জাফিরা হক: ভোজন রসিক বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসা একটু বেশিই। সেই প্রাচীন কাল থেকেই মাছের প্রতি এই ভালোবাসার কারণে বাঙালিদের ‘মাছ খেকো’ বলে অনেকে দুর্নামও করেছেন। মাছ আর ভাত বাঙালির কাছে অমৃত থেকে কিছু কম নয়।কথাই আছে “বাঙালি আবার মাছ খাবে না “বাঙালি বলে কথা ।
মাছের সাথে বাঙালির এই সখ্য অনেক পুরনো তবে ঠিক কোন সময় থেকে এই মাছ খাওয়া চালু হয়েছে তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য সেইভাবে পাওয়া যায় না। তবে খাল, বিল, নদী, নালার দেশ বাংলায় মাছ বোধহয় আগাগোড়াই খাওয়া হত। প্রাচীনকালে বেশ কিছু নিদর্শনও পাওয়া যায় সেগুলি থেকে আমরা বাঙালির মাছ খাওয়ার ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা গড়তে পারি। যেমন, চন্দ্রকেতু গড়ে মাছের ছবি সহ মাছের ফলক পাওয়া গেছে। তাছাড়া অষ্টম শতাব্দী থেকে পাহাড়পুর এবং ময়নামতিতে যেসব পোড়া মাটির ফলক তৈরি হয় তার অনেকগুলোতে মাছের ছবি আছে। এমনকী মাছ কোটা এবং ঝুড়িতে করে মাছ নিয়ে যাওয়ার ছবিও আছে। যদিও সেই সময়কালে কিন্তু ভারতবর্ষে অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের কাছে মাছ ততটা জনপ্রিয় ছিল না।মাছ কে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলেও তা তাদের কাছে কখনোই প্রিয় খাদ্য ছিলনা।
আরো প্রাচীন বেশ কিছু গ্রন্থেও বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসার পরিচয় পাওয়া যায়। দ্বাদশ শতকে বা তার কিছুকাল পরে রচিত উদ্ভট শ্লোকে মাছের বিশেষ করে কই মাছের গুণকীর্তন করা হয়েছে। সেকালের সাহিত্য থেকে কেবল বিচিত্র ধরনের মাছের নামই জানা যায় তা নয়, সেই সঙ্গে আরও জানা যায় খাদ্যের স্বাদ বৃদ্ধির জন্য কত বিচিত্র ভাবে মাছ রান্না করা হত। বাংলা ভাষায় লেখা প্রাচীন রান্নার বই ‘পাক প্রণালী’তেও মাছ রান্নার নানা কৌশলের বর্ণনা পাওয়া যায়। মধ্যযুগের সাহিত্যে বিশেষ করে ভারতচন্দ্র ও ঈশ্বর গুপ্তের লেখা থেকেও বিভিন্ন ধরনের মাছের কথা জানা যায়।যে সকল মাছ আজ বাঙালির প্রিয়।
যদিও বাঙালিদের এই মাছ ভক্তিকে অনেকেই আবার খুব একটা পছন্দ করতেন না। যেমন, সর্বানন্দ তার টিকা সর্বস্বে একপ্রকার দুর্নামই করেছেন বলা যায়। শুটকি মাছ হল নিম্ন বঙ্গের লোকেদের প্রিয় খাদ্য। তিনি এজন্য বাঙ্গালদের ‘শুটকি খেকো বাচ্চার’ বলেছেন। বাংলায় যে মুঘল কর্তারা বাস করতেন তারাও বাঙালিদের মাছ ভাত খাওয়াকে একপ্রকার অপছন্দই করতেন। তবে এই দুর্নাম বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসায় কোনো কমতি আনতে পারেনি। বরং, যত দিন গিয়েছে বাঙালির মাছের প্রতি প্রীতি আরো প্রবল হয়েছে।
সেই প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে বাঙালির মাছের প্রতি ভালোবাসা আজও সমানভাবে বর্তমান। আজকের দিনে বিরিয়ানির বাজারেও বাঙালির মাছ খাওয়ার প্রতি ভালোবাসা কিন্তু একটুও কমেনি। সেখানেও বাঙালি তার নিজের মতো করে ইলিশ মাছের বিরিয়ানি বা চিংড়ির বিরিয়ানির মতো পদ ও সৃষ্টি করে ফেলেছে।আজও বাঙালির ঘরে ঘরে মাছের বিভিন্ন পদ সমানভাবে জনপ্রিয় তা সে এপার বাংলা হোক বা ওপার বাংলা।ইলিশ চিংড়ির দৈরথ সবসময় ই লেগে থাকে বাঙালির মধ্যে। আর ইলিশের মরশুমে মাছের প্রতি বাঙালির এই ভালোবাসা যেন একটু বেশিই বেড়ে যায়। দাম আকাশছোঁয়া হলেও ইলিশ খাওয়ার ব্যাপারে বাঙালি কোনো প্রকার আপস করতে রাজি নয়। তাই ঈশ্বর গুপ্তের ভাষায় বলা যায় ‘ভাত মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল’।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct