ঠিক ১০০ বছর পর ক্ষমতাসীন বিজেপি-র সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্ন। সমাজ দ্রুত পরিবর্তন করে নির্বাচনে জেতার স্বার্থে যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে গান্ধীর সংজ্ঞায়িত মবোক্রেসির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে দল ও সরকার শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে তো? উন্মত্ত জনতাকে শৃঙ্খলমোচন করিয়ে বাজারে ছাড়ার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। গত মাসখানেকের মধ্যে যা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, হিন্দুত্ববাদ নামের বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। তা নিয়ে লিখেছেন শুভজিৎ বাগচী। আজ প্রথম কিস্তি।
উত্তরপ্রদেশের দুই গ্রাম চৌরি ও
চৌরার একমাত্র থানাটি ১৯২২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জ্বালিয়ে দেয় স্বাধীনতাকামী উন্মত্ত জনতা। মৃত্যু হয় ২৩ পুলিশ সদস্যের। কিন্তু এ ঘটনার জেরে অসহযোগ আন্দোলনে অকালেই দাঁড়ি টানেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তিনি লেখেন, জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে ‘সক্রিয় পদক্ষেপ নেওয়া না হলে গোটা ভারত সংক্রমিত হবে’।
তাঁর সিদ্ধান্ত ঠিক না ভুল, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক ভারতে হলেও গান্ধী বুঝিয়েছিলেন, উন্মত্ত জনতাকে—ইংরেজিতে যাকে ‘মব’ বলা হয়—নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ভবিষ্যতে বিপদে পড়বে তাঁরই দল কংগ্রেস।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ শাহিদ আমিন লিখেছেন, ‘জাতীয়তাবাদী মবকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার প্রয়োজন ছিল।’ গান্ধী লিখেছেন, ‘কিছু বুদ্ধিমান কর্মী প্রয়োজন, যাতে গোটা জাতিকে সুসংহত করে কাজ করানো যায়, মবোক্রেসি (জনতার উন্মত্ততা) থেকে ডেমোক্রেসির (গণতন্ত্র) উদ্ভব হয়।’ অর্থাৎ জীবনে আগুন প্রয়োজন, কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। সেটাই ঘটেছিল চৌরি-চৌরায়।
ঠিক ১০০ বছর পর ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির সামনে এটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বা প্রশ্ন। সমাজ দ্রুত পরিবর্তন করে নির্বাচনে জেতার স্বার্থে যে হিন্দুত্ববাদী শক্তিকে গান্ধীর সংজ্ঞায়িত মবোক্রেসির দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তাকে দল ও সরকার শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারবে তো?
এই উন্মত্ত জনতাকে শৃঙ্খলমোচন করিয়ে কীভাবে বাজারে ছাড়া হচ্ছে, তার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। গত মাসখানেকের মধ্যে যা ঘটেছে, তা খতিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে, হিন্দুত্ববাদ নামের বাঘের পিঠে সওয়ার হয়ে রাজনীতি করছে বিজেপি। এই বাঘের উন্মত্ততা, ক্রোধ ও গতি ক্রমেই বাড়ছে।
কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। ধরমদাস মহারাজ নামের বিহারের ধর্মীয় এক গুরু এক ধর্মসভায় বলেছেন, ‘আমার হাতে বন্দুক থাকলে আমি গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসে হয়ে যেতাম। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে সংসদ ভবনে গুলি করে মারতাম।’ অর্থাৎ ভারতের একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খোলাখুলি হত্যার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বের যেসব দেশে রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে বলে মনে করা হয়, সম্ভবত সেখানেও এটা হয় না।
দুই. এখন নিয়মিতই নাথুরাম গডসের নাম করে হিন্দুত্ববাদী ‘মব’ চরম হিংসার কথা বলছে। সন্ত কালীচরণ নামের মহারাষ্ট্রের এক সাধু গত সপ্তাহে গান্ধীকে অশ্রাব্য ভাষায় আক্রমণ করে প্রকাশ্যে বলেন, ‘নাথুরাম গডসেকে নমস্কার যে তিনি গান্ধীকে হত্যা করেছিলেন।’ ভারতে এ কথা প্রকাশ্যে বলা যেত না, যদি মহাত্মা গান্ধীকে ভারতে ‘জাতির পিতা’ বলে মনে করা হতো। হয়তো এখনো হয়।
তিন. বছরজুড়ে, বিশেষত খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের উৎসবের মাস ডিসেম্বরে অগণিত জায়গায় তাদের ওপরে হামলা হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের রিপোর্ট বলছে, বছর শেষ হওয়ার অনেক আগেই তিন শতাধিক হামলা হয়েছে খ্রিষ্টান নারী, উপজাতি ও তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের ওপরে।
চার. উত্তর ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের ধর্মসভায় বিভিন্ন গোষ্ঠী ও রাজ্যের প্রভাবশালী কিছু ধর্মীয় নেতা এক হয়ে খোলাখুলি হিন্দুদের অস্ত্র হাতে নিতে বলেছেন। ইয়েতি নরসিংহানন্দ নামের সদ্য জনপ্রিয় হওয়া উত্তরপ্রদেশের এক সাধু ধর্মসভার আয়োজন করেছিলেন। বিজেপির ছোটখাটো নেতা–নেত্রীরাও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ওই ধর্মসভায় মুসলমান সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেওয়ার প্রস্তাবে সবাই সায় দেন বলে ভিডিও চিত্র মারফত জানা গেছে।
পাঁচ. প্রতিদিনই কোনো রাজনৈতিক নেতা বা জনপ্রতিনিধি কোনো সম্প্রদায়, চলচ্চিত্র অভিনেতা বা প্রতিষ্ঠানকে হুমকি দিচ্ছেন। বলিউডের তারকা পরিচালক-প্রযোজক থেকে ওটিটি প্ল্যাটফর্মকে (যেমন আমাজন প্রাইম, নেটফ্লিক্স প্রভৃতি) নির্দিষ্ট সিনেমার সংলাপ বা গল্পের জন্য ‘হিন্দুদের ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া হয়েছে’ বলে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। হুমকি দেওয়া হচ্ছে প্রথম সারির শিল্পপতিদেরও। ভারতে অতীতে একই সামাজিক শ্রেণিভুক্ত মানুষেরা পরস্পরকে ব্যক্তিগত স্তরে আক্রমণ করেননি। এ কারণে কোনো প্রধানমন্ত্রীর ফাঁসি হয়নি, রাষ্ট্রকাঠামো ভেঙে পড়েনি, বিপ্লবও হয়নি। এই রাজনীতির জায়গা নিয়েছে এখন তীব্র অসহিষ্ণু, গোঁড়া মানসিকতাপূর্ণ রাজনীতি। এ কারণেই বলিউডের ওপর ধারাবাহিকভাবে চাপ সৃষ্টি করছেন একই অর্থনৈতিক বা সামাজিক শ্রেণিভুক্ত মানুষেরা।
(ক্রমশ...)
সৌজন্যে: প্র. আ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct