‘আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’
সাঁওতাল হুল: ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ
আব্দুল মাতিন: ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সাঁওতাল হুল দিবস। প্রচলিত ইতিহাস চর্চায় অধিপতিশীল জ্ঞানকাঠামো এ বিদ্রোহের প্রাপ্য স্বীকৃতি না দিলেও ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামের একটি বিশেষ এবং উজজ্বলতম দিন। সাঁওতাল বিদ্রোহ ছিল মূলত বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রথম সংঘটিত প্রতিবাদ। ভারতের কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাসের এ এক অতুলনীয় অধ্যায়। যে প্রকার শাসন, শোষণ ও উৎপিড়ন থেকে পরাধীন জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের সৃষ্টি হয় ১৯৫৫ সালের সাঁওতাল বিদ্রোহ সে ধরনের শোষণ অত্যাচারেরই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি। ১৮৫৫-৫৭ সাল পর্যন্ত এ বিদ্রোহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিহার, উরিষ্যা এবং বাংলাদেশ পর্যন্ত প্রসার লাভ করেছিল। সাঁওতাল বিদ্রোহের তীব্রতা ও ভয়াবহতায় ইংরেজ শাসনের ভীত কেঁপে উঠেছিল। লর্ড ডালহৌসি কতৃক মার্শাল ল’জারি করেও এ বিদ্রোহ দমন করা যায়নি। অসম যুদ্ধের ফলস্বরুপ, এ বিদ্রোহে সাঁওতালদের পরাজয় ঘটলেও, বৈদেশিক শাসন এবং দেশিয় সামন্ত্রতান্ত্রিক শোষণের মূলৎপাটন করার লক্ষ্যে পরিচালিত এ বিদ্রোহ ভারতবর্ষের মানুষের মনে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী চেতনা জাগ্রত করেছিল, সে চেতনার আলোতেই উদিত হয়েছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য। অথচ সাঁওতাল বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ আজও আসেনি পাদপ্রদিপের আলোয়। নিষাদ জাতির অন্তর্ভুক্ত সাঁওতালদের আদি বাসভূমি যে ভারতবর্ষ তাতে নৃবিজ্ঞানিরা সন্দেহ পোষণ করেননি। বীরভূম, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ অঞ্চলে অবস্থান করলেও সবচেয়ে বেশি সাঁওতাল বাস করত ভাগলপুরের দামিন-ই-কোতে। বহু কষ্ট করে বন সাফ করে শ্বাপদ-সংকুল দামিন-ই-কোতে তারা জনপদ গড়ে তুলেছিল। অতীতে যে মাটিতে মানব বিচরণই ছিল না সে মাটিতে তারা ফলিয়েছিল সোনালী ফসল। নিজেদের আলাদা একটা জগত তৈরি করেছিল তারা। যেখানে ছিল না কোনো মহাজন-জমিদার-দালাল, ছিল না কোনো ঋণগ্রস্ত কেউ। দামিন-ই-কোর সমৃদ্ধির খবর ছড়িয়ে পড়লে দলে দলে সেখানে আগমন ঘটে ব্যবসায়ী ও মহাজন শ্রেণির। তারা ব্যবসার নামে বিনিময়ের সময় সহজ করল সাঁওতালদের চরমভাবে ঠকানো শুরু করল। কিছু চাল, কিছু অর্থ বা অন্য দ্রব্য ঋণ দিয়ে সমস্ত জীবনের জন্য সাঁওতালদের ভাগ্যবিধাতা ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে বসল মহাজনরা। ফলে পাথুরে জমিতে সাঁওতালদের অশেষ পরিশ্রমে ফলানো ফসল, যা তারা প্রাণ দিয়ে রক্ষা করতো, বন্য হাতি, শুকর ও অন্যান্য জীবজন্তুর হাত থেকে, তা তুলে দিত মহাজনদের হাতে। তবু শোধ হতো না ঋণ। কোনো চাষী মহাজনের হাতে ফসল তুলে দিতে অস্বীকার করলে, মহাজনেরা দেওঘর আদালতে ঘুষ দিয়ে আনত ক্রোকি পরোয়ানা। আদালতের পেয়াদার উপস্থিতিতে তখন নিজের সর্বনাশ দেখা ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকতো না সাঁওতালদের। ঋণ দেওয়ার সময় মহাজনরা যত টাকা দিত, লিখিয়ে নিত তার চেয়ে অনেক বেশি। এবং ঋণ পরিশোধের সময় সুদসমেত আসল টাকা আলাদা আলাদা দিতে হতো। ফলে সব দিয়েও অনেক সময় শোধ হতো না মহাজনের ঋণ। তখন তারা বাধ্য হত নিজেকে বন্ধক দিতে এবং মহাজনের ক্রীতদাসে পরিণত হতে। বিনা পারিশ্রমিকে খাটতে খাটতে তাদের জীবন শেষ হয়ে যেত। এবং পরবর্তি বংশধরের জন্য রেখে যেত মহাজনের একগাদা ঋণ। সঙ্গে যুক্ত হলো ইংরেজদের খাজনা এবং স্থানীয় জমিদারদের লোলুপ দৃষ্টি। সাঁওতালদের জমি গ্রাস করার বিভিন্ন উপায় খুঁজত তারা। এই অমানবিকতার প্রতিকার সাঁওতালদের হাতে ছিল না। এবং আদালতেও সুবিচার লাভ তাদের পক্ষে একপ্রকার অসম্ভব ছিল। নিপীড়ন নিষ্পেষণের জালে আটকে যাওয়া এই সহজ সরল মানুষগুলোর আদতে মুক্তির কোনো পথ খোলা ছিল না। ফলে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাস্বরুপ তারা বিদ্রোহে অংশ নেয়। ১৮৫৪ সালের শেষে আর ১৮৫৫ সালের শুরুতে সাঁওতালরা একটি সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা মহাজনদের আর লাভের বখরা নিতে দেবে না। গরিব দিনমজুর সাঁওতালরা ঠিক করেছিল তারা আর কৃতদাসত্ব করবে না। এই অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে বিশেষ মানুষ যখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে ওঠে, তখন নেতার আভাব হয় না। সেই সময় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদের মধ্যে থেকেই ত্রাণকর্তারুপে আবির্ভূত হন বিদ্রোহের নায়ক, নিষ্কলুশ চরিত্রের চার ভাই সিধু, কানু, চাঁদ ও ভৈরব। তারা সাঁওতালদের বিদ্রোহের জন্য অনুপ্রাণিত ও সংগঠিত করেন। ১৮৫৫ সালের ৩০জুন। ভাগনদিহিতে চারশ গ্রামের দশ হাজার সাঁওতাল এক সমাবেশে উপস্থিত হয়। সিধু সমাবেশে ইংরেজ ও জমিদার মহাজন কর্তৃক তাদের উপর নির্মম নিপীড়ন ও করুণ কাহিনি তুলে ধরে বক্তব্য দেন। সমগ্র জনসভা সে সময় বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইংরেজ ও জমিদার শ্রেণিকে উৎখাত করে স্বাধীন সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠার শপথ নেয় তারা সমাবেশ থেকে। এই সমাবেশ থেকেই ইংরেজ সরকার, কমিশনার, দারোগা, ম্যাজিস্ট্রেট ও জমিদারদের নিকট চরমপত্র প্রেরণ করা হয়। দারোগা ও জমিদারদের নিকট পনেরো দিনের মধ্যে জবাব দাবি করা হয়। এক পর্যায়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার সাঁওতালের এক বিশাল মিছিল বড়লাটের কাছে অভিযোগ পেশ করার উদ্দেশ্যে কলকাতা অভিমুখে যাত্রা করে। এ অভিযানে সাঁওতালদের সঙ্গে যোগ দেয় অন্যান্য ধর্মের শোষিত, নিপীড়িত মানুষজন।
সাঁওতালদের এ সমবেত অভিযাত্রার কথা শুনে শোষক শ্রেণির মহাজন জমিদার ভীত হয়ে পড়ে। তারা দারোগা মহেশলাল দত্তকে ঘুষ দিয়ে সিধু, কানুকে গ্রেপ্তার করার জন্য প্রোরোচিত করে। দারোগা সিধু ও কানুকে চুরি ও ডাকাতির অভিযোগে গ্রেপ্তার করতে গেলে সাঁওতাল বিদ্রোহীরা বাধা দেয়। দারোগা জোরপুর্বক সিধু ও কানুকে গ্রেপ্তার করতে গেলে বিদ্রোহীরা সেখানেই মহেশলাল দত্ত, মহাজন মানিক মুদি সহ ১৯ জনকে হত্যা করে। কানু ঘোষণা দেন, ‘বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেছে, এখন আর কোনো হাকিম নেই, ইংরেজ নেই, সরকার নেই। সাঁওতালদের রাজত্ব এসে গেছে’। বিক্ষুদ্ধ সাঁওতালরা বহু থানা, ইংরেজ সৈন্যদের ঘাঁটি, নীলকরদের কুঠি আক্রমণ ও ভষ্মীভূত করে। সমগ্র বিহার, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে সাঁওতালদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ইংরেজ সরকার এ আকস্মিক বিদ্রোহের প্রচণ্ডতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে। অবশেষে মার্শাল ল’ জারির মাধ্যমে পনেরো হাজার সৈন্য, অশ্বারোহী বাহিনী, কামান বাহিনী ও হস্তি বাহিনী দ্বারা বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালানো হয়। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। প্রচণ্ড বর্বরতায় উন্মত্তহাতি ছেড়ে দেয়া হয় সাঁওতাল নারী ও শিশুদের মধ্যে। কামান ও বন্দুকের সামনে টিকতে না পেরে বিদ্রোহীরা গভীর জঙ্গলে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এভাবে ৩০ হাজার সাঁওতাল বিদ্রোহীকে বর্বরোচিতভাবে হত্যা করে ইংরেজ বাহিনী। ভাগলপুরে এক ভয়াবহ বন্দুক যদ্ধে বিদ্রোহের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নায়ক চাঁদ ও ভৈরব নিহত হন। ১৮৫৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইংরেজ বাহিনী সিধুকে ধরে ফেলে সঙ্গে সঙ্গেই হত্যা করে। কানু বীরভূম জেলায় একদল পুলিশ কর্তৃক ধৃত হলে তাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। পরাধীন শৃঙ্খলিত ভারতবর্ষের সাঁওতাল বিদ্রোহের শ্রোষ্ঠ নায়ক সিধু, কানু এভাবেই স্বাধীনতার জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে গেছেন। সাঁওতাল বিদ্রোহ নিপিড়ীত মুক্তিকামী মানুষের চিরদিনের প্রেরণার উৎস। এ সংগ্রামে পরাজয় ছিল কিন্তু আপোষ ছিল না। বিদ্রোহীরা নির্ভয়ে মৃ্ত্যুকে আলিঙ্গন করেছে কিন্তু আত্মসমর্পন করেনি। বিদ্রোহীদের আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী প্রেরণা জুগিয়েছে ভরতবর্ষের পরবর্তী সকল স্বাধীনতার আন্দোলনে। ফাঁসির মঞ্চে কানুর দৃপ্ত উচ্চারণ ছিল, ‘আমি আবার ফিরে আসব, সারা দেশে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে তুলব’। তার এ কথা সত্য হয়েছে ক্ষুদিরাম, মাস্টারদা সূর্য সেনদের আত্মত্যাগে। সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রমান করে দিয়েছে মুক্তির সংগ্রাম কেনো দিন শেষ হয় না। মানুষ যতদিন থাকবে শোষণ মুক্তির সংগ্রাম চলবে ততদিন। সাঁওতাল বিদ্রোহের পর কেটে গেল ১৬৬ বছর। মেঘে মেঘে অনেক বেলা গড়ালেও বদলায়নি সাঁওতালদের ভাগ্য। তারা থেকে গেছে শোষিতের কাতারে। কালে কালে শুধু বদলেছে শোষকের পরিচয়। আজও অর্থনৈতিক শোষণের পাশাপাশি সামজিক শোষণ, বঞ্চনা ও অস্পৃশ্যতার শিকার এ দেশের আদিবাসী সাঁওতাল জনগোষ্ঠী। নানা সময়ে জর্জরিত তারা।
লেখক: গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct