হেডস্যার
হাবিবুর রহমান
__________
আজ সারাটা দিন মনের আকাশে ঝড় বয়ে গেল। বড় শোকের দিন। হেড স্যার, মীর হোসেন সাহেব, চলেই গেলেন, না ফেরার দেশে। কী দারুন পার্সোনালিটি !ফাঁকি দেবার উপায় ছিল না। ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসে ভয়ে কেউ তাঁর দিকে সোজাসুজি তাকাতে পারতোনা। অথচ, সেই মানুষ ভালো ছাত্রছাত্রীদের কাছে মাটির মানুষ। আর, গরীব মেধাবী, দুঃস্থ ছেলেমেয়ের মা-বাবা ছিলেন।
তিনি গঞ্জের হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। চৌহদ্দির মধ্যে একমাত্র নামী স্কুল। কত কত ছেলে মেয়ে।
এই স্কুলের প্রায় গোড়া থেকে তিনি দায়িত্বে ছিলেন। মাটির মেঝে, চাঁচের বেড়া আর টালির চাল। এই ছিল স্কুল। এখনকার মতন সরকারি সাহায্য পাওয়া যেত না। ছাত্র ছাত্রীর ফীর টাকায় স্কুল চলত, চেয়ে চিনতে স্কুল চলতো। বছরে এক দুবার নামকা ওয়াসতে গ্রান্ট আসত। তাতে কি স্কুল চলে !
মরহুম ফরহাদ সাহেব ছিলেন সভাপতি। দুজনে মিলে এই স্কুলের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তাঁদের কঠোর পরিশ্রমে আজ সে স্কুল এলাকার সব চেয়ে নামী স্কুল। পাঁচ হাজার স্টুডেন্ট এখন।
হেড স্যার কাজ আদায় করতে কাজী ছিলেন। কিন্তু, কাজ ফুরালে পাজী ছিলেন না ।
তার ভূরিভূরি প্রমান আছে। প্রমান আমি নিজে।
এক গরীব পরিবারে জন্ম। পড়া শোনায় ভালো ছিলুম। ১৯৬৫সালে ক্লাস ফাইভ। প্রাইমারি স্কুলের হেড স্যার একদিন মীরহোসেন সাহেবকে বললেন, স্যার, এই ছেলেটির মা-বাবার একে পড়াবার তাকৎ নেই, কিন্তু পড়াশোনায় এ এতো ভালো যে, আমি খুবই ইম্প্রেসড ছেলেটিকে নিয়ে। আপনি তো গরীবের মাবাবা। ছেলেটিকে একটু দেখুন না প্লিজ ।
মিরহোসেন স্যার মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক আছে।
বড় স্কুল, ততোথিক ছাত্রছাত্রী । কে কার খোঁজ রাখে!
বই কেনার তাকত নেই । পাশের বাড়ির একটা ছেলে আমার ক্লাসে পড়তো । তার অবসরে তার বই নিয়ে পড়তুম । ওপরওলা সহায়।অনতিবিলম্বে স্যারদের নজরে পড়লুম ।হেড স্যার একদিন ক্লাস নিলেন । তাঁর একটা প্রশ্নের উত্তর কেউ পারলোনা । আমি গড়গড় করে বলে দিলুম । বাহবা দিলেন ।
টিফিনে দপ্তরী আমাকে বলল, হেড স্যার ডাকছে তোমাকে।
ভয়ে সিটকে গেলুম, কী বিয়াদপি হলোরে বাবা।
দুরুদুরু বক্ষে ঢুকলুম স্যারের ঘরে। ক্লাসে দেখা স্যার, আর এই স্যার আকাশ পাতাল পার্থক্য !
বাড়ির খবর নিলেন। শেষে বললেন, বই সব কিনেছো?
চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।
স্যার আর একবার বলতে, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললুম।
স্যার বললেন, কাঁদছো কেন?আমি অন্য মাস্টারকে জিজ্ঞাসা করেছি, তোমার প্রিপারেশন তো খুব ভালো। বই ছাড়া এটা হয় কী করে?
ভয়ে ভয়ে সত্যিটা কবুল করলুম।
স্যার তাজ্জব হলেন, এতো তোমার পড়ার এনার্জি? আর এতো পরিশ্রম কর তুমি?
আমি নীরব।
হাঁক পাড়লেন, লাইব্রিয়ান?
দৌড়োতে দৌড়োতে মোজামদা ঢুকলে, স্যার কিছু বলছেন?
হেডস্যার গম্ভীর গলায় বললেন, একে বুক লিস্ট ধরে সব বই এখনি ফ্রীতে দিয়ে দাও।
আর আমাকে বললেন, পড়ে যাও, কোন অসুবিধা হলে আমার কাছে আসবে। ভয় পেওনা।
এই আমার হেডস্যার !
হাফ ইয়ার্লিতে সবাইকে টপকে অনেক বেশী নব্বর পেলুম।
দাপ্তরির ডাক, গেলুম স্যারের রুমে। পিঠ চাপড়ে বাহবা দিলেন।
আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি।
প্রতি বছর ক্লাসে হেড স্যার এসে ক্রম অনুযায়ী পাশ করা ছাত্রছাত্রীর নাম ধরে ডাকতেন। ক্লাসের বাইরে গার্জেনদের ভিড়। মেলা লাগতো।
সেদিনটা আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন হতো।
প্রথম নামটা আমারি থাকতো। গর্বে আমার বুক ভরে যেত। স্যারও খুশি হতেন।
ক্লাস এইট। একটা মেয়ের ওপর ক্লাসের কোন দুষ্ট ছেলে কুমন্তব্য করে। মেয়েটি হেড স্যারের কাছে রিপোর্ট করে।
কঞ্চির বেত নিয়ে স্যার আমাদের ক্লাসে এলেন। গম্ভীর স্বরে বলেন, আমাদের স্কুলে এরকম শিক্ষা আমরা স্টুডেন্টকে দিই না।
যে করেছো বলে ফেলো, ক্ষমা পাবে?
সবাই চুপ। স্যার আমাকে বললেন, আমি শুনেছি তুমি ছিলে সেসময় ক্লাসে, তুমি বল, কে সে?
আমি কাঁচুমাচু হয়ে উঠে দাঁড়ালাম।
স্যার বেত নাড়িয়ে বললে, চুপ কেন? মুখ খোল, তুমি তো শুনেছ কে বলেছে?
ভয়ে আমি দাঁড়িয়ে, স্যারের ধৈয্যের বাঁধ ভাঙলো। কাছে ডেকে সপাসপ আমার পিঠে বেত মারলেন। সবাই হতচকিত ।
মেয়েটা কেঁদে ভাসালে, স্যার,ফাস্ট বয়ের কোন দোষ নেই।
স্যার তাকে ধমকে বসিয়ে দিলেন।
মুখে বললেন, অন্যায় যে করে, আর অন্যায় যে সয় -এক দোষে দোষী।
গটগট করে বেরিয়ে গেলেন, দপ্তরি এসে আমাকে স্যারের রুমে নিয়ে গেলেন। স্যার নিজের হাতে ফাস্ট এইড দিলেন। গায়ে মাথায় হাত বোলালেন। অনেকক্ষণ বসিয়ে রাখলেন। নিজের জীবনের গল্প বললেন,জানো তোমার মতন আমিও গরীব ঘরের সন্তান। অল্পবয়সে পিতৃহীন। দাদরা পড়িয়ে মানুষ করেছে। আজকের তোমার হেডস্যার, একদিন তোমারি মতন ছিল। আমি চাই তুমি আমার মতন হবে। কাঁদলাম। সান্ত্বনা দিলেন।
পরে জেনেছিলাম পুরো পরিবারের দেখভাল তিনি করতেন। একটা পাজামা , ঢোলা শার্ট, আর বুট জুতো -এই তাঁর পোশাক। দশ মাইল রাস্তা ঝরঝরে সাইকেলে আসতেন। আর একদম সাদা সিধে জীবন। ছেলে বেলা থেকে দিনে পাঁচ বার নামাজ পড়তেন। ফিট ফর্সা, আর তেমনি তাগড়া চেহারা। আমার মত কত কত ছেলেমেয়েকে সাহায্য করেছেন তার ইয়োত্তা নেই। ব্যক্তিত্ব আছে, কিন্তু, কোন দেমাগ অহংকার নেই। ডান হাতের সাহায্য বাম হাতকে জানতে দিতেন না।
তখন ক্লাস টেনে পড়ি। স্কুলে ফাংশন। গণ্যমান্যরা আসবে। একটা মাত্র পায়খানা। অপরিষ্কার। সবাই প্রায় চলে গেছে। আমিও আসছি। স্যার আমাকে ডাকলেন, আরে খোকা, সবাই তো চলে গেছে। কাল সকালে ফাংশন। পায়খানাটা নোংরা,চল দুজনে পরিষ্কার করি।
আমি বিগলিত, স্যার, আপনি কেন, আমি থাকতে।
স্যার হাসলেন, কোন কাজ ছোট নয়, চল দুজনে হাত লাগাই।শুনলেন না। জামা জুতো খুলে জোর করে সঙ্গে গেলেন। ওতো বড় পোস্ট। কোন ঘেন্না নেই, কোন আক্ষেপ নেই।
আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হল।
এই আমার হেডস্যার !
কাল চরকিঘরা ঘুরছে। পুলিশে ঢুকলাম। দেখাসাক্ষাৎ আর হয় না।
বনগাঁ বর্ডারে পাসপোর্ট অফিসার। আমার স্যার পাসপোর্টএ বাংলাদেশ যাবেন।
আমার করণীয় করলু।
ফিরে এসে চেনাজানা সবাইকে ডেকে ডেকে বলেছে, আমার ছাত্র হবি (আমার ডাক নাম ) কত খাতির করেছে, কতআদর যত্ন করেছে জানো ? প্রাণ ভরে গেছে তার ক্ষমতা দেখে। লোক মুখে শুনে আমার বুক ভরে গেল। অবসরের পর বেশ সুস্থ্য ছিলেন। চাকরি পুলিশের দেখা সাক্ষাৎ হয় না। আমিও অবসরে।
আজ খবর পেলুম - আমার হেডস্যার আর নেই, গেলুম। দেখে বুক ফেটে গেল। ওতো বড় মানুষটা যেন ঘুমিয়ে আছেন। সেই নির্মোহমুখ, সেই পবিত্র চেহারা, সেকি ভোলা যায় !
ঐ স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষক আমার সঙ্গে। সেই পুরোনো কালের টালির ঘর, আর মাটির দাবা। একটুও পরিবর্তন হয়নি।
চোখে জল এল।
বর্তমান প্রধান শিক্ষক বললেন, লোকটা সারাটা জীবন পরিবার আত্মীয় বর্গকে টেনেছেন। নিজের দিকে তাকাননি।
জানাজায় (মৃতের শেষ নামাজ ) কত কত মানুষের ঢল।
কবরে মাটি দিলুম, কান্না আটকানো গেলনা, গলা বুজে এল, মনে মনে বললুম, হে আসমান জমিনের মালিক। জগতে যে লোক সারাটা জীবন শুধু দিয়েই গেলেন, দিয়েই গেলেন, তাঁর নশ্বর দেহকে তুমি তোমার শান্তিকুঞ্জে ঠাঁই দিও প্রভু ঠাঁই দিও।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct