ফৈয়াজ আহমেদ: জেলিফিশ সামুদ্রিক প্রাণী হলেও আদতে কিন্তু তারা মাছ নয়। কিন্তু জাপানীরা এটি বেশ মজা করেই খায়। ওরা মূলত নিডারিয়া পর্বের অমেরুদণ্ডী এক প্রাণী, যাদেরকে বিজ্ঞানীরা ‘গেলাটিনাস জুপ্লাংক্টন’ বলে অভিহিত করেছেন। গেলাটিনাস জুপ্লাংক্টনেরা হলো সরল সামুদ্রিক প্রাণী যাদের শরীরে জটিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অনুপস্থিত।
বিজ্ঞানীদের ধারণানুযায়ী, পৃথিবীতে জেলিফিশের আবির্ভাব ঘটে আজ থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্বে। সেই হিসেবে জেলিফিশ দানবাকৃতির ডাইনোসর থেকেও প্রবীণ। শরীরে কোনো হাড় বা মাংস না থাকায় এদের জীবাশ্ম খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। তবে ২০০৭ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ রাজ্যে ৫০০ মিলিয়ন বছর পূর্বের জেলিফিশের জীবাশ্মের সন্ধান মিলেছিল।
কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, জেলিফিশ প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও এদের কোনো মস্তিষ্ক থাকে না। তাদের জটিল স্নায়ুতন্ত্র মস্তিষ্ক ছাড়াই সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
শুধু মস্তিষ্কই নয়; হৃৎপিণ্ড, ফুসফুসের মতো অতি-গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলোও জেলিফিশে অনুপস্থিত। এদের শরীরের চামড়া অত্যধিক পাতলা ফলে এরা চামড়া দিয়ে কোনো ঝামেলা ছাড়াই সমুদ্র থেকে অক্সিজেন শোষণ করতে পারে। ওদের শরীরে কোনো রক্ত নেই, সেক্ষেত্রে রক্ত পাম্প করার জন্য হৃৎপিণ্ডও নিষ্প্রয়োজন। আর তারা চারপাশের উদ্দীপনায় সাড়া প্রদান করে তাদের এপিডার্মিসের নিচে থাকা নার্ভ নেটের মাধ্যমে। এটি খুবই সংবেদনশীল বলে উদ্দীপনায় সাড়া প্রদানের মতো জটিল প্রক্রিয়ায় মস্তিষ্কের কোনো দরকার পড়ে না।
দলবেঁধে চলাচলের বৈশিষ্ট্য এদের মধ্যে অধিক লক্ষ্যণীয়। একটা দলে সাধারণত একই বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন জেলিফিশ উপস্থিত থাকে। একসাথে জেলিফিশ দলবেঁধে চললে এদেরকে ইংরেজিতে ব্লুম, সোয়ার্ম, বা স্ম্যাক বলে ডাকা হয়।
জেলিফিশের শরীরে জলের পরিমাণ প্রায় ৯৫ শতাংশ। সম্পূর্ণ শরীরের প্রোটিন এবং স্নায়ুতন্ত্র মাত্র ৫% জায়গা দখল করে থাকে। বাকি ৯৫% দখল করে রাখে জল। সেজন্য সমুদ্রতটে কোনো জেলিফিশ উঠে আসলে তার শরীর থেকে সম্পূর্ণ জল উবে যায়, ফলে সেটাকে একপ্রকার অদৃশ্য মনে হয়।
পেলাগিয়া নকটিলুকা জেলিফিশেরা নিজেদের শরীরে আলো উৎপন্ন করতে সক্ষম। জীববিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাকে বলা হয় ‘বায়োলুমিনোসেন্স’। এর ফলে তাদের সৌন্দর্য বেড়ে উঠে কয়েকগুণ। জেলিফিশ আলো ছড়ালে সমুদ্রকে অপার্থিব এক সৌন্দর্য আচ্ছন্ন করে ফেলে।
‘মস্তিষ্ক নেই, অথচ জেলিফিশ ঘুমাতে পারে’ ব্যাপারটা কেমন অদ্ভুত ঠেকছে না? ক্যাসিওপিয়া নামের জেলিফিশেরা রাতের সময়টা ঘুমিয়ে কাটায়।
শরীরের গঠন অত্যন্ত সরল হলেও, কিছু জেলিফিশের দেখার জন্য দর্শনেন্দ্রিয়ও উপস্থিত। কিছু কিছু প্রজাতির ক্ষেত্রে সেই দর্শন শক্তি অধিকতর জটিল প্রকৃতির। উদাহরণস্বরূপ, বক্স জেলিফিশের চোখের সংখ্যা মোট ২৪টি, যার মধ্যে দুটি চোখ রঙ যাচাই করতে পারে। এটাও ধারণা করা হয়, জেলিফিশের কমপ্লেক্স ভিজুয়্যাল সেন্সর তাকে এমন ক্ষমতা দান করেছে যে সে ৩৬০° কোণে দেখতে সক্ষম।
Turritopsis nutricula প্রজাতির জেলিফিশ জৈবিকভাবে এরা প্রায় অমর। ১৮৮০ এর দশকে প্রথম আবিষ্কার হলেও, বিজ্ঞানীরা এদের অমরত্বের গোপন তথ্য জানতে পারেন এর প্রায় একশ’ বছর পর, ১৯৯০ এর দশকে। এরা এদের জীবনচক্রের প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় বা যৌন দশায় পৌঁছানোর পর বিশেষ কিছু উদ্দীপনায় প্রভাবিত হয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক বা অযৌন দশায় ফিরে যেতে পারে। সেলুলার ট্রান্সডিফারেন্সিয়েশন নামক এক পদ্ধতির মাধ্যমে তারা তাদের পুরাতন কোষকে ঝকঝকে নতুন কোষে পরিবর্তন করে ফেলতে পারে।
জেলিফিশ খাদ্যগ্রহণ ও মলত্যাগের জন্য একই পথ ব্যবহার করে। তাদের দেহাভ্যন্তরে সিলেন্টেরন নামক একমাত্র পরিপাক সংবহন গহ্বর থাকে, যা একটি ছিদ্রপথে বাইরে উন্মুক্ত। এই ছিদ্রটি মুখ ও পায়ুর কাজ করে। এই ছিদ্রপথে খাদ্য গৃহীত এবং অপাচ্য অংশ বহিষ্কৃত হয়। হাইড্রাসহ নিডারিয়া পর্বের প্রায় সকল প্রাণীতেই এই বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান।
জেলিফিশে নেমাটোসিস্ট ধারণকারী নিডোসাইট নামক বিশেষ ধরনের কোষ উপস্থিত। এগুলো সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় জেলিফিশের কর্ষিকাগুলোতে। এই নেমাটোসিস্টই হচ্ছে তাদের দংশন অঙ্গাণু। নেমাটোসিস্টের গহ্বরটি হিপনোটক্সিন নামক বিষাক্ত রসে পরিপূর্ণ থাকে। এছাড়াও এর সাহায্যে তারা আত্মরক্ষা, খাদ্য গ্রহণ ও দেহ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ চালিয়ে নেয়। শিকার ধরার পূর্বে এরা এদের তীক্ষ্ণ কাঁটার মতো বার্ব শিকারের শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেয়। তারপর শিকার মারা গেলে সেটি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে।
জেলিফিশকে দেখতে সমুদ্র-সুন্দরী মনে হলেও বক্স জেলিফিশেরা মারাত্মক রকমের বিষাক্ত। সে এক কামড়ে কিছু সময়ের মধ্যেই একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষকে মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সক্ষম। একেকটা বক্স জেলিফিশ যে পরিমাণ বিষ শরীরে ধারণ করে, তা দিয়ে ৬০ জন মানুষকে অনায়াসেই মেরে ফেলা যাবে। কারণ, এদের বিষ সরাসরি হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করে দেয়।
কিছু জেলিফিশ এতটাই ক্ষুদ্র যে, খালি চোখে তাদের দেখা পাওয়াটাই দায়! যেমন, Staurocladia এবং Eleutheria গণের জেলিফিশের আকার মাত্র ০.৫ মিলিমিটার। অপরদিকে লায়ন্স ম্যাইন জেলিফিশ হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ প্রজাতির জেলিফিশ। তারা তাদের একেকটা কর্ষিকা প্রায় ৩৭ মিটার (১২০ ফুট) পর্যন্ত লম্বা করতে পারে, যা পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহদাকৃতির স্তন্যপায়ী তিমির চেয়েও বড়! এই জেলিফিশের সংস্পর্শে মানুষের চামড়ায় আগুনের মতো জ্বলুনি হয়, সাথে লাল লাল ফোসকাও দেখা যায় চামড়ায়। কিন্তু জেলিফিশের বিষ মানুষের জন্য প্রাণঘাতী নয়। তবে ওজনের দিক দিয়ে সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে এশিয়ান নমুরা জেলিফিশ। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২ মিটার ব্যাসের একেকটি জেলিফিশের ওজন ২০০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে!
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct