খাজিম আহমেদ: মধ্যযুগে ইসলামধর্মী আরবীয়রা শুধু রাজনীতিতেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন না। বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও পৃথিবীর মধ্যে তঁারাই সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী জাতি হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছিলেন। তাবৎ দুনিয়ার বিভিন্ন অংশের সঙ্গে তাঁরা বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বহু অনাবিষ্কৃত দেশে গিয়েও পৌঁছান তাঁরা। এটি মানব সভ্যতার ইতিহাসে একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায়। ‘অশান্ত ব্রাহ্মণ’ (‘দ্য রেস্টলেস ব্রাহমিন’) এম.এন রায় এমন অভিমতই ব্যক্ত করেছেন তাঁর অসাধারণ মূল্যবান গবেষণা ‘দ্য হিস্টোরিকাল রোল অব ইসলাম’- নামক গ্রন্থে।
বিশ্বজনীনতা
ইসলামে কূপমুণ্ডকতার কোন স্থান নেই। স্বভাবতই নিখিল জাহানের যেকোন স্থানই একজন বিশ্বাসী ‘মোমিন’-এর কাছে গ্রহণযোগ্য ঠাঁই। এর ফলে দেখব এবার জগতটাকে- এই মানসিকতায় নূতন নূতন ভৌগলিক অ্যাডভেঞ্চারে আরবীয় মুসলমানরা নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলে।
বস্তুত, ভূগোল বিদ্যায় আরবীয়রা সীমাহীন উন্নতি করেছিলেন। এই বিষয়ের উপর অসংখ্য গ্রন্থও তাঁরা রচনা করেন। মুসলমান আরবীয়রা ‘মেরিনার্স কম্পাস’-এর আবিষ্কর্তা। বিপদ সংকুল সমুদ্রযাত্রায় এই যন্ত্রটির সাহায্য ছিল তুলনাহীন।
আরবীয়দের থেকেই ইউরোপীয় বণিকগোষ্ঠী ভূগোলের প্রাথমিক জ্ঞানার্জন করে। ভাস্কো দা-গামা হিন্দুস্তান-এ এসে পৌঁছেছিলেন সেটি ইতিহাস সত্য, কিন্তু তাঁর জাহাজের ‘কাপ্তান’ ছিলেন আহমদ ইবন মজিদ।
তিনি এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। জনাব মজিদ অবশ্যই একজন আরবীয় মুসলমান।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দিকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একটি গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে, কলম্বাসের বহু পূর্বেই আরবীয়রা আমেরিকায় পৌঁছেছিলেন। তাঁরা নয়া আবিষ্কৃত মহাদেশে বাণিজ্যিক সম্পর্কও গড়ে তুলেছিলেন।
বস্তুত ইসলাম প্রচারে আরবীয়রা তিনটি পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলেন।
১. পলিটিকাল ইসলাম, ২. মার্কেন্টাইল ইসলাম (বাণিজ্যিক পদ্ধতি) এবং ৩. সুফি দরবেশ দার্শনিক বর্গের অসূয়াশূন্য জীবনচর্চার প্রভাব। প্রায় ৭০০ বৎসরব্যাপী ইসলাম বিশ্বসভ্যতার শীর্ষে অব্স্থান করে। শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অধিনায়ক হয়ে ওঠে।
বিদ্যুৎগতিতে বিশাল সাম্রাজ্য স্থাপন:
এশিয়া মহাদেশের ভারতবর্ষ, পারস্য, আফগানিস্তান, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া, প্যালেস্টাইন, এশিয়া মাইনর এবং পুরো আরব দুনিয়া, আফ্রিকার মিশর, সুদান, ত্রিপোলি, মরোক্কো, আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া, ইউরোপে গ্রিস, তুরস্ক, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, সার্বিয়া, হাঙ্গেরী, দক্ষিণ রাশিয়া, স্পেন ও পর্তুগাল প্রভৃতি দেশে তাঁদের ‘প্রভাব’ ও প্রতিপত্তি স্থাপন করতে অশেষ দক্ষতা আর স্থিরবুদ্ধির পরিচয় রেখেছিলেন। ভূমধ্যসাগর, ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরের বহু দ্বীপে এমনকী ফ্রান্স, ইতালি, সুইৎজারল্যান্ড ইত্যাকার দেশেই তাঁদের বিজয় নিশান উড়িয়েছিলেন। গ্রিক, রোমান, পারসিক, কার্থেজিনিয়ান প্রভৃতি সভ্যজাতিও এতো অল্প সময়ে এতো বৃহৎ সাম্রাজ্য স্থাপন করতে সক্ষম হয়নি। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে কার্থেজ পর্যন্ত উত্তর আফ্রিকা ছিল একমাত্র দেশ যেখানে ইসলাম প্রসারের সাথে সাথে খ্রিস্টধর্ম নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল।
স্মরণীয় বিপ্লব
দুনিয়াখ্যাত মহান ঐতিহাসিক গিবন, ইসলামের উত্থান এবং বিস্তারকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে, ‘সমস্ত স্মরণীয় বিপ্লবের মধ্যে এই বিপ্লব অন্যতম। দুনিয়ার সমস্ত জাতির উপর এই বিপ্লব একটা নতুন ও স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে।’ মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সা.-এর অনুগামীরা সাফল্যের সাথে ইসলামের পতাকা একদিকে ভারত, অন্যদিকে আটলান্টিক মহাসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। দামাস্কাসের প্রথম খলিফারা এতো বড় সাম্রাজ্য স্থাপন করেছিলেন যে দ্রুতগামী উটের সাহায্যে পাঁচ মাসেও তা পার হওয়া যেত না। হিজরীর প্রথম শতাব্দীর শেষে ‘বিশ্বাসীদের নেতারা’ দুনিয়ার সবচেয়ে ক্ষমতাবান শাসক ছিলেন।’ বস্তুত হিমালয় থেকে আড্রিয়াটিক স্পেন এবং দক্ষিণ ফ্রান্স পর্যন্ত ইসলামের যোদ্ধারা পৌঁছে গেছিলেন ঝড়ের গতিতে। ইসলামের এই অসামান্য সাফল্যের কারণ হল তার বিপ্লবী চরিত্র ও হতাশাজনক পরিস্থিতিতে জনগণকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সা. তাঁর মেধা আর মননকে ব্যবহার করেছিলেন, নয়া সমাজ, নয়া রাষ্ট্রব্যবস্থা আর আল কুরআন ভিত্তিক মহাদর্শের জীবনকে উদ্ভাসিত করার জন্য। (পড়ুন, এম.এন রায়, ‘ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা’, ভাষান্তর: শঙ্কর ঘোষ, পৃ: ১২-১৪, এবং H.A.L. Fisher, History of Europe, PP, 137-8).
সহিষ্ণু ইসলাম
খ্রিস্টান ইউরোপে ক্যাথলিকরা ইহুদি আর প্রটেস্ট্যান্টদের অত্যন্ত ঘৃণার চোখে দেখত। কিন্তু আরবীয়রা বিশেষ ‘খাজনা’ (কর) গ্রহণের পরিবর্তে ইহুদি, খ্রিস্টান, পারসিক প্রভৃতি জাতিকে ধর্মগত স্বাধীনতা পালনের অধিকার জারি রাখে। ধর্মীয় বিষয়ে ইসলাম অনুসারীরা সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁদের ‘কর’ পদ্ধতিও ছিল প্রশংসনীয়। সমস্ত প্রজাকেই ‘খেরাজ’ বা ভূমি কর দিতে হতো। তাঁরা পুরনো রাজপথগুলোকে সংস্কার আর নতুন রাজপথ নির্মাণের মারফত সাম্রাজ্যের সর্বত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করেছিলেন। ডাকপ্রথাও গড়ে উঠেছিল। মানুষ বাহিত ডাক ব্যবস্থা ছাড়াও ঘোড়ার ডাক ও পায়রার ডাক-ও প্রবর্তিত হয়েছিল। স্থাপত্যের বাবদেও তাঁরা এক অভিনব পদ্ধতির আবিষ্কার ও প্রয়োগ করেছিলেন। গোলাকার অশ্বপদাকৃতি খিলান, গম্বুজ, দীর্ঘ মনোরম মিনার এবং অদৃষ্টপূর্ব সৌন্দর্য ছিল তাঁদের স্থাপত্য কর্মের মহাবৈশিষ্ট্য। আরবীয় মুসলমানদের স্থাপত্যে মার্জিত রুচি ও সৌন্দর্যপ্রীতির পরিচয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। আল-হামরা, কুতুবমিনার, তাজমহল এবং দিল্লি, দামাস্কাস ও কর্ডোভার বড় মসজিদ আজও শিল্পরসিকদের বিস্ময় উদ্রেক করে।
এখানে পরিষ্কার করে একটি তথ্য উল্লেখ্য, কুতুবমিনার, তাজমহল আর দিল্লির নানান স্থাপত্য নির্মাণ করেছিলেন তুর্ক-আফগান আর মুঘল বাদশাহরা। এঁরা আরব্য মুসলমান ছিলেন না।
খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকেই আরবীয়রা তাঁদের বিজিত দেশে জনগণের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয় স্থাপন করেন। আজকের দিনে ‘সর্ব শিক্ষা অভিযান’-এর কথা বলা হচ্ছে। এই ‘কনসেপ্ট’ মুসলিম আরব ১ হাজার ৩০০ বছর আগেই প্রচলন করে। ইউরোপে যখন গির্জা আর ধর্মীয় মঠ ব্যতীত অপর কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না, এর অনেক পূর্বে আরবীয়রা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশে বহু বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। শিক্ষা পদ্ধতির দিক দিয়ে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় এগুলো শ্রেষ্ঠতর ছিল। কর্ডোভা এবং কায়রো বিশ্ববিদ্যালয় এই সময়ে খ্যাতির শিখরে অবস্থান করছিল। সেই সময় কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দ্বাদশ সহস্র’ ছাত্র লেখাপড়া করছিলেন। বর্তমানে ‘আল-আযহার’ বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতি তামাম জাহানজুড়ে বন্দিত।
বোগদাদ/ বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় বিদ্বৎসমাজের আগ্রহের কেন্দ্র হিসেবে চর্চিত ছিল। বিশ্ব বিজয়কালীন ‘মুমিন’ আরবীয়দের জ্ঞানার্জনের স্পৃহা ছিল অপ্রতিরোধ্য (Unputdownable). স্বভাবতই তাঁরা প্রচুর গ্রন্থাগার স্থাপন করেন। লক্ষ লক্ষ কেতাব এই পাঠাগারগুলোতে মওজুদ ছিল। পঠন-পাঠনের জন্য সুব্যবস্থা ছিল স্বাভাবিক। ‘বাদশাহ’ থেকে ‘ওমরাহ’ (অভিজাত শ্রেণি) হর শ্রেণি গ্রন্থাগারের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাঁরা ওয়াকিফহাল ছিলেন, ‘জ্ঞানসাধকের দোয়াতের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’।
এটি শুধু একটি বাণী ছিল না। ইসলাম জ্ঞানার্জন, লেখা পড়ার জন্য কি নিঃসীম গুরুত্ব আরোপ করতো এটি তারই প্রকাশ। ‘আল-কুরআনে’ প্রথমেই উচ্চারিত হয়েছে ‘একরা’, পড়, পাঠ করো। কি অতলান্তিক বেদনার মধ্যে হাল আমলে আমরা রয়েছি যে বহু মুসলমানের ‘মিম’ লিখতে ‘কলম’ ভেঙে যায়। ‘শায়েরে ইনকিলাব’ কাজি নজরুল ইসলাম এইভাবে তাঁর বেদনাকে প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সা. ‘দ্য এজ অব জাহেলিয়াত’-কে (অন্ধকার যুগ) পিছনে ফেলে আলোকিত জীবনের অ্যাভিনিউ খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর প্রায় ১৩৯০ বছর বাদে দুনিয়ার মুসলিম ‘উষ্মা’ হতমান হয়ে রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালি মুসলমানদের হাল হকিকত তো হর-রোজ গ্লানিতে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে।
প্রসঙ্গত বলে রাখি, স্পেনের আল-মেরিয়ার উজির ইবনে আব্বাসের নাম এ বিষয়ে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য। তাঁর গ্রন্থাগারে চারলক্ষ গ্রন্থাদি মওজুদ ছিল। তৎকালীন ‘বুজর্গ’বর্গের জন্য এই গ্রন্থাগার ছিল আশীর্বাদ স্বরূপ।
ইউরোপে ইসলাম
ইউরোপস্থিত স্পেনের খ্রিস্টান ছাত্ররাও অধ্যয়ন করতে আসতেন।এইভাবে খ্রিস্টধর্মী ছাত্র সমাজ জ্ঞানার্জনের পর নিজ দেশের সেবায় নিয়োজিত হতেন। এই সমস্ত ছাত্রদের মাধ্যমে ইউরোপে জ্ঞান-গরীমা, আরবীয়শিক্ষা ও সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়ে। সে ছিল বড় মর্যাদার সময়। আইন, দর্শন, ধর্মশাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, অলংকারশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয় পঠিত হত। আরবীয়রা অ্যারিস্টটলের গ্রন্থ অনুপুঙ্খ চর্চা করেছিলেন এবং দর্শনের ওপর ভিত্তি করে নিজেরা নবতর দর্শনের সৃষ্টি করেছিলেন।
আরবীয়রা ইতিহাসের জন্মদাতা
ইতিহাস ও ভ্রমণ বৃত্তান্ত সম্পর্কে রচিত বহু মূল্যবান গ্রন্থ ও জীবনচরিত এখনও জ্ঞানপিপাসুদের বিমোহিত করে। অসাধারণ মনীষী ইবনে খলদুন ইতিহাস আর সমাজবিজ্ঞানের জন্মদাতা। চতুর্দশ শতাব্দীতে সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিতে অমূল্য অবদান রেখেছেন আফ্রিকার এই মনীষী ইবনে খলদুন (খ্রি. ১৩৩২-১২৮২)। (পড়ুন, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁহার শিক্ষা ও অবদান-পৃ. ৩০৮)। মাত্র ৫০ বছর বয়সে তার ইন্তেকাল। মানবসভ্যতার বিরাট ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। একটি চমকপ্রদ কহাবত রয়েছে, বলা হয়ে থাকে পৃথিবীর সমস্ত ইতিহাস নষ্ট হয়ে গেলেও শুধুমাত্র ইবন খলদুনের গ্রন্থটি বেঁচে থাকলে আবার পৃথিবীর নয়া ইতিহাস নির্মাণ করা যাবে।
আরবীয়রা গণিতশাস্ত্রে চরম পারদর্শিতার শীর্ষ স্পর্শ করেছিলেন। খ্রিস্টীয় দ্বাদশ শতকে প্রখ্যাত গণিতবিদ মুহাম্মদ ইবনে মুশা ‘শূন্য’-(Zero) আবিষ্কার করেন। গণিত শাস্ত্রে এটি একটা মহাবিপ্লব। আলহাজ মুশা-ই সর্বপ্রথম ‘দশমিক বিন্দু’ বা Decimal Notation-এর ব্যবহার করেন এবং সংখ্যার স্থানীয় মান (Value of Position) নির্দেশ করেন।
গণিত শাস্ত্র ও বিজ্ঞান চর্চা
আরবীয়রা জ্যামিতিতে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করতে সমর্থ হননি বাস্তব সত্য, কিন্তু বীজগণিতে তাঁদের দান আকাশস্পর্শী, অপরিসীম/ অতলান্তিক। ‘আলজেব্রা’ (Algebra) নামটাই প্রখ্যাত গণিতশাস্ত্রী, আল্ জবরের নাম থেকে এসেছে। খারেজমী প্রণীত ‘আলজেব্রা (৮২০ খ্রিস্টাব্দ) ল্যাটিন ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।
শিঞ্জিনী (Sine), স্পর্শজ্যা (Tangent) ও প্রতিস্পর্শজ্যা (Co-Tangent) এবং বর্তুলাকার ত্রিকোণমিতির (Spherical Trigonometry) প্রভৃতিও ইসলামি আরবীয়দের বিশ্বসভ্যতায় অমূল্য অবদান। সারা জগৎ এভাবে মান্যতা দিয়েছে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী আল্ হাজান/ আল্্ হাজেন আলোকবিজ্ঞান সম্পর্কে বহু গ্রন্থ রচনা করেন। আল্্ হাজানের আবিষ্কৃত ‘Focus’ নির্ণয় পদ্ধতি রজার বেকন পাশ্চাত্যে আমদানি করে নিজেই এর আবিষ্কর্তা হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছেন। ‘Optics’-এ আল্্ হাজানের অবদান বৈজ্ঞানিক সমাজ শ্রদ্ধা সহকারে, নতমস্তকে শ্রদ্ধা পেশ করে। আল্ হাজানের গবেষণা-কর্মগুলো, গ্রন্থাদি লাটিন ও ইতালীয় ভাষায় অনূদিত হয়। এই অনুবাদ গ্রন্থগুলো থেকে কেপলার প্রভূত সাহায্য নিয়েছিলেন। সে বাবদে তিনি কৃতজ্ঞ ছিলেন। কেপলার ছিলেন জার্মানির একজন প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক।
জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা
জ্যোতির্বিদ্যায় (Astronomy) আরবীয়দের অগাধ জ্ঞান আজকের বৈজ্ঞানিক সমাজকেও চমকিত করে। সেই সময়েই আরব জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কিছু ‘মান-মন্দির’ (Odservatory) নির্মাণ করেন। আরবের বৈজ্ঞানিকবর্গ বিশেষ গবেষণার মাধ্যমে ‘রাশিচক্রের কোণ’ (Angle of the ecliptic) ও সারা রাত্রিদিনের প্রাগয়ণ (Precission of the uqinoxes) স্থির করেন। Almanac (পঞ্জিকা), Azimuth (দিগন্তবৃত্ত), Zenith (মস্তকোর্ধ্ব নভোবিন্দু), Nadir (অধঃস্থিত নভোবিন্দু) প্রভৃতি জ্যোতিষশাস্ত্রের অসংখ্য শব্দ আরবি ভাষা হতে গৃহীত। জ্যোতির্বিদ্যার ব্যাপারে আল্্ ফারঘানী আর আল্্ বাত্তানি ইউরোপের শিক্ষাগুরু। ইউরোপীয়রা এঁদের আলফ্রেগ নাম আর আলবেটেনিয়াম নামে অভিহিত করে। জ্যোতির্বিদ্যার, বর্তমানে যে চমকপ্রদ অবস্থান তার মূলে রয়েছেন আরবীয়দের প্রখর পরিশ্রম এবং অধ্যবসায়।
চিকিৎসাশাস্ত্র
আরবীয়দের হাতযশে চিকিৎশাস্ত্রের যথেষ্ট উন্নতি সম্ভব হয়েছিল। স্বাস্থ্যরক্ষা ও শারীরবিদ্যা তাঁদের পাঠ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাঁরা যে ভেষজ বিজ্ঞান’ এবং Materia Medica সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিফহাল আর পারদর্শী ছিলেন।‘ক্লোরোফর্ম’ জাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার তাঁরা জানতেন। পাশ্চাত্যের মেডিক্যাল কলেজগুলোতে তা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী আল্্ রাজি’ ‘আয়ুর্বেদ বিশ্বকোষ’ দশখণ্ডে সমাপ্ত করেছিলেন। আজও তা সারা বিশ্বে চর্চিত আলোচিত এবং বু আলি সিনার (Avecena) ‘ব্যবস্থা’ ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ বিষয়ক বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল। সুস্থতা ‘আল্লাহ’র শ্রেষ্ঠ নিয়ামত। বিশ্বনবী সা. বলেছেন, তোমরা অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে গণিমত মনে করো।
রসায়ন শাস্ত্রও (Chemistry) তাঁদের গবেষণায় ঋদ্ধ হয়েছিল। তাঁরা ‘সুরাসার’-(Alcohol), পটাশিয়াম, পারদ, নাইটিক অ্যাসিড, সালফিউরিক অ্যাসিড প্রভৃতি আবিষ্কার করেন।
গ্রহজ্ঞান
ইউরোপীয়রা যখন পৃথিবী সমতল এই চিন্তায় ব্যস্ত, বাগদাদে তখন পৃথিবীর পরিধি নির্ণীত হচ্ছিল। সূর্যের আলোকে চাঁদ আলোকিত হয়- এ তথ্যও তাঁদের অগোচর ছিল না। চাঁদ, সূর্য এবং অন্যান্য গ্রহের কক্ষও তাঁরা নির্ধারণ করেছিলেন।
সাহিত্যসাধনা
সাহিত্যক্ষেত্রেও আরবীয় মুসলমানদের অসাধারণ প্রতিভার প্রকাশ ও বিকাশ লক্ষ্য করা যায়। আরব্য উপন্যাস আজও পুরো বিশ্বকে যাদু বাস্তবতায় মাতিয়ে রেখেছে। কবিতা চর্চার ধারা বহমান ছিল। পাশ্চাত্যে প্রেম বিষয়ক কবিতা চর্চা যখন চিন্তার অগোচর ছিল, আরব জীবনে তার পূর্ণ বিকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে উঠেছিল। সোজাসুজি বলতে কি ইংরেজি সাহিত্য আরবীয় সাহিত্যের দ্বারা আমূল প্রভাবিত। সাবুত পেশ করি, বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমরা সবাই জানি ‘রবিনসন ক্রশো’র রচয়িতা হচ্ছেন ড্যানিয়েল ডিফো। কিন্তু আমরা ক’জন এ তথ্য জানি যে এটি ইবনে তোফায়েলের একটি সাহিত্য নির্মাণ ও সৃজনের প্রায় অনুবাদ। ইউরোপীয় পণ্ডিতমহল তা স্বীকার করে। এটি ভালো লাগার বিষয়।
উন্নততর জীবনসাধনা
কারিগরিতে, নকশার বৈচিত্রে, সৌন্দর্যে এবং শিল্পকৌশলের পূর্ণতায় তাঁরা বিশ্বে একটি মর্যাদা পূর্ণ স্থান অধিকার করেছিলেন। সোনা, রূপা, তামা, পিতল, ইস্পাত ইত্যাকার ধাতুর যাবতীয় কাজ তাঁরা রপ্ত করেছিলেন। তাঁত শিল্পেতো তাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না। মোসেল হতে মসলিন, দামাসকাস থেকে ‘দামস্ক’ এবং গাজা থেকে ‘গজের’ উৎপত্তি হয়েছে। কাঁচ ও মাটির পাত্র এবং কাগজ তৈরির পদ্ধতিও তাঁদের অজানা ছিল না। তাঁদের চর্মশিল্প তাবৎ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। সিরাপ, সুগন্ধিদ্রব্যও তাঁরা তৈরি করতেন দক্ষতার সঙ্গে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ, জলসেচ, মাটির গুনানুসারে ফসল উৎপাদন বিষয়েও তাঁদের গভীরজ্ঞান ছিল। উদ্যান নির্মাণ সৌন্দর্যবোধের পরিচয় বহন করে। প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের বহু দেশের উপাদেয় ফলের গাছ আমদানি করে অনুসন্ধানী মানসিকতার নজির সৃষ্টি করেছিলেন। কৃষি বিষয়ক বহু গ্রন্থ সেই সময়ে রচিত হয়েছিল।
আরবীয়দের অসীম অবদান
৬২২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত খলিফারা বিশ্বের সর্বাপেক্ষা দুর্দম ও প্রতাপশীল শাসক ছিলেন। দামাসকাসের প্রাসাদ থেকে যে ফরমান জারি হতো সিন্ধু, নীল, ইউফ্রেটিশ, টেগান নদীর তীর পর্যন্ত সমভাবে প্রতিপালিত হোত। নবম শতাব্দী বাগদাদের খিলাফতের এক সুবর্ণ অধ্যায়। এর পরে কায়রো, এবং কর্ডোভা বাগদাদের স্থান অধিকার করে। কষ্টসহিষ্ণু, বদান্যতা, সৌজন্যবোধ, জ্ঞানচর্চা ও আড়ম্বর ছিল তাঁদের চরিত্রের প্রশংসনীয় বৈশিষ্ট্য।
আরব-মুসলিম বণিকরা ভারত, পূর্ব ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, রাশিয়া ও বালটিক সাগর, লোহিত সাগর, ভারত মহাসাগর প্রভৃতি অঞ্চলের সমুদয় দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করে। আফ্রিকার ছাদ পর্যন্ত ছিল তাঁদের অবাধ গতি। নৌযুদ্ধে আরবীয়দার দান অতুলনীয়। সুদক্ষ নৌবহরের সাহায্যে তাঁরা সাইপ্রাস, রোডস, সিসিলি, সার্ডিনিয়া, পাইডমন্ট, কর্সিকা, ক্রীট, বেলিরিক দ্বীপপুঞ্জ অধিকার করে। শাসন কায়েম করে। নৌবহরের সাহায্যে তাঁরা স্পেন ও ইতালিতে অবতরণ করেন এবং কনস্ট্যান্টিনোপল অধিকার করেন। আরবি ভাষা থেকে উৎপন্ন যে সব নৌবিদ্যা বিষয়ক শব্দ দক্ষিণ ইউরোপের দেশগুলিতে প্রচলিত আছে, তার থেকেই অনুমান করা যায় তাঁদের প্রভাব কত গভীর ছিল।
(সূত্র: এম.এন রায়, ‘ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক ভূমিকা’ ভাষান্তর শংকর ঘোষ। পৃষ্ঠা ১১-১২
‘শত শত বছর ধরে দুটো সম্প্রদায় পাশাপাশি বাস করছে, তবুও তারা পরস্পরের সংস্কৃতিকে বোঝবার খুব একটা চেষ্টাই করল না। এমন দৃষ্টান্ত আর একটাও নেই। পৃথিবীর কোনও সভ্য জাতিই ভারতীয় হিন্দুদের মতো ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে এমন অজ্ঞ নয়। কোনও সভ্য জাতিই হিন্দুদের মতো মুসলমান ধর্মের প্রতি এমন ঘৃণা পোষণ করেন না। ...ইসলামের অসীম বিপ্লবী তাৎপর্য এবং এই বিপ্লব যে বিশাল সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে সে সম্পর্কে তাদের কোন শ্রদ্ধাও নেই। ...ভারতের ইতিহাসের এই সন্ধিক্ষণে ইসলামের সাংস্কৃতিক তাৎপর্যের যথাযোগ্য মূল্যায়ন তাই খুব গুরুত্বপূর্ণ।’)
আরবীয় সভ্যতা ইউরোপীয় সভ্যতার বনিয়াদ গড়ে দিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্র ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূত্রগুলো ইউরোপে নিয়ে যায়, উপরন্তু ক্রুশেডে অংশ নিয়েছিল যে সমস্ত সৈনিক, তারাও আরবীয় ইসলামাশ্রয়ী শিক্ষা আর জীবনচর্যাকে ইউরোপে নিয়ে যায়। ‘মুরদের সঙ্গে (স্পেনের মুসলমান) যুদ্ধের সময় বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় চার্লস মার্টেল মুসলমানদের মতো অশ্বারোহী দল গঠন করেন এবং এই পদ্ধতিই শেষে ‘শিভালরি’ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। শিভালরি বোধ আরবীয়দের সহজাত।
যে বায়ুচালিত তাঁত বর্তমানে ‘The Dutch wind mill’ নামে পরিচিত তা আরবীয়দেরই আবিষ্কার। প্রাচ্যে এর দ্বারা শস্যচূর্ণ আর জল উত্তোলন করা হতো। ক্রুসেডাররা এই যন্ত্রটির আমদানি করেছিলেন। সিরাপ, অন্তঃসার (Elixer) কর্পূর, সোনামুখী (Senna), রেউচিনি (Rhubarb) ও আরও বহুবিধ বস্তু ও দ্রব্যের প্রস্তুত প্রণালীর তালিম ইউরোপীয়রা আরবীয়দের কাছ থেকে নেয়। Alembic, Alcohol, Alkali ক্ষার, Amalgum (মিশ্রণ), Borax (সোহাগা) প্রভৃতি রসায়নের বহু শব্দ আরবি ভাষা থেকে উদ্ভূত।
বিশ্বসভ্যতায় আরবীয় দান অপরিসীম। আরবীয়দের গৌরবময় অধ্যায় শেষ হলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের (ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদও বলতে পারেন) সূচনা হয়। ইসলামি সভ্যতাকে হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে খ্রিস্টান পণ্ডিত সমাজ কোমর বেঁধে সমালোচনার আসরে নেমেছিলেন। তাঁদের এই সর্বনাশা ষড়যন্ত্রকে দার্শনিক মনীষী ড্রেপার (Draper) ঘৃণাভরে পরিত্যাগ করেছেন। এই অপপ্রচারের বিরুদ্ধে স্যার সৈয়দ আমির আলি জানপাত লড়াই করেছিলেন। ‘The History of Saracens’ এবং ‘The spirit of islam’ গ্রন্থের মারফত ইউরোপীয় খ্রিস্টান পণ্ডিতদের অপচেষ্টাকে ধ্বস্ত করে দেন। বিজ্ঞান সম্পর্কে ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিস্তর আলোচনা প্রখর প্রতিভাধর পণ্ডিতবর্গ করেছেন। এ সম্পর্কে কয়েকজন মহামনীষীর উদ্ধৃতি দিয়ে বর্তমান আলোচনাটি শেষ করা গেল: ১. অধ্যাপক ক্যাম্পবেল মন্তব্য করেছেন, ‘আরবীয়রা বিজ্ঞানের উদ্গাতা। কি গ্রিস, কিংবা রোম- এঁদের কেউই আধুনিক বিজ্ঞানের পথিকৃৎ ছিলেন না। আরবীয়রাই বিজ্ঞান চিন্তার ব্যাপক প্রসার ঘটিয়েছিলেন।
২. জি.পি.স্কট, ‘Moorish Empire in Europe’ নামক গ্রন্থে বলেছেন, প্রাচীনকালে কিংবা আধুনিক যুগে, মানসিক উৎকর্ষতায় আরবীয়রা ছাড়া এত দুর্বার ও ফলপ্রদ প্রভাব কেউ বিস্তার করতে পারেননি।
৩. মারকুইস অব ডাফরিন বলেছেন, ‘আরবীয়দের বিজ্ঞান, শিল্প ও সাহিত্যের অতুলনীয় অবদানে ইউরোপের জীবন থেকে অন্ধকার অপসৃত হয়েছিল। ইউরোপ ইসলামি আরবের কাছে ঋণী।
৪. মহান সমাজবিজ্ঞানী, রাডিকাল হিউম্যানিস্ট, রাজনীতিবেত্তা এম.এন. রায়ের অনুভব: ‘লারনিং ফ্রম দি মুসলিম, ইউরোপ বিকেম দি লিডার অব মডার্ন সিভিলাইজেশন।’
৫. ‘দ্য মেকিং অব হিউম্যানিটি গ্রন্থে রবার্ট ব্রিফলট বলছেন, আরব সভ্যতা ব্যতিরেকে আধুনিক ইউরোপীয় সভ্যতার উত্থান সম্ভব হত না।
৬. ‘শেষের দিকের সমস্ত ধর্মের মধ্যে ইসলামই হল সর্বোত্তম’। এম.এন. রায় পৃ. ৭৬।
উপসংহার
শুধু বিজ্ঞানই নয়, আরও বহুবিধ আরবীয় প্রভাব ইউরোপীয় সমাজ জীবনে পড়েছিল। অর্থনীতি, সমাজনীতি, উচ্চশ্রেণির জ্ঞানচর্চা, সভ্যতা, মানসিক সমৃদ্ধি, অভ্রান্ত শিক্ষাপদ্ধতি- সবক্ষেত্রে ইউরোপে আজ যে বিস্ময়কর উন্নতি পরিলক্ষিত হয়, এর মূলে রয়েছে মুসলমান উদ্ভূত জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চার ধারাকে সার্থকভাবে অনুসরণের তীব্র প্রয়োজনীয়তা ও বোধশক্তি।
সূত্র: 1. The Radiance Views weekly, 2. The Islamic Review.
3. অন্যবিধ তথ্যসূত্র আলোচনার মধ্যেই রয়েছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct