মানব উন্নয়ন চর্চায় স্বাস্থ্য একটি অন্যতম সূচক। দেশের মানব উন্নয়ন সমীক্ষা (২০০৪) অনুযায়ী রাজ্যেল মধ্যে মুর্শিদাবাদ জেলাটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং অর্থ দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এই জেলায় ভারতের দারিদ্র জনগণের ২% জনসংখ্যার বসবাস। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক অনুযায়ীও মুর্শিদাবাদের অবস্থান রাজ্যের মধ্যে শেষ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। তা নিয়ে ‘আপনজন’ পাঠকদের জন্য গবেষণালব্ধ এই নিবন্ধটি লিখেছেন গুজরাতের ইনস্টিটিউট অফ রুরাল ম্যানেজমেন্ট আনন্দ-এর রিসার্চ স্কলার মো. সাহিদুল ইসলাম ও প্রফুল্ল কুমার নাথ। আজ প্রথম কিস্তি।
স্বাস্থ্য মানব জীবনের একটি
অপরিহার্য দিক। মানব উন্নয়ন
চর্চায় তিনটি সূচকের মধ্যে স্বাস্থ্য একটি অন্যতম সূচক,বাকি দুটি হল আয়, এবং শিক্ষা। এই তিনটি সূচকের মধ্যেও একটা নিবিড় কার্য-কারণ সম্পর্ক দেখা যায় সামগ্রিক উন্নতির নিরিখে। স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির উভয় দিকের কার্যকারণ রয়েছে: স্বাস্থ্যকর ব্যক্তি এবং উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উভয় ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরেই ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে; এবং একইভাবে বৃহত্তর ব্যক্তিগত আয় এবং উচ্চতর জিডিপি (GDP) ব্যক্তিদের উন্নত পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যসেবা এবং সমাজকে তার নাগরিকদের উন্নত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো প্রদান করতে সহায়তা করে। অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে স্বাস্থ্য শুধুমাত্র উন্নয়নের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান নয়, বরং ব্যক্তিদের উন্নতমানের জীবন যাপনের ক্ষমতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক। উন্নয়ন-অধ্যয়ন (Development studies) সাহিত্যে স্পষ্টভাবে উল্লেখিত যে স্বাস্থ্য এবং দারিদ্রতা একে অপরের পরিপূরক। এই দৃষ্টান্ত একটি দারিদ্র পরিবারে স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যায়। এই মর্মে অর্থনীতিবিদ দেবরাজ রায়ের “লাইফ-বোট এথিক্স “ (life boat ethics) সূত্র ধরে আলোচনা করলে এটা আমাদের সামনে বেশি পরিষ্কার হয়ে যায়। এই সূত্রটি সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করলে, বলা যায় এমন একটি কঠিন পরিস্থিতি যেখানে অন্য কাউকে বাঁচাতে, একজন কে মৃত্য বরণ করতে হয়। অনুরূপ ভাবে যখন একটি দারিদ্র পরিবারের কোনো একজন সদস্য অসুস্থ্য হয়ে পড়ে তখন পরিস্থিতি অনেকটাই এরকমই হয়। কিন্তু বাস্তব জীবনে, প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সেই দারিদ্র পরিবার তাদের সাধ্য মতো সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দেয় এবং অনেক সময় চড়া সুদে ঋণ করতে বাধ্য হয়। অর্থ-ধার পাওয়াটা তাদের পক্ষ্যে খুব সহজসাধ্য হয়না কেননা ‘ওরা যে গরিব পরিশোধ করবে কি করে’? পরিণামে একটি দারিদ্র পরিবারের দারিদ্রতার গভীরতা এবং তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। আর্থ-সামাজিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া পরিবারগুলির অনেকেই কষ্ট -পীড়ন সহ্য করে নীরবে এমন কি মৃত্যুও ঘটে। তুলনামূলক ভাবে অগ্রসর পরিবার গুলির প্রাইভেট স্বাস্থ্য পরিষেবা উপলব্ধি করার ক্ষমতা থাকে কিন্তু দরিদ্র পরিবারগুলির ভরসা একমাত্র সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে থাকে। এই সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা যখন বিঘ্নিত হয় তখন তাদের কি পরিণাম ঘটে সেটা কল্পনাতীত। এরকম দৃষ্টান্ত প্রতিনিয়ত আমাদের রাজ্যের প্রায় সব জেলা গুলোতে বিশেষ করে মুর্শিদাবাদ জেলাতে স্পষ্ট।
মুর্শিদাবাদ জেলা ও স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো
আমাদের রাজ্যের জেলাগুলির মধ্যে মুর্শিদাবাদ চতুর্থ জনবহুল জেলা । মানব উন্নয়ন সমীক্ষা (২০০৪) অনুযায়ী এই জেলাটি স্বাস্থ্য, শিক্ষা , এবং অর্থ দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। এই জেলার মোট ২৬ টি ব্লক এর মধ্যে ২৩ টি ব্লক এখনো অনুন্নত রয়েছে। অর্থ - সামাজিক ভাবে পিছিয়ে পড়ার সাথে সাথে এই জেলাতে ভারতবর্ষের মোট দারিদ্র জনগণের ২% জনসংখ্যার বসবাস। বহুমাত্রিক দারিদ্র্য সূচক অনুযায়ীও মুর্শিদাবাদ জেলাটির অবস্থান পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত জেলার মধ্যে শেষ দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যেটি চরম বঞ্চনাকে নির্দেশ করছে। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (IFPRI) অনুযায়ী, পুষ্টি অর্জনের ক্ষেত্রে এই জেলাটি ভারতের ৫৯৯ টি জেলার মধ্যে ৪৭১ তম স্থানে রয়েছে। স্বাস্থ্য- পরিকাঠামোর দিক থেকেও এই জেলাটির গ্রামীণ এবং শহরের মধ্যে অনেক অন্তর দেখা যায় তথা পশ্চিমবঙ্গেও। পশ্চিমবঙ্গের মোট জনসংখ্যার মোটামুটি ৭০ শতাংশ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে কিন্তু রাজ্যের সমস্ত ‘হাসপাতাল-বেড’ এর মাত্র ১৪ শতাংশ বেড এর সুবিধা রয়েছে যেখানে শহরাঞ্চলে মোটামুটি ৩০ শতাংশ জনগণ বসবাস করে সেখানে ৮৫ শতাংশের বেশি বেড এর বন্দোবস্ত আছে। মুর্শিদাবাদ জেলাতে প্রতি বেড হিসাবে ৪১৯৭ জন গ্রামাঞ্চলে কিন্তু ২৬৮ জন শহরাঞ্চলে রয়েছে।
(ক্রমশ...)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct