আব্দুল মাতিন: হাসতে কোনোরকম অর্থ ব্যয় হয়না। তারপরেও বর্তমানের মানুষ হসে না। স্ট্রেসের মাত্রা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে আর অন্যদিকে আমাদের হাসি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে। কর্মব্যস্ত জীবনে নিত্যকার কাজের চাপ, সংসারের নানা ঝামেলা—সবকিছুর সঙ্গে সমানতালে চলতে গিয়ে প্রায়ই আমরা হাঁপিয়ে উঠি। অনেক সময় ভুলে যাই, শেষ কবে শুধু আড্ডা মারার জন্য বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি। কিংবা কবে সব ঝামেলাকে তুড়ি মেড়ে উড়িয়ে দিয়ে মন খুলে হেসেছিলাম। হাসির সাথে কিন্তু জড়িয়ে আছে আমাদের ভালো মন্দের ব্যাপার। নিজেকে ভালো রাখার জন্য প্রথম ও প্রধান ওষুধ হলো—মন-প্রাণ খুলে হাসা। যারা প্রাণ খুলে হাসতে পারেন, তাদের জীবনের অর্ধেক অসুখ সেরে যায়।
গবেষণায় প্রমানিত হাসি নানাভাবে আমাদের শরীরের গঠনে সাহায্য করে থাকে। বর্তমান প্রতিযোগিতাময় পৃথিবীতে যখন স্ট্রেসের মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন হাসিই কিন্তু আমাদের বিভিন্ন রোগের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। প্রাণ খোলা হাসি এমনই একটি ওষুধ, যা মুহূর্তের মধ্যেই উবে যাবে আপনার দুঃখ, কষ্ট, মন খারাপ। হাসি আপনাকে অনুপ্রাণিত করে নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে, নতুনভাবে জীবন এবং আমাদের চারপাশের পরিস্থিতিকে দেখতে। আর নতুন উদ্যম জীবনের যেকোনো বিপদ, ভয় ও দুর্বল মুহূর্তের মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। আর মন ও মেজাজ ভালো রাখতে অবশ্যই আপনাকে যত্নশীল থাকতে হবে। হাসি আসলে এক ধরনের ব্রেনের এক্সপেরিয়েন্স। আমাদের মস্তিষ্কে ‘হিউমার মাসল’-এর এমন এক নেটওয়ার্ক আছে, যা বিভিন্ন সময়ে আমাদের মস্তিষ্কে নানা রকমের সিগন্যাল পাঠায়। হাসি আমাদের মস্তিষ্কের ‘ফিল গুড’ কেমিক্যাল মেসেঞ্জার ডোপামাইন স্টিমুলেট করতে সাহায্য করে। আরও একটি মজার দিক হলো—হাসি আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। জীবনের প্রতিটি বিষয়ে অকারণে সিরিয়াস হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। সবসময় যদি আমরা সিরিয়াস হয়ে থাকি, তাহলে আমাদের জীবন থেকে আনন্দ, হাসি, মজা সবকিছু একদিন কোথাও হারিয়ে যাবে। দিনের যেকোনো সময় আমাদের মন খারাপ হতে পারে। সেই সময় ভালোলাগার মানুষটিকে হয়তো কাছে পাওয়া সম্ভব না। এ রকম পরিস্থিতিতে কী করবেন? খুব সহজ কিছু সমাধান রয়েছে এর জন্য। আপনার ঘরের ভিতর এমন জিনিস বা ছবি রাখুন, যা দেখে আপনার হাসি পায়। হয়তো আপনার পছন্দের মানুষের জীবনে নানা ধরনের পরিস্থিতি আসতেই পারে। সেই ক্ষেত্রে সেসব পরিস্থিতি নিয়ে অকারণে চিন্তা না করাই ভালো। কিছু পরিস্থিতি সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। কারণ পৃথিবীর সব সমস্যা আপনার নিজের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব না। শুধু শুধু চিন্তা মানেই স্ট্রেস লেভেল বেড়ে যাওয়া আর তার সঙ্গে দেখা দেবে নানা অসুখের লক্ষণ। এসব থেকে যতটা দূরে থাকা যায়, ততই ভালো। যতটা সম্ভব বাচ্চাদের সঙ্গে সময় কাটানোর চেষ্টা করুন। শিশুদের মধ্যে নানা ধরনের দারুণ পজিটিভ বিষয় থাকে। যা কি-না আপনার যেকোনো রকমের কঠিন পরিস্থিতিতেও আপনার মুখে হাসি নিয়ে আসবে। শিশুদের সঙ্গে খেলাধুলা করুন। বাইরে বেড়াতে যান। দেখবেন আপনার মাথার ভিতরে যে চিন্তা ছিল, তা কখন যে দূর হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারবেন না। একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, অতিরিক্ত ক্যালোরি বার্ন করার জন্যও হাসি খুবই উপকারী। মুখের ব্যায়াম হিসেবেও হাসি খুবই উপকারী। হাসার সময় আমাদের মুখের পনেরোটি ছোট ছোট মাসল কাজ করার ফলে রক্ত সঞ্চালন বেশি হয় এবং হাসির ফলে মুখের ত্বক আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসি আমাদের নানারকম ব্যথা সহ্য করার শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। ক্যান্সারেও পেইন ম্যানেজমেন্ট হিসেবে হাসি অব্যর্থ। মন খুলে যে হাসতে পারবে, তার অর্ধেক অসুখ সেরে যাবে। এখন তো ডিপ্রেশন, হার্টের অসুখের চিকিত্সাতেও ডাক্তাররা লাফটার থেরাপি সাজেস্ট করছেন। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর পাশাপাশি আমাদের দেশের বিভিন্ন স্থানে বর্তমানে বেশকিছু লাফিং ক্লাবও চালু হয়েছে। ভোরবেলা পার্কে অথবা লেকের পাড়ে গেলে দেখা যায়, বেশকিছু মানুষ একসঙ্গে নানা রকমভাবে হাসছেন। আসলে বিভিন্ন লাফিং ক্লাবের সদস্যরা এমনভাবেই হাসির অনুশীলন করেন এবং আস্তে আস্তে এই অনুশীলনই ফিরিয়ে আনে জীবনের হারিয়ে ফেলা ছন্দ।
হাসি—এই জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় মুহূর্তের মধ্যে পাল্টে যায় সব বিপরীত পরিস্থিতি। জীবনটা উপভোগ করতে প্রাণ-মন খুলে হাসুন। অবশ্য হাস্য-গবেষকরা এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না আসলে হাসিই মানুষকে সুস্থবোধ করতে সাহায্য করে, নাকি এর পিছনে আরও অন্য কোনো কারণ রয়েছে। যারা হাসেন, তাদের রসবোধ প্রখর হয়; তারা জীবন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। হাসি-খুশি ব্যক্তিকে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবার-পরিজনও পছন্দ করেন। হাসি-খুশি ব্যক্তির সাহচর্যে এসে কেউ গোমড়া হয়ে বসে থাকতে পারেন না। হাসির এত উপকারিতা থাকা সত্ত্বেও দুঃখের বিষয় এ নিয়ে তেমন কোনো নির্ভরযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়নি। হাসলে শরীরে নানারকম শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন ঘটে। এর ফলে মুখমণ্ডল ও শরীরের পেশি প্রসারিত-সংকুচিত হয়, হূদঘাত এবং রক্তচাপ পরিবর্তিত হয়, শ্বাসের গতি বেড়ে যায় এবং আমাদের শরীরের সর্বত্র অতিরিক্ত অক্সিজেন প্রবাহিত হয়। অনেকে বলেন, হাসি এবং ব্যায়ামের উপকারিতা একই রকম। হাসির পাশাপাশি যদি কেউ হালকা শরীরচর্চা করেন, তাহলে তারা আরও উপকৃত হবেন। যারা ঘরে ব্যায়ামের যন্ত্র দিয়ে শরীরচর্চা করেন, তাদের হূদস্পন্দন দশ মিনিটে যতটুকু বাড়ে, এক মিনিটের প্রাণ খোলা হাসিতেও সমপরিমাণ হূদস্পন্দন বাড়ে। হাসলে প্রচুর ক্যালরিও খরচ হয়। হিসাব করে দেখা গেছে, দশ থেকে পনেরো মিনিটের হাসির ফলে পঞ্চাশ ক্যালরি খরচ হয়। এই হিসাব দেখে তাই বলে কেউ যেন শরীরচর্চা ছেড়ে না দেন। একটি চকলেট খেলেও আমরা পঞ্চাশ ক্যালরি পাই। প্রতি ঘণ্টায় পঞ্চাশ ক্যালরি খরচে আমরা যদি এক পাউন্ড ওজন কমানোর জন্য চেষ্টা করি, তাহলে আমাদের পুরো এক দিন হাসতে হবে।
বলাবাহুল্য মানবজীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ হচ্ছে ‘হাসি’। কেউ মুখ কালো করে আপনার কাছে এসে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করলে আপনার যেমন খারাপ লাগবে, ঠিক সেই কথাটাই হাসিমুখে এসে অন্য কেউ বললে আপনার কাছে ভীষণ ভালো লাগবে। হাসির শক্তিটাই এমন। হাসি মূলত শুদ্ধতার প্রতীক, হাসিমুখ ভুলিয়ে দেয় সব যাতনা, কষ্ট, ক্লেদ। বন্ধুত্ব, আন্তরিকতা বহুগুন বাড়িয়ে দেয় হাসিমুখের বাক্যালাপ। বিগত কয়েক দশকের গবেষণার ওপরে হাসির প্রভাব সম্পর্কে আরও কিছু সুন্দর তথ্য পাওয়া গেছে। তথ্যগুলো হলো—প্রাণ খুলে হাসলে শরীরের বিভিন্ন অংশে রক্ত প্রবাহ বেড়ে যায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমে, শিথিলায়ন এবং ঘুম ভালো হয়। বলা হয়, হাসি স্বর্গীয়। হাস্যরসিক ব্যক্তি বন্ধুবাত্সল, পরিবার-পরিজনবেষ্টিত সুখী মানুষ। নিঃসঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে বন্ধুবান্ধব বেষ্টিত ব্যক্তি তিরিশ গুণ বেশি হাসেন। যারা হাসেন, তাদের সঙ্গে আশপাশের মানুষের সংযোগ অধিকতর ঘনিষ্ঠ। সর্বোপরি, হাসি স্বাস্থ্যকর। তাই আসুন আমরা বেশি বেশি হাসি। জীবনকে আনন্দময় করে তুলি এবং সুস্থ সুন্দর জীবন যাপন করি।
_____________________
গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct