সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ৩ কিস্তি ৩
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
কেন পারবি না? জীবনের তলানিতে রয়েছে আরও অনেক মণিমাণিক্য। চলতে চলতে অভিজ্ঞতার আলোয় সেগুলো লাভ করতে পারবি। তখন দেখবি, তুই নিজেই অনেকখানি পাল্টে যেতে পেরেছিস। আরও বেশি করে জানার জন্যে তোর মধ্যে আগ্রহ তৈরি হবে। প্রতিটা ধাপে রয়েছে বোধোদয়ের মহামূল্যবান চেতনা। সোনার খনিতে জমে থাকা বহু মূল্যবান বস্তুর মতো।
হারিকেনের মিটমিটে আলোয় থমথমে পরিবেশ। দীপ উপলব্ধি করতে পারল চারপাশে জমে থাকা অন্ধকারের বুকে নতুন কম্পন। দেখার এ চোখ আগে ছিল না। মাথা নাড়ল মনের খুশিতে। তা ছড়িয়ে পড়ল উপস্থিত বাকী সকলের মধ্যে। চেতনার সূক্ষ্ম প্রতিযোগিতায় তারাও দুলছে। দীপ পেরেছে যখন তাদেরও পারা উচিত। দীপের মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের মূলে যে পল্লবদা রয়েছে, সেই ছায়ায় তারাও সমুন্নতি লাভ করতে চায়। দীপের বোধোদয়ের সূক্ষ্মতায় পল্লবও ভয়ানক খুশি। পাশে বসে থাকা দেবুকে বলল, তোর বাবার চাকরীর খবর কী বল?
ঘটনাস্রোত দেখে মানুষ ভাবছে, বাবা স্বেচ্ছায় অবসর নিয়েছে। কোম্পানির কার্যবিধিতে সেটাই লেখা হয়েছে। কিন্তু মূল সূত্রে অন্য ঘটনা রয়েছে পল্লবদা। ভিতরের রহস্য জানলে তুমিও অবাক হয়ে যাবে। প্রাকটিক্যালি বাবা অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন।
একটু খুলে বললে নতুন অভিজ্ঞতা পেতুম, বাকিরাও তা জানতে পারত। আসলে আমরা যে ধূসর অন্ধকার মাড়িয়ে সামনে চলেছি, সেই যাত্রাপথে আকস্মিক ঘটনার শেষ নেই। ধূসর অন্ধকার নিজেই একটা না সূচক চরিত্র হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কারুর শক্তি নেই, সেই ধূসরতা দূর করার। তুই খুলে বললে আমরা তার মধ্যে নতুন আলো পাওয়ার চেষ্টায় পথ চলতে পারি। রাতের পরে সকাল আসে সাত রঙের আলো বুকে জড়িয়ে। মানুষের জীবনে পটপরিবর্তনের মধ্যে সেই সত্য লুকিয়ে রয়েছে।
পল্লবদা, এ ফার্মের মালিক অন্যতম বহুজাতিক কোম্পানি। সম্প্রতি মানুষের চেয়ে প্রযুক্তি ও কম্পিউটারের উপর বেশি করে গুরুত্ব দিতে শুরু করেছে। ফলে কাজের জন্যে লোকসংখ্যার গুরুত্ব তাদের কাছে অনেকখানি কমে গেছে। চাচ্ছে কম্পিউটারের মাধ্যমে ফার্মের কাজে নতুন অগ্রগতি আনতে। ফলে সাধারণ শ্রমিকের মূল্য ওই ফার্মের ক্ষেত্রে ফুরিয়ে গেছে। তাদের জন্যে কাজও নেই। সেই কোপে পড়ে বাবাও বাধ্য হল স্বেচ্ছা অবসর নিতে।
কোপ্ বলছিস কেন?
ধারালো অস্ত্রের কোপ তো এমনিই হয়। এতে অস্ত্রের ধার এতটুকু কমে না, বরং বেড়ে যায় কিন্তু দুভাগ হয়ে যাওয়া বস্তুর কোনো মূল্য থাকে না। বাবার অবস্থা তেমনি হয়ে গেছে। ফার্মে প্রযুক্তির ব্যবহার ধারালো অস্ত্র হয়ে বাবার মতো আরও অনেকের উপর কোপ বসাতে চাইবে অদূর ভবিষ্যতে। সেদিন বেশি দুরেও নেই।
তাহলে ভিতরের খেলাটা এত কুৎসিত? এতই জটিল ? প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে লোক ছাঁটাই-এর কৌশল নিয়েছেন ফার্মের মালিক? সরল অঙ্কের মতো কঠোর বাস্তবতা পল্লবকে বার বার ধাক্কা মারতে থাকল। এও বুঝল, পিছনের পর্দা ফাঁস করে কিছু করার ক্ষমতা তাদের হাতে নেই। বেঁধে মারে সয় ভালো অবস্থার মধ্যে তাদের চলতে হচ্ছে। দেশের মানুষের মধ্যে এখনও তেমন ঐক্য গড়ে ওঠে নি। ঐক্য না থাকলে গণশক্তি দিয়ে কিছুতেই প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় না। আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল পল্লবের বুক থেকে। জীবনের প্রতি ভালোবাসা, দেশের জন্যে আকুতি কেমন করে দীর্ঘশ্বাস হয়ে ওঠে, তা সেদিন টের পেল সে। সুমনও শুনতে শুনতে কেমন যেন হতচকিত হয়ে গেল। তার মুখে মেঘলা আকাশের ছবি। সেও খুব চিন্তিত তার দাদার চাকরির প্যানেল নিয়ে। পল্লব বলল, হারে সুমন, তোর দাদার চাকরির প্যানেলটা কী শেষ পর্যন্ত পাকা হয়ে গেল?
সুমনের মুখে হতাশার ছবি। দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল পল্লবের দিকে। দাদার কাছে যা শুনেছি, তাতে মনে হয়েছে প্যানেল হওয়ার ক্ষেত্রে নতুন বাধা এসেছে। কী হয় জানি না।
সে কী রে? কদিন আগে এজন্যে তোর মুখে কত খুশি দেখলুম। আজ আবার অন্য রকম বলছিস। অবস্থানটা খুলে বলতে পারিস। শেয়ার করলে মনের চাপ অনেকখানি কমে যায়।
যে ফার্মে চাকরির কথা হচ্ছে, সেটাই ইতিমধ্যে একটা বহুজাতিক কোম্পানি নিয়ে নিয়েছে। তারাও উন্নত প্রযুক্তির নামে মানুষের দাম কমানোর কথা বলছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে, নতুন প্যানেল করে লোক নিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। খুব অসুবিধায় পড়ে গেলুম পল্লবদা। আমাদের সংসারে সবাই ভাবছিল, একটা চাকরির খুব প্রয়োজন। ভিতরে আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য তাতেই ফিরে আসবে। একটা মুক্ত হাওয়া ঢুকতে পারত আমাদের বাড়িতে কিন্তু তা আর হল কই। জানো পল্লবদা, বড়ো বেশি টেনেটুনে আমাদের সংসার চলে আসছে। বাইরে কারুর কাছে তা প্রকাশ করি নি। অনেক দিন হল, আর্থিক অনটনে আমাদের বাড়িতে কোনো ভালো মেনু ঢোকে নি, একসাথে বসে খেতে খেতে আনন্দ উপভোগ করার কথা ভুলেও গিয়েছিলুম। দাদার চাকরির প্রসঙ্গে একটা নতুন স্বপ্ন জেগে উঠেছিল সবার মধ্যে শীতের শেষে দখিনে বাতাসের মতো। কিন্তু...., থেমে গেল সুমন। বাক্যটা শেষ না করে মাথা নীচু করে বসে থাকল। একটা বড়ো নিঃশ্বাস পেলে পল্লবের দিকে দুচোখ রেখে বলল, সেই স্বপ্নটাই বিদেশী প্রযুক্তির নামে এভাবে মুখ থুবড়ে পড়তে চলেছে মাটিতে। মনে মনে কেমন যেন অনাথ হয়ে পড়েছি।
দুচোখ ভিজিয়ে পল্লব চেয়ে থাকল সুমনের দিকে। সুমন আবেগে দুলছে। আরও কিছু বলতে চাচ্ছিল সে কিন্তু আবেগের আতিশয্যে পারল না। মনের উচ্ছ্বাসে অবরুদ্ধ হয়ে থম মেরে বসে থাকল। নীল আকাশের দিকে চোখ রেখে বুঝতে পারল, তাদের সংসারের সীমা কত ছোটো হয়ে গেছে। দুচোখের কোণ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল চুইয়ে পড়ল মাটিতে। পল্লবও জানতে পারল, সুমনের ভিতরে কত গভীর ক্ষত তৈরি হয়েছে। এটুকু বোঝে বলেই সে নাটকের নির্দেশনায় এত বেশি পারদর্শী হয়ে উঠতে পেরেছে। সুমন নিজে একটা পোলট্রি চালায়। সেই আয়ে আপাতত তাদের সংসার চলে। তাই জানতে চাইল, তোর পোলট্রির খবর কী বল?
মৃতপ্রায় হয়ে একরকম চলছে। বুঝতে পারছি, এ ব্যবসার আয়ু দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তবুও যতক্ষণ চলছে, চালাতেই হবে মন দিয়ে। শেষতম সম্বলটুকু তো নিজের ইচ্ছেয় ছেড়ে দেওয়া যায় না।
তাহলে কী বিরুদ্ধ কোনো সূত্র পেয়েছিস যেজন্যে এমন করে বলছিস?
দাদার চাকরির পিছনে বিদেশী মনোভাব যেভাবে কাজ করেছে, আমার ব্যবসার পিছনে একই মনোভাব দেখতে পাচ্ছি। কোলকাতার হোটেলগুলোতে অত্যন্ত কম দামে বিদেশ থেকে মুরগির ঠ্যাং আসতে শুরু করেছে। তাতেই আমার দোকানে খরিদ্দার কমছে ভাটার স্রোতের মতো। সকলেই কম দামে মাংস খেতে চায়। সেভাবেই পিছু হটতে হচ্ছে। বড়ো আশা নিয়ে মায়ের সব গহনা বিক্রি করে এ ব্যবসা শুরু করেছিলাম পল্লবদা। যেটুকু আয় হত, তাতেই সংসার চলে যেত। সীমাবদ্ধ রোজগারের উপর নির্ভর করে খরচ বাঁচিয়ে সংসার চালানোর একটা সুন্দর প্রবণতা গড়ে উঠেছিল আমাদের বাড়িতে। বোধ হয় সেই হিসেব ফুরিয়ে যেতে বসেছে। তোমাকে একটা হিসেব দিই পল্লবদা। সপ্তাহে অন্তত দেড় হাজার পোলট্রি বিক্রি করতুম। সেই সুযোগ কমতে কমতে গত সপ্তাহে পাঁচশ’তে নেমে এসেছে। এখনও মা জানে না, আমার ব্যবসায় কীভাবে এত বড়ো দুর্গতি শুরু হল। কেবল ভাবছি, পোলট্রি ব্যবসা বন্ধ হলে আমাদের সংসার চলবে কী করে? চায়না পেন বাজারে আমদানী হওয়ার ফলে ভারতে নির্মিত পাইলট পেনের ব্যবসা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে গেছে। সেই ছবি আমার চোখে ভাসছে। বোধ হয় একই অবস্থার মধ্যে আমিও ডুবতে চলেছি। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
দীপের মধ্যে নতুন মূল্যায়ণ জেগে উঠল। কয়েক দিন আগে পল্লবদার বলা একটা প্রসঙ্গকে সে আদৌ গুরুত্ব দিতে পারে নি। অলিক বলে মনে করেছিল। কিংবা বিশেষ বিদ্বেষ নিয়ে এসব বলা হচ্ছে বলে তার বদ্ধমূল ধারণা হয়েছিল। সুমনের কথা শুনতে শুনতে তার সবচেয়ে বেশি করে মনে পড়ল পল্লব দাশের বলা কথার মূল্যায়ণ নিয়ে। পুরনো প্রসঙ্গের মধ্যে সে খুঁজে পেল প্রিয় পল্লবদার প্রাজ্ঞ মনোভাবকে। দুলতে লাগল ভিতরে ভিতরে। জীবনের বাঁক ফেরার নানা সূত্র কত সহজে আয়ত্ত করতে পারে, তা ভেবে অবাক হল দীপ। সে যে সামাজিক বিন্যাস নিয়ে মননের ভাবনায় অনেক পিছনে, তা ও বেশ বুঝতে পারল। প্রশ্ন করল পল্লবকে, একটা উত্তর দেবে পল্লবদা?
জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর এখনও খুঁজে পাই নি রে। তবে খুঁজছি। জানা থাকলে মন খুলে আলোচনা করাই আমার মূল কাজ। চাপানো নেতৃত্ব নাটক পরিচালনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড়ো বাধা। বরং নাটক যে জীবনের সব উত্তর খুঁজে পাওয়ার উপযুক্ত সোপান, সেই মনোভাবে আমি অনেক বেশি বিশ্বাস করি। এটাও ঠিক, রহমানকাকু যেভাবে জীবনের জটিল প্রশ্নকে নিজের ব্যাখ্যায় সরলীকরণ করে দিতে পারে, আমি তা পারি না। সারা ভারত ঘুরতে ঘুরতে কাকুর জীবনভাবনা সমুদ্রের মতো অতলান্ত হয়ে উঠেছে। সেজন্যে দেশকে, দেশের মানুষকে, নাট্যভাবনা নির্ভর জীবনকে এত গভীর করে ভালোবাসতে শিখেছেন। আমি তো গুরুর পাশে খালবিলের মতো। তাই নতুন প্রসঙ্গ এলে কাকুর স্মৃতিচারণ না করে পারি না। গুরুর গুরুত্ব স্বীকার করতে ভিতরে এতটুকু দ্বিধা নেই বলেই অন্তত কিছুটা এগোতে পেরেছি। বল, তোর প্রশ্নটা ভালো করে শুনি। পারলে এখনিই উত্তরটা বলে দেব, না পারলে কাল পরশু কাকু বাড়িতে ফিরবেন বলে জানতে পেরেছি, জেনে নিতে কোনো অসুবিধা হবে না।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct