দিলীপ মজুমদার: অরণ্যের সন্তান আদিবাসীদের কথাকার মহাশ্বেতা দেবী। ‘সুরজ গগারাই’ , ‘চোট্টি মুণ্ডা ও তার তীর’, ‘টেরোডাক্যাটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা’, ‘কবি বন্দ্যঘটী গাঞির জীবন ও মৃত্যু’,‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসগুলিতে গভীর আন্তরিকতায় তিনি আদিবাসীদের জীবনকথা পরিবেশন করছেন। তাঁর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের নায়ক বীরসা মুণ্ডা। অরণ্য ও আরণ্যক মানুষকে বাঁচাবার প্রেরণা লাভ করে সে। অরণ্য যেন তাকে বলে, ‘মোরে বাঁচা বীরসা’। তাই বীরসা জীবন-পণ লড়াই শুরু করে।
বীরসার শত্রু হল ‘দিকু’রা। কাদের বলে দিকু? বলে বহিরাগত শত্রুদের। এরা উচ্চবর্গের মানুষ। এদের মধ্যে দেশি মানুষ আছে. আছে বিদেশি মানুষ। সরকারি মানুষ আছে; আছে বেসরকারি শিল্পপতি, বণিক, খনির মালিক, জমিদার, যাজক, মিশনারি প্রমুখরা। এরা অরণ্য ও আরণ্যক মানুষদের শোষণ করে। এদের বিরুদ্ধে বীরসা ও তার অনুগামী বীরসাইতদের লড়াই। অসম লড়াই, তবু আশ্চর্য মনোবল বীরসাদের।
‘অরণ্যের অধিকারে’ মহাশ্বেতা পরিবেশন করেছেন ইংরেজ আমলের কাহিনি। তারপরে স্বাধীন হয়েছে দেশ। কিন্ত বন্ধ হয়নি অরণ্যের উচ্ছেদ। বন্ধ হয়নি আরণ্যক মানুষদের উপর অত্যাচার। আদিবাসীরা ঘৃণা-অবজ্ঞা-শোষণ থেকে মুক্তি লাভ করে নি। ‘দিকু’ তখন যেমন ছিল, আজও তেমনি আছে। আজ আবার রাষ্ট্রশক্তি ছদ্মবেশী ‘দিকু’র মতো হাজির রঙ্গমঞ্চে, হাতে তার আইনের অস্ত্র। মানুষের জন্য আইন নয়, আইনের জন্য মানুষ। আর আইন কার স্বার্থরক্ষা করে ? করে আধুনিক ‘দিকু’দের স্বার্থ।
মহাশ্বেতা দেবী বেঁচে থাকলে স্টান স্বামীকে নায়ক করে নিশ্চয়ই রচনা করতেন উপন্যাস। স্টান স্বামী যেন এ কালের বীরসা মুণ্ডা। স্টান স্বামী জেসুইট যাজক। ধার্মিক মানুষ। কিন্তু তাঁর ধর্মের মূল কথা ছিল মানবসেবা। তাই গির্জার চার দেওয়ালের মধ্যে তিনি বন্দি থাকতে পারেননি। দীন দরিদ্র, শোষিত বঞ্চিত আদিবাসীদের জীবনে জ্বালিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন আলোকবর্তিকা। বিনা বিচারে বন্দি আদিবাসীদের কি ভাবে মুক্ত করা যায়, তার ব্যবস্থায় তৎপর ছিলেন ফাদার স্টান স্বামী।
মহাশ্বেতা দেবীর নায়ক বীরসার মৃত্যু হয়েছিল জেলে। উপন্যাসটির শুরু হয়েছে রাঁচি জেলে বীরসার মৃত্যু দিয়ে। কিন্তু সে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। প্রলম্বিত হল বিচার। সাক্ষ্য সংগ্রহের অজুহাতে। জেল কর্তৃপক্ষ জানালেন এশিয়াটিক কলেরায় মৃত্যু হয়েছে বীরসার, কিন্তু প্রকৃত সত্য হল বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল বীরসাকে। স্টান স্বামীর মৃত্যুও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। অশীতিপর এই মানুষটিকে ভীম কোরেগাঁও মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়।। কারণ মানবাধিকার নিয়ে কথা বলেছিলেন তিনি। আনন্দ তেলতুম্বড়ে, সোমা সেন, সুধা ভরদ্বাজ, ভার্নন গনজালভেস, ভারভারা রাওএর মতো তাঁকেও ‘আরবান নকশাল’ বলে দেগে দেওয়া হয়েছিল। পারকিনশনের রোগী স্টান স্বামী। জেলখানায় কোভিডে আক্রান্ত হলেন তিনি। তাঁকে জামিন দেওয়া হল না। আদালতের নির্দেশে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হল। গত ৫ জুলাই মুম্বাই হাই কোর্ট যখন তাঁকে বেল দেবার অনুমতি দেবেন বলে স্থির করেছেন, তখন তাঁর আইনজীবী মিহির দেশাই বললেন, বেলের দরকার নেই আর; কারণ স্টান স্বামী মৃত্যুবরণ করেছেন।
অভিযোগ উঠে্ছে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেটিভ এজেন্সি আর জেলখানার আচরণ নিয়ে। এঁরা অবশ্য কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করেছেন। বারবার তাঁর জামিনে বিরোধিতা করেছেন এন আই এ-র আইনজীবীরা। তাঁকে আটকে রেখেছে তালোজা জেলে। যে আচরণ করেছেন জেলখানার কর্তারা, তাতে কি জেলকে সংশোধনাগার বলা যাবে ?
কোমরে শেকল, পায়ে শেকল বাঁধা মহাশ্বেতার বীরসা মুণ্ডা বলেছিল তার সহযোদ্ধাদের: ‘ সাহস ছেড়ো না হে ... সকল হাতিয়ার তোমাদের দিয়াছি, বুকে সাহস দিয়াছি, চিনায়ে দিয়াছি কে তোমাদের দুশমন। সে হাতিয়ার তোমরা সঁপে দিও না , একদিন তোমরা জিতবে।’
স্টান স্বামী বীরসা মুণ্ডা নন। তবু তিনিও যেন নীরবে বীরসার কথাগুলি বলে যান আমাদের।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct