রেন আসে ট্রেন যায়, মাঝখানে অল্প একটু সময়। তাতে কত পরিবর্তন কত রং বদলায়। কিন্তু বদলায় না কুলি নামক পেশায় নিয়োজিত মানুষটির জীবন। আবারও হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুটে চলে নতুন কোন স্টেশনের উদ্দেশ্যে, কিন্তু কুলি শুয়ে থাকে নতুন আরেকটি ভোরের অপেক্ষায়। নতুন ভোর তাকে কোনদিনও নতুন কিছু এনে দেয়না তবুও সেই ভোরের জন্য দীর্ঘ প্রতীক্ষা। কিসের এতো প্রতীক্ষা? হয়তো জীবন যুদ্ধে নিজেকে টিকিয়ে রাখার একটা ক্ষুদ্র চেষ্টা মাত্র। কুলির চোখে শুধুই ট্রেনের মতো ছুটে চলা কিছু স্বপ্ন যা বাস্তবে রূপ পায়না। দীর্ঘ দিবস রজনী নির্ঘুম পাড়ি দিয়ে দীর্ঘ প্রতীক্ষা শুধুই জীবন সংগ্রামের।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct