ঠিক ১০০ বছর পর ক্ষমতাসীন বিজেপি-র সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্ন। সমাজ দ্রুত পরিবর্তন করে নির্বাচনে জেতার স্বার্থে যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে গান্ধীর সংজ্ঞায়িত মবোক্রেসির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে দল ও সরকার শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে তো? উন্মত্ত জনতাকে শৃঙ্খলমোচন করিয়ে বাজারে ছাড়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। গত মাসখানেকের মধ্যে যা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, হিন্দুত্ববাদ নামের বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। তা নিয়ে লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী। আজ শেষ কিস্তি।
এ প্রসঙ্গে গত আগস্টে আমেরিকার
দ্য আটলান্টিক পত্রিকায় চমৎকার একটি লেখা লেখেন আতিস তাসির। তাঁর মা ভারতের সাংবাদিক, বাবা পাকিস্তানের প্রয়াত শিল্পমন্ত্রী ও পাঞ্জাব প্রদেশের গভর্নর সালমান তাসির। সাংবাদিক আতিস তাসির দীর্ঘ সময় মুম্বাইয়ে কাটিয়েছেন, কাছ থেকে দেখেছেন বলিউডকে, যে জগৎকে সমৃদ্ধ করেছে বিভিন্ন ভাষা, ধর্ম ও জাতের শিল্পীরা। তাঁর লেখা, দ্য ওয়ার অন বলিউড-এ (বলিউডের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) তাসির লিখেছেন, ভারতের যে একটা জাতীয় পুরাকথা (মিথ) আছে, নাচে-গানে ভরা বলিউড তাকেই ধারণ করে। তিনি লিখেছেন, ‘কিন্তু বলিউডের কৃতিত্ব অন্যত্র। সামাজিক ন্যায়, নারী থেকে সমকামীদের অধিকার, অন্য ধর্মে বিবাহের মতো সিরিয়াস বিষয়কেও বলিউড বিনোদনের সঙ্গে মেশাতে পারে, তাই বলিউডের ছবি বাণিজ্যিক ও রাজনৈতিক দুই-ই। ভারতের বহুত্ববাদকে ধারণ করে বলিউড। আজকের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় সেই কারণেই টার্গেট করা হচ্ছে বলিউডকে। একসময় হলিউডে যেমন শিল্পীদের একটা কালোতালিকা বানানো হয়েছিল, তেমনি হচ্ছে বলিউডে।’ এখানে পঞ্চাশের দশকে আমেরিকার রাজনীতিবিদ জোসেফ ম্যাকার্থির বামপন্থী লেখক-শিল্পীদের কালোতালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়েছে।
তাসির লিখেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদী বিজেপি নানা ব্যবস্থা নিয়েছে বলিউডের শৈল্পিক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ করতে। বিশেষত বলিউডে মুসলমানদের বিরাট প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করতে নানা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এসব করা হচ্ছে খেয়ালখুশিমতো করসংক্রান্ত তদন্ত শুরু করে, অভিনেতা-পরিচালকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনে, হুমকি দিয়ে এবং বিভিন্ন ছবি ও টেলিভিশন অনুষ্ঠানের প্রযোজকদের হেনস্তা করে।’
যাঁরা নিজের কাজের কারণে বিখ্যাত এবং ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে পুরোপুরি এক হয়ে কাজ করেননি (যেমন অভিনেতা-প্রযোজক আমির খান, অভিনেত্রী দীপিকা পাড়ুকোন, পরিচালক অনুরাগ কাশ্যপ, অভিনেতা সোনু সুদসহ আরও অনেকে), তাঁরা নানা সমস্যায় পড়েছেন। অন্যদিকে যাঁরা হুমকি দিচ্ছেন, তাঁদের বরং উন্নতিই হচ্ছে। গত কয়েক বছরে লাগাতার হুমকি দিয়ে আজ বিরাট তারকায় পরিণত হয়েছেন নরসিংহানন্দ, হরিয়ানায় সুরাজ পাল সিং আমু, দিল্লিতে বিষ্ণু গুপ্ত প্রমুখ। আরও কয়েক ডজন নেতা–নেত্রীও খুবই জনপ্রিয় হয়েছেন। তাঁরা সারাক্ষণই মেরে বা কেটে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন।
এই হুমকিদাতারা বুঝতে পেরেছেন, এ পথেই আরও জনপ্রিয় হবেন; এমএলএ, এমপি, এমনকি মন্ত্রীও হতে পারেন। যেমন হিমন্ত বিশ্বশর্মা ধারাবাহিকভাবে প্ররোচনামূলক বক্তব্য দিয়ে আজ আসামের মুখ্যমন্ত্রী। এ ছাড়া উগ্র হিন্দুত্ববাদী কিন্তু সফল রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রয়েছেন তেলেঙ্গানা রাজ্যের ব্যান্ডি সঞ্জয় কুমার, মধ্যপ্রদেশের প্রজ্ঞা ভারতী, বিহারের গিরিরাজ সিং থেকে দিল্লির কপিল মিশ্র বা পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। ফলে নরসিংহানন্দদের উৎসাহ বাড়ছে।
এই নব্য হিন্দুত্ববাদের একটা ধারাবাহিকতাও আছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদের নামে ১৯৯০ সালে রথযাত্রা বের করেছিলেন বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি। সেই যাত্রার কারণে তিনি উপপ্রধানমন্ত্রী (২০০২-০৪) হয়েছিলেন, এক দশকের মধ্যে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। সেই একই পথে হেঁটে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। তাঁর শাসনকালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় প্রধানত সংখ্যালঘু ও কিছু সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। কিন্তু মোদিকে পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
চরম হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি গত দুই দশকে আরও গভীর হয়েছে। বর্তমানে দ্রুত এই রাজনীতির পতাকাবাহক হয়ে উঠছেন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। সেই পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে ভারতে গৈরিকীকরণের কাজ জনসমক্ষে করে চলেছেন নরসিংহানন্দ, কালীচরণ, আমুরা। তাঁদের প্রয়োজন হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি, হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিরও প্রয়োজন তাঁদের—নির্বাচনে জিততে। এই নতুন হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর উত্থানের পর আজ প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ী, আদবানি, এমনকি নরেন্দ্র মোদিকেও অত্যন্ত সংযত ও পরিশীলিত নেতা বলে মনে করা হয়। বস্তুত উগ্রবাদী শিবির মনে করে, নরেন্দ্র মোদি যথেষ্ট হিন্দুত্ববাদী নন, সেই কারণে তাঁকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আক্রমণও করা হচ্ছে। এই গোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদের নতুন মুখ।
সনাতন ধর্মের রাজনৈতিক চেহারার কথা বলতে গিয়ে আজ সাধারণ মানুষ বাজপেয়ীর কথা বলেন না। তাঁরা কিছুটা বলেন মোদির কথা আর অনেক সময়েই আলোচনা করেন আদিত্যনাথকে নিয়ে। আর সনাতন ধর্মের সামাজিক দিক নিয়ে আলোচনার সময়ে মানুষ ধর্মের শান্ত, সমাহিত রূপের কল্পনাও আর করেন না। ওই উন্মত্ত বাঘরূপী ‘মব’-এর কথাই আগে মাথায় আসে। সেই বাঘের ওপরে আপাতত আসীন ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ নরেন্দ্র মোদি, যিনি ভারতের রাজনীতিকে সম্পূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছেন। আগামী বছর ও তার পরবর্তীকালে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে বাঘরূপী উগ্র হিন্দুত্ববাদকে (যে শক্তি সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার কথা বলে) তিনি সামলাতে পারেন কি না, সেটাই সম্ভবত ভারতের রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। সামলাতে না পারলে কী হবে, তার উদাহরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে অজস্র রয়েছে। নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। (সমাপ্ত)
সৌজন্যে: প্র. আ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct