দিলীপ মজুমদার: ‘নেকেড কিং’ গল্পটি আপনারা অনেকে পড়িয়াছেন। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘উলঙ্গ রাজা’ কবিতাও আপনারা পড়িয়াছেন নিশ্চয়। রাজার পরনে এক চিলতে কাপড় নাই , অথচ তাঁহাকে ন্যাংটা বলিবার সাধ্য কাহারও নাই , কারণ বলিলেই গর্দান যাইবে। ভারতের বর্তমান অধীশ্বর মহাশয়কে কোন কোন নিন্দুক ‘ন্যাটা রাজা’ বলিয়া সম্বোধন করিতেছেন। ইহা অতীব পরিতাপের বিযয়। যিনি নিত্য-নব পরিচ্ছদে দৃশ্যমান হন, তাঁহাকে উলঙ্গ বলা প্রলাপমাত্র। তবে কি না ‘উলঙ্গ’ শব্দটির রূপকার্থ ধরিলে অন্য কথা।
কিন্তু সে সবও উড়াইয়া দিতে পারে তাঁহার প্রচারযন্ত্র। তাহা বড় শক্তিশালী যন্ত্র। সেই যন্ত্রের মায়ায় কুকুর ছাগল হইয়া যায়। তুমি যদি দেখিতে না পাও, তাহা তোমার দোষ। এই ভাবে তুমি নোটবন্দির সুফল দেখিতে পাও নাই , ভারত যে স্বচ্ছ হইয়াছে তাহা তোমার চোখে পড়ে না, আসলে তোমার মধ্যে যথেষ্ট জাতীয়তার বোধ নাই , দেশপ্রেম তো নাইই নাই। কথায় কথায় তুমি আন্দোলনের হুমকি দাও। তাই তো সংসদে ভারতের অধীশ্বর তোমাদিগকে ‘আন্দোলনজীবী’ আখ্যা দিয়াছেন। শব্দটি অভিধানে অভিনব। কৃষিজীবী, আইনজীবী, শিক্ষাজীবী এ সব শুনিয়াছি। আন্দোলনজীবী শব্দ শুনি নাই। বক্রোক্তির এমন জীবন্ত ব্যবহার ভারতের আলংকারিকগণেরও চিন্তার অতীত ছিল। ভারতেশ্বর মোদী মহাশয়ের প্রতিভার অন্ত্য নাই। নিত্য-নতুন শব্দ উদ্ভাবন করিয়া তিনি অভিধানকে ক্রমাগতভাবে সমৃদ্ধ করিয়া যাইতেছেন। আন্দোলনের মাধ্যমে যাঁহারা জীবিকা নির্বাহ করেন তাঁহারাই আন্দোলনজীবী। এ দেশের সমস্ত বিরোধীরাই আন্দোলনজীবী। নিত্য-নবীন সৃষ্টিমূলক কাজে তাঁহাদের উৎসাহ নাই , উৎসাহ কেবল শাসকের ছিদ্রান্বেষণে। তাই তাঁহারা আন্দোলনজীবী। দিল্লির সীমান্তে যে কৃষকরা বৎসরাধিককাল ঘাঁটি গাড়িয়া বসিয়া আন্দোলন করিতেছিল , ৭১৪ জনের অপঘাতে মৃত্যুর পরেও যাহারা দমে নাই, তাহাদের সম্পর্কে স্বাভাবিকভাবে বীতরাগ ছিল মোদী মহাশয়ের। তিনি বুঝিয়াছিলেন এই সব আন্দোলনজীবীরা চাঁদের বুকে কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করিতেছেন। তাহাদের মূল দাবি ছিল বলপূর্বক চাপাইয়া দেওয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার , ফসলের এম এস পি অর্থাৎ ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা। কৃষকদের আন্দোলনের ৩৮০ দিন পরে ভারতেশ্বর কৃষি আইন প্রত্যাহার করিয়া লইলেন। কৃষকদের সহিত বিরোধীরা ভাবিল বিরাট জয় হইয়াছে। কিন্তু সংসদে ভারতেশ্বর বলিয়া দিলেন যে কৃষকদের ক্ষুদ্র একটি অংশ এই আইনের সুফল বুঝিতে পারিতেছে না, তাই প্রত্যাহার। তার মানে প্রকারান্তরে তিনি বলিয়া দিলেন যে তাঁহার আইনটি আখেরে সুফলপ্রসবিনী। যেমন সব কিছুর বেসরকারীকরণ পরে-পশ্চাতে সুফল প্রসব করিবে। বিরোধীরা ইহার জন্য তারস্বরে চিৎকার করিতেছেন। বলিতেছেন, এই সরকার সব কিছু বেচিতে বেচিতে শেষে দেশটাকেও বেচিয়া দিবেন। উহারা অধম , তাই বলিয়া আমি উত্তম না হইব কেন ?
কিন্তু গোল বাধিয়াছে প্যারিস স্কুল অব ইকনমিকস-এ অবস্থিত ওয়ার্ল্ড ইনইকুয়ালিটি ল্যাবের একটি রিপোর্ট। সম্প্রতি সে রিপোর্ট প্রকাশ পাইয়াছে। কি বলা হইয়াছে সেখানে ? বলা হইয়াছে : ভারতে দারিদ্য আছে , আর আছে তীব্র অসাম্য। ‘দেশের নীচের সারির অর্ধেক মানুষের হাতে দেশের সম্পদের প্রায় কিছুই নাই। ধনীরা আরও ধনী হইতেছে. গরিব আরও গরিব হইতেছে। এই বৎসর (২০২১) দেশের আয়ের মোট পাঁচভাগের এক ভাগ গিয়াছে সৌভাগ্যবান মাত্র ১% এর হাতে। তাহাদের আঙুল ফুলিয়া কলাগাছ হইয়াছে। নিচু তলার ৫০% মানুষকে দেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩% নিয়েই চুপ করিয়া থাকিতে হইয়াছে।’
অবশ্য এই রিপোর্টকে গ্রাহ্য করিবার দায় ভারত সরকারের নাই। অনতিবিলম্ব তাঁহারা প্রচারে নামিয়া পড়িবেন। বলিবেন, ইহার পশ্চাতে চক্রান্ত আছে ; ভারতকে অপদস্ত করিতে চান তাঁহারা। হাঁড়ি ফাটিল তো কি হইল , ফাটা হাঁড়িকে তালি দিয়া নতুন করিয়া দিব। যেমন পোশাক না পরিয়াও আমি উলঙ্গ নহি , তদ্রূপ তালিমারা ফাঁটা হাঁড়িকে ফাটা বলিবার সাধ্য কাহারও হইবে না। প্রচারে কি না হয়!
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct