সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ২ কিস্তি ৩
(মসলন্দপুরে নাটক প্রতিযোগিতায় পরাজয়ের পর প্রশান্ত মাষ্টারের ডাকা ঘরোয়া মজলিসে নতুন মূল্যায়ন শুরু হয়েছে। সেখানেই দেখা গেছে আলিম নামে এক বৃদ্ধের উপস্থিতি। কে এই আলিম? এ উপন্যাসে দ্বান্দ্বিক সূত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী? তা নিয়ে কুশিলবরা কী সকলে একমত? ভিতরে বহুজাতিক সংস্থার দেশবিরোধী কালো ছায়া দেখেও পল্লব তা কাউকে বলতে পারল না কেন? প্রশ্ন অনেক। পড়তে পড়তে উত্তরগুলো জানুন।)
পল্লব এতক্ষণ দোরের আড়ালে দাঁড়িয়ে রিয়ার্সের মজা অনুভব করছিল। সেদিনের ব্যর্থ আসিফ রিয়ার্সের সময় আজ যেন অন্য অভিনেতায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে। নিজেকে যে অনেকখানি পাল্টে নিতে পেরেছে সেকথা ভেবে গর্বিত পল্লব তালি দিতে দিতে ঘরের ভিতরে ঢুকল। চড়া সুরের অভিনয় থেমে গেল পল্লবের হঠাৎ উপস্থিতিতে। সকলের মুখে বিশেষ ভাবগম্ভীরতার বিস্তার। আসিফের মুখে তিতুমীরের মুক্তির বাণী তখনও ঘরের ভিতরে ইকো হয়ে ঘুরছে। আসিফ দুচোখ স্থির করে চেয়ে থাকল পল্লবের দিকে। তার মধ্যে অপরাধ প্রবণতার বান ঢুকছে হুড়মুড়িয়ে। সে যে পল্লবদার ইচ্ছে মসলমপুরে পূরণ করতে পারে নি, সেই বিতৃষ্ণা গ্রাস করছে। সুমন একটু হেসে বলল, আসতে এত দেরী করলে যে?
পল্লবের হাতে চায়ের কাপ। তখনও গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে। এদিক ওদিক বারদুই দেখে নিল। নাট্যসংস্থা গড়ার স্বপ্নটা যেন বাস্তবমুখী হয়ে ঘরের মধ্যে নতুন করে আশ্রয় পেতে চাচ্ছে। আরও পরিশ্রম করতে হবে। আরও সময় দিতে হবে। আরও সংহতি গড়ে তুলতে হবে। তবেই সম্ভব স্বপ্নকে পুরোপুরি বাস্তবে নামিয়ে আনা। থম মেরে মেঝেতে বসল। চায়ের পেয়ালায় মনের খুশিতে চুমুক দিতে থাকল। তার ভিতরে ইতিহাসখ্যাত তিতুমীর তখন নতুন প্রত্যাশায় উদ্বেল। শুধু আসিফ নয়, সুমন সহ সকলে চেয়ে থাকল পল্লবের মুখের দিকে। তারা কিছু শুনতে চায়। চা খাওয়া শেষ হলেই পল্লব ভিতরের পরিবেশকে মুখর কথায় মাতিয়ে তুলল। —মসলমপুরে খারাপ ফলের জন্য শুধু একা আসিফকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। সকলে যে সত্যটা মুখ ফুটে বলতে পারে নি, তা আমাকে বলতে হবে। আমি ঠিকমতো সময় দিতে পারি নি এবং সেটাই পরাজয়ের মূল কারণ। পূর্ণতা আসে পরিপূর্ণ অনুশীলনের মাধ্যমে। তা দিতে পারি নি বলেই এতটা খারাপ ফল হয়েছে। দিতে পারলে ফলাফল অন্যরকম হত। প্রসঙ্গ পাল্টে দিয়ে বলল, দেখছি এখনও কেউ কেউ আসে নি। সময়মতো না এলে তো— বাক্যটা শেষ না করে সুমনের দিকে তাকাল।
তরুণ আজ আসতে পারবে না। অসুস্থ বাবাকে নিয়ে ডাক্তারখানায় যেতে হয়েছে। বাবার জন্যে তার মন ভালো নেই। রফিকও আসতে পারবে না। মায়ের নির্দেশে তাকে মামার বাড়িতে যেতে হয়েছে। না গিয়ে নাকি উপায় ছিল না। ফিরতে ফিরতে বেশ রাত হয়ে যাবে। তবে না আসতে পারার জন্যে দুঃখ প্রকাশ করেছে আমার কাছে। সেও চাচ্ছে, তোমার ইচ্ছের পূর্ণ মূল্য দিতে। জয়ার টিউশনি আছে। বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে, টিউশনি নষ্ট করে নাটক করা চলবে না। তপতীর গানের পোগ্রাম রয়েছে। আসরে গান গাওয়ার সুযোগ সে হাতছাড়া করতে চাচ্ছে না। নিজে কতটা শিখেছে, তা শ্রোতাদের সমর্থনে যাচাই করে নিতে চায়।
পল্লবের মনের আকাশে বিরক্তির থোকা থোকা মেঘ। এত বেশি সংখ্যায় অনুপস্থিত থাকলে ঠিকমতো রিয়ার্স করা সম্ভব নয়। অনুশীলনের জায়গা এভাবে শূন্য থাকলে মূল দিনে ফলাফল কখনো ভীষণ উচ্ছ্বাসের হতে পারে না। পরের বছর আবার মসলমপুরে একাঙ্ক নাটক প্রতিযোগতার আসর বসবে। আর তো হেরে যাওয়া যায় না। আসিফের অমনোযোগী হওয়ার কারণে যে পজিশন পাওয়া সম্ভব হয় নি, সেই দৃষ্টান্তে পল্লব মনে মনে ভীষণ তেতে রয়েছে। এত সহজে ছাড়লে চলবে না। নাট্যসংস্থার নাম ‘সোপান’ তাই সর্বশ্রেষ্ঠ সম্মান তাদের অর্জন করতেই হবে। এ ভাবনার ফাঁক গলে আরেকটা নতুন প্রসঙ্গ পল্লবের মনের ইজেলে ভেসে উঠল। —আচ্ছা সুমন, ওরা কী না আসার কারণ জানিয়ে রিপোর্ট করেছে, নাকি কিছু বলে নি?
আগে যাদের কথা বলেছি, তাদের না আসার কারণও বলে দিয়েছি। অমিত আসতে পারবে না। গতকাল থেকে তার এত জ্বর যে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। নিজে আসতে পারবে না বলেই পাড়ার একজনকে দিয়ে খবরটা আমাকে জানিয়ে দিয়েছে। জিৎ কী করবে জানি না। সে তো এখনও আসে নি। দেরি করে আসতে পারে। না আসলে ভাবব, একমাত্র জিৎ কারণ না দেখিয়ে অনুপস্থিত থাকল।
যারা আছে, তাদের নিয়ে কী রিয়ার্স শুরু করা সম্ভব?
সুমন মাথা নাড়ল। একেবারে সদর্থক।
তাহলে শুরু করা যাক। শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ নেই। প্রত্যেকে একটা দৃষ্টান্ত মনে রেখো, মসলমপুরের পরাজয় পার হয়ে আমরাও পারি নতুন জয়লাভ ছিনিয়ে আনতে।
সকলে ডুবে গেল রিয়ার্সের মধ্যে। পল্লব বসে বসে রিয়ার্সের মজা উপভোগ করছে। ভুলত্রুটি হলে তৎক্ষণাৎ তা শুধরে দিচ্ছে। তাদের জিততেই হবে। হয়তো তিতুমীর ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিততে পারেন নি, কিন্তু তাঁর আত্মবলিদান ভারতীয় স্বদেশভাবনার মূল সূত্রকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পেরেছে। সোপানের ক্ষেত্রেও একটা পরাজয় নতুন জয়লাভের মূল উৎস হয়ে উঠবে না কেন? দুচোখ রিয়ার্সের দিকে রেখে পল্লব ভিতরে ভিতরে তিতুমীরের জীবন উৎসর্গের ভাবনায় ডুবে থাকল।
অধ্যায় ৩ কিস্তি ১
সন্ধের প্রহেলিকা পার হয়ে রাত আটটা। ফাল্গুন বলেই বাতাসের বুকে হিমেল আমেজ। প্রশান্ত মাস্টারের উঠোনে আসর জমে উঠেছে। সকলে মিটমিটে আলোয় মুখোমুখি বসে। অনেক নতুন অতিথি এসে উপস্থিত হয়েছে সেই আসরে। পল্লব, দীপ, আসিফ, দেবু বেশ কিছুক্ষণ আগে এসেছে। সুমন সবে ঢুকেছে। প্রশান্তমাস্টার আয়োজনে এতটুকু ত্রুটি রাখেন নি। স্বাক্ষরতা অভিযানের শিক্ষক। বয়স্ক ছাত্রদের পড়ানোর সূত্রে জনজীবনের সঙ্গে মিশে চলার মন্ত্রকে নিজের আত্মিকতার সাথে যুক্ত করতে পেরেছেন।
তাঁর জীবনের পটপরিবর্তন মনে রাখার মতো। এক সময়ের বেকার প্রশান্ত বয়স্কদের পড়ানোর সূত্রে সকলের কাছে প্রশান্ত মাস্টার হয়ে উঠেছেন। পাওয়ার আগে সকলে তাকে শুধু প্রশান্ত বলে ডাকত। সেই সম্বোধন পর্যায়ক্রমে পাল্টে গেছে। প্রশান্ত ভাই, প্রশান্তদা, প্রশান্তকাকু, ছোটো কাকু, প্রশান্ত ভাইপো, প্রশান্তবাবু প্রভৃতি সম্বোধন চালু হয়েছে পর পর। প্রশান্তর নিজস্ব উপলব্ধি, প্রতিটা স্তরে পরপর নতুন মাত্রা পেয়েছে। বুঝতে পেরেছেন, ভালোবাসা পাওয়া ভালোবাসা দেওয়ার উপরে সম্পূর্ণ নির্ভর করে। আগে উজাড় করে দিতে হয়, তবেই পাওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণতা আসে। উজাড় করা ভালোবাসার প্রতিদানে শুধু বাধ্যতামূলক প্রাপ্ত ভালোবাসা থাকে না, আন্তরিক শ্রদ্ধাও থাকে। নিজের জীবনেও সেই উপলব্ধি চরমভাবে সার্থক হয়ে উঠেছে। এত শ্রদ্ধার পরেও বয়স্ক শিক্ষার্থীরা তাঁকে হার্দিক বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। সেটাই তাঁর জীবনে সবচেয়ে বড়ো পাওনা। নিজেই অনেক বেশি অবাক হয় যখন তার চেয়ে বয়স্ক কেউ তাকে আপনি বলে সম্বোধন করে। জীবন গড়ার স্বপ্ন তুলে আনতে পারলে সম্মান লাভের পথ ধীরে ধীরে রাজপথে পরিণত হয়। বয়স্ক ছাত্ররা সেই রাজপথে নিত্য চলার সাথী হয়ে উঠেছে। নিজেকে পাল্টাতে পাল্টাতে এমন স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছেন, যা শুরুর সময়ে ভাবতে পারেন নি। আজকাল বড়ো কাটআউটের মতো তাঁর প্রতীকী ইমেজ সকলের মন ভরিয়ে রাখে।
হালফিল সময়ে একটা নতুন ভাবনা প্রশান্ত মাস্টারের মাথায় লাট্টুর মতো ঘুরছে। কেবল ভাবছেন, সোপান নাট্যসংস্থাকে কাজে লাগাতে পারলে সাক্ষরতা অভিযানের সাফল্যকে অনেক বেশি ত্বরান্বিত করে তোলা সম্ভব। এ নিয়ে তাঁর মূল ভরসা পল্লবের উপর। ভালো গুরু পেয়েছিল বলেই তার পক্ষে জীবন নিয়ে বড়ো বড়ো ভাবনা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। পল্লবের গুরুর চেহারার মধ্যে রয়েছে সমাজ পাল্টানোর গুরুগম্ভীরতা, অথচ আলাপে শিশুর মতো সরল। দশাসই চেহারার আড়ালে ব্যক্তিত্বের যে প্রকাশ, তা সহজে অন্য সকলের উপর চেপে বসে। একদিন বাজার থেকে ফেরার পথে পল্লবের গুরু হঠাৎ থমকে দাঁড়িয়েছিলেন প্রশান্তর সামনে। হাসিমুখে তার প্রথম প্রশ্ন, কেমন আছ প্রশান্ত?
ভালো আছি কাকু।।
শুনছি, তুমি নাকি পল্লবের সাথে নাটকের আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছ।
তা একরকম সত্যি।
এভাবে বলছো কেন? যেজন্যে যথেষ্ট গর্বিত হওয়া যায়, তা নিয়ে মনের আড়ষ্টতা প্রকাশ করা ঠিক নয়। একটা ভালো কাজের সাথে যুক্ত হয়ে সামাজিক উন্নয়ন চাইলে অবশ্যই সম্প্রীতি বাড়ানোর উপর বিশেষ জোর দিতে হবে। ধর্মবোধের মধ্যেও সম্প্রীতি রক্ষার কথা বলা হয়েছে। বাংলার কবি বলেছেন— একবৃন্তে দুটি কুসুম, এসব কী নাটকের মধ্যে দেখানো যায় না? সাক্ষরতা কাজের সাথে যুক্ত থাকার সূত্রে তুমিও পারো সমাজের বুকে সম্প্রীতির নতুন বাতাবরণ তৈরি করতে।
শুনতে শুনতে প্রশান্তর মধ্যে নতুন আবেগ তৈরি হয়েছিল। তাতেই ভেসে গিয়েছিলেন প্রশান্ত মাস্টার। পল্লবের গুরুর কাছে আরও কিছু শোনার ইচ্ছায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগ হঠাৎ শেষ হয়েছিল। স্টপেজে বাস থামলেই পাদানিতে পা রেখে চলতে শুরু করলেন। প্রশান্তর প্রতি তার শেষ বার্তা, আবার দেখা হবে বাপ। সম্প্রীতির প্রচারে উত্তরপ্রদেশে যাচ্ছি, কবে ফিরব জানি না।
প্রশান্ত দুচোখ বড়ো করে চেয়েছিলেন সামনে চলা বাসটার দিকে। তার ভিতরে সম্প্রীতির বার্তা ঢুকছিল হু হু করে। পল্লব সম্পর্কেও নতুন মূল্যবোধ জেগে উঠছিল তার মধ্যে। নাটকের জন্যে তার যে আন্তরিক প্রয়াস, তার পিছনে প্রশান্তর মহান গুরুর অনুপ্রেরণা দেখতে পেয়েছিলেন। গুরুর জীবন এত উন্নত বলেই নাটকে দেশপ্রেম জাগাতে পল্লবের হার্দিক প্রয়াস মনে রাখার মতো। তার নাট্যভাবনা যেন গুরুর পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct