সোনা বন্দ্যোপাধ্যায়: সংবাদপত্র খুললে মাঝে মাঝেই দীর্ঘদিন জেলে বন্দি থাকার খবর চোখে পড়ে। অনেকেরই ধারণা যে, একজন কিশোর, যুবক অথবা বয়স্ক মানুষ অনেক দিন জেলে বন্দি ছিলেন মানেই তিনি নিশ্চয় কোনও অপরাধ করেছিলেন, না হলে পুলিস কেন শুধু শুধু তাঁকে ধরে জেলে ভরবে ? সমাজের বেশি ভাগ সাধারণ মানুষের আইন,ফৌজদারি মামলা ( ক্রিমিনাল কেস), কারাগার ইত্যাদি নিয়ে খুব গভীর ধারণা থাকে না। তাই, তাঁদের এই ধারণা হতেই পারে। কিন্তু তাঁদের এই বদ্ধমূল ধারণা কি আদৌ ঠিক ?
১৪ বছরের কিশোর ‘ মাসুদ ’মাথায় একটা ঝুড়ি নিয়ে ঘুরে ঘুরে লোকের বাড়ি থেকে কাঁচ-ভাঙা,বাতিল শিশি, বোতল পুরোনো,বই,,খাতা, খবর কাগজ ইত্যাদি বাতিল হওয়া জিনিস কিনে, সেগুলো পুরোনো মালের গোলায় বিক্রি করে। এতে লাভ সামান্যই থাকে। এটাই ওর পেশা।ওর বাবা মাল টানা ভ্যান চালায়, মা লোকের বাড়ি ঝি-এর কাজ করে দেয়। অত্যন্ত দরিদ্র এই পরিবার। প্রায় ২-৩ মাস জেলে বন্দি থাকার পর, ছাড়া পেয়ে আবার ওই কাজে তাকে বেরোতে দেখে শিক্ষিত, অশিক্ষিত মিলিয়ে বহু মানুষই বলেছে, “ ব্যাটা নিশ্চয় চুরি অথবা অন্য কোনও অপরাধ করেছিল যার জন্য ধরা পড়ে এতদিন জেলে ছিল”?
মানুষের এই ধারণা যে কত অবাস্তব, সেটা কোনও এক শুনশান রেল ষ্টেশনের বেঞ্চে বসা দুই বৃদ্ধের কথোপকথনে টের পাওয়া যায়। কথায় বোঝা গেল যে, আলাপরত দুই বৃদ্ধের একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার। তিনি বলছিলেন, “ অবসর জীবন যে এতটা কষ্টের হবে, ভাবতে পারিনি। বড় ছেলেটা আত্মহত্যা করল। ছোট ছেলেটার বয়স ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও কিছুই করে না, সারাদিন মদ খেয়ে বেসামাল হয়ে থাকে,বাড়ি এসে নোংরা গালমন্দ করে, পাড়ায় ওর বিরুদ্ধে হাজার বদনাম । আর মরার আগে এমন সুইসাইড নোট লিখে রেখে গেছে, যাতে কোনও মামলায় না জড়ালেও লোকে আমাকে ছিঃ ছিঃ করে।এরপর আমার স্ত্রীর শরীরের নীচের অঙ্গ পক্ষাঘাতে পুরোপুরি পঙ্গু। আজ দু’ বছরের ওপর বিছানায় সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী, আর এসব যন্ত্রণার ভার যেন নিতে পারছি না”। এক মুহূর্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি আবার শুরু করলেন,” আর আমার এই রকম হবে না’ই বা কেন ? পুলিশের চাকরি করার সময় ভালো কাজ দেখাতে গিয়ে , একাধিক কমজোর আর গরিব ছোট ছেলেকে বিনা দোষে ধরে নিয়ে গিয়ে মিথ্যা কেস দিয়ে ফাঁসিয়ে জেলে ভরেছি। এদের জীবনের অনেক ক্ষতি হয়েছে , অনেকের জীবন নষ্টই হয়ে গিয়েছে। এদের কেউ পুরনো মাল ফেরী করত,কেউ হোটেল বা চায়ের দোকানে কাজ করত, কেউ মজূরের কাজ করে খেত অথবা কিছু না করলেও হত দরিদ্র পরিবারের ছেলে। কারুর আবার বাবা, মা যে কোনও একজন নেই, কেউ পুরোপুরীই অনাথ। মোটের ওপর পাল্টা লড়াই করার মত জোর কারুরই ছিল না”।
এই একই রকম অভিজ্ঞতা আমার আরেকটি আছে।আমি তখন ছোট, বাবার এক পূলিশ অফিসার বন্ধু,বাবাকে তাঁর চাকরি জীবনের কথা প্রসঙ্গে বলছিলেন, “একবার কোনও এক পাড়ায় পর পর চুরি হচ্ছিল। ফলে পুরো এলাকার মানুষ যথেষ্ট উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। সবারই ক্ষোভ পুলিশের বিরুদ্ধে, তাদের বক্তব্য যে, এতগুলো চুরি হয়ে গেল কিন্তু পুলিস কাউকে ধরতে পারল না। কেউ কেউ বলতে লাগল যে, পুলিস ইচ্ছে করে ওদের ধরছে না, চোরদের সাথে পুলিশের যোগ আছে, পুলিসরা তো চুরির টাকার ভাগ পায়। জনগণের উত্তেজনা প্রশমন করার জন্য একটা পুরনো মাল ফেরী করা ছেলে আর একটা সব্জি বাজার ঝাঁট দেওয়ার ছেলেকে ধরে হাজতে ভরলাম। ধরা পড়ার খবর প্রচার হতেই ওই এলাকার উত্তেজনা পুরোপুরি ঠাণ্ডা হয়ে গেল। চাকরি ক্ষেত্রে এক এক সময় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, এই রকম করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। এটা শুধু আমি নয়, আমার পেশায় অনেকেই করতে বাধ্য হয়”।
এখানে আমরা একটা শুনশান রেল ষ্টেশনে আলাপরত এবং আমার বাবার বন্ধু পুলিস অফিসারের কথা জানতে পারলাম কিন্তু ওই দু’ জনই তো সব নন, অন্য পুলিস অফিসারদের দ্বারাও এই রকম ঘটনা অনেক হয়, যেটা তাঁদের কথাতেই বোঝা যায়। তাছাড়া, এখানে আক্ষেপ করা পুলিস ভদ্রলোকের মত ভাগ্যের হাতে এইভাবে মারও সবাই খান না। ফলে তাঁদের কৃত কর্মের অনুশোচনার কথাও মানুষের গোচরে আসে না।
মনে পড়ল প্রখ্যাত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী-র কথা। সাহিত্যিক হিসাবে যথার্থ স্বীকৃত এবং পুরস্কৃত হবার পর একটি সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে তিনি তাঁর নিজের জেল জীবনের কথা মানুষকে জানিয়েছিলেন।কিশোর বয়সে তিনি যখন চায়ের দোকান , হোটেল ইত্যাদি জায়গায় কাজ করতেন, সেই সময় তাঁকে ধরে পুলিশ জেলে পাঠিয়েছিল।এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে, কাজ দেখাবার জন্য পুলিশ তাঁর মত কিছু কমজোর, দরিদ্র, অসহায় কিশোরদের ধরে কোনও মিথ্যা কেস দিয়ে জেলে পুরে দেয়। এটা এই সমাজের অতি বড় বাস্তব ছবি।
অতএব, কোনও ছোট ছেলে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে ছিল মানেই সে অপরাধ করেছে , এই ধারণা ঠিক নয়।শুধু ছোট ছেলেই নয়, অনেক সময় যুবক এবং বয়স্ক মানুষকেও বিনা দোষে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে জেলে যেতে হয়। সংবাদপত্রে এটাও দেখা যায় যে, দীর্ঘ কয়েক মাস বা বছর জেলে বন্দি থাকার পর বেকসুর খালাস। সাধারণ কারাগার ছাড়াও অনেক সময় ছোট ছেলে এবং বয়স্ক মানুষকে পাগল সাজিয়ে পাগলা গারদেও ভরে দেওয়া হয়।পাগলা গারদে পাঠানো হতভাগ্য মানুষটি সম্পর্কে লোকে বলে , “ নিশ্চয় ওর মাথায় কোনও গণ্ডগোল আছে, নয়ত কেন তাকে পাগলা গারদে দেওয়া হবে ‘? এইসব ঘটনাগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক দলের কোনও সম্পর্ক নেই। শাসন যন্ত্রের মাথায় এক দল আসে, আগের দল চলে যায়। কিন্তু এই কর্মধারা চলতেই থাকে।অভাগাদের চোখের জলে জেলখানার মাটি ভিজে যায় , সেটা ক’জনের অন্তর স্পর্শ করে ? কবে হবে এর অবসান ?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক ও সমাজবিদ)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct