নারীদের প্রতি সম্মানজনক ভরসা না থাকলেও বিজেপি মমতার বিকল্প নেত্রীর সন্ধানে ছিলেন। রূপা গাঙ্গুলী, লকেট চ্যাটার্জীকে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সার্থকতার ধারে-কাছে পৌঁছাতে পারেননি রূপা অথবা লকেট। এখন তো রূপা গাঙ্গুলি অনেকটা দূরে সরে গেছেন, লকেট তো ভবানীপুরে প্রচারেই এলেন না। বিজেপি টক্কর দিতে যে প্রিয়াঙ্কা টিব্রেওয়ালকে এগিয়ে দিয়েছিল, তিনি তাঁর চলনে-বলনে মমতার মতো ‘অগ্নিকন্যা’ হবার অভিনয় করলেও মমতার বিকল্প হওয়া স্বপ্নই থেকে গেছে। এ নিয়ে লিখেছেন দিলীপ মজুমদার। আজ শেষ কিস্তি।
সেই সহজিয়া ভাবটি দেখা যায় তাঁর পোশাক-পরিচ্ছদে। সরু পাড়, হালকা রঙের শাড়ি, পায়ে হাওয়াই চপ্পল। হাতে রুমাল নেই, শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে নেন। কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ। পোশাক পরিচ্ছদে তিনি কী সচেতনভাবে গাঁধিজিকে অনুসরণ করেন ? হতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে ফিরে গাঁধিজি আর কোট-প্যান্ট পরেন নি, কারণ তা পরলে ভারতের সাধারণ মানুষের মনের ভেতর প্রবেশ করতে পারতেন না। তাঁর হাওয়াই চটি নিয়ে বিরোধীরা ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি, কারণ তাঁরা এই প্রতীকের রহস্যভেদ করতে পারেন নি। দেবাংশু সেই প্রতীকটি ধরে লিখেছিলেন চমৎকার স্লোগান : ‘দিল্লি যাবে হাওয়াই চটি’। পোশাকের মতো আহারেও দেশজ প্রীতি। ঘরেভাজা মুড়ির প্রতি আসক্তি।
অসাধারণ তাঁর স্মৃতিশক্তি। রাস্তার নাম, ব্লক বা থানার নাম, ব্যক্তির নাম, নানা পরিসংখ্যান বলে যান অবলীলাক্রমে। যাকে বলে হাতের তালুর মতো চেনা। শুধু মন্ত্রী, বিধায়ক, পৌরপিতা নন, বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ কর্মীকেও ব্যক্তিগতভাবে চেনেন তিনি, চেনেন বিভিন্ন আধিকারিক ও পুলিশকর্মীকে। এরপরে আসে তাঁর বক্তৃতার কথা।
সেখানেও তিনি নতুন এক ঘরানা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সে তো শুধু বক্তৃতা নয়, সে যে আলাপ, শ্রোতার সঙ্গে কথোপকথন, ডাইনে-বাঁয়ে ঘোরা, শাড়ির আঁচল মুখে বুলিয়ে নেওয়া। এভাবে তাঁর বক্তৃতার বিষয় শরীরী হয়, জনতার মন স্পর্শ করে যায়।
সাহস কিংবা দুঃসাহসেও মমতা অনন্যসাধারণ। হঠাৎ বড় বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। মন্ত্রিত্ব ত্যাগ, কংগ্রেসের সঙ্গে সংস্রব ত্যাগ, সিপিএমের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াই এ সব তার উদাহরণ। একদিন তিনি সিপিএমের মতো ক্যাডারভিত্তিক, শৃঙ্খলাপরায়ণ, ৩৪ বছরের ক্ষমতার অধিকারী সিপিএমের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন। সহ্য করতে হয়েছে অপরিসীম বিদ্রূপ, আক্রমণ, চরিত্রহননের কালিমালিপ্ত অভিযান। আর সাম্প্রতিককালে সেদিনের মতো প্রায় এককভাবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী, ক্যাডারভিত্তিক বিজেপির বিরুদ্ধে শুরু করেছেন জেহাদ। ‘এককভাবে’ , কারণ ভারতবর্ষের অন্য কোন দলকে দাঁতে দাঁত চেপে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করতে দেখিনি আমরা। সিপিএমের ‘বিজেমূল’ তত্ত্ব যে বালসুলভ চাপল্য সে কথা প্রমাণিত হয়েছে গত নির্বাচনে মোদী-শাহের রণংদেহি প্রচারে, প্রমাণিত হয়েছে এবারের উপনির্বাচনেও। ‘সর্বভারতীয় দল’ কংগ্রেসের গোঁসা হতে পারে, কিন্তু এই মুহুর্তে ‘বিজেপি বিরোধী মুখ’ যে মমতা, সে কথা নিরপেক্ষ বিশ্লেষককে স্বীকার করতে হবে। দুঃসাহসের জন্য অনেক মূল্য দিতে হয়েছে মমতাকে, আবার এর জন্য তিনি লাভ করেছেন বরমাল্য। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা দুঃসাহসের সৃষ্টি। মমতার মতো চলিষ্ণুতা অন্য কোন নেতার মধ্যে আমরা দেখতে পাই না। পথপরিক্রমায় ক্লান্তিহীন তিনি। সকালে বারাসত, দুপুরে জঙ্গীপুর, রাতে দিল্লি। এই দলীয় কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা, এই বোলপুরের জনসভা, এই রাজ্যপালের কাছে অভিযান। অবিরাম পথপরিক্রমায় নারীর কিছু ব্যক্তিগত বাধা থাকে, কিন্তু মমতা সে সব বাধা গ্রাহ্য করেন নি। এই চলমানতার মধ্যে প্রকাশ পায় তাঁর দুর্বার প্রাণশক্তি। এই প্রাণশক্তি উদ্বেগ নিরোধক। তাই মমতাকে ভুগতে হয় না চিন্তাজ্বরে। চিন্তাজ্বর থাকে না বলে তাঁর শরীর সর্বদা ‘ফিট’। এই যাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, তাঁর বিকল্প কোথায় ? মমতা একক। মমতা স্বভাবত স্বতন্ত্র। এমন কি তাঁর দলের মধ্যেও। (সমাপ্ত)
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct