সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ 6:শেষ কিস্তি
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
আমার কথা শোনো জিৎ, নাটকে দেশ বিদেশ বলে কিছু হয় না। জীবনরসের বিস্তার সব দেশে সমান। সেক্ষেত্রে কোনো ভৌগোলিক সীমা থাকার কথা নয়। তোমাকে একটা উদাহরণ দিই। বীর নেতাজী জন্মসূত্রে ভারতীয়। কর্মযোগ্যতায় তিনিই হয়ে উঠেছেন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি। বিদেশে কেউ যদি উদ্যোগ নিয়ে তার জন্ম দিবস পালনের ব্যবস্থা করেন, তাতে কি আমরা বাধা দিতে পারি? আমরাও বিদেশের যে কোনো মনিষীর জন্মদিবস মহা সাড়ম্বরে পালন করতে পারি। বঞ্চিত মানুষের মুক্তির জন্য নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনব্যাপী যে সংগ্রাম, তাতে কোনো ভৌগোলিক সীমা থাকতে পারে না। ম্যান্ডেলার নামে ভারতে কোনো ক্লাব গড়ে উঠলে আমরা কী তার বিরোধীতা করতে পারি ? একথা ভাবলে তুমিও বিবেক দেবনাথের সাথে ফুসিকের পার্থক্যটা সহজে অনুভব করতে পারবে। আমি সম্পূর্ণভাবে একমত যে রক্তকরবী নাটক দেখে বিবেক দেবনাথ নিজেকে অনেকখানি পাল্টে নিতে পেরেছিলেন। সেই কৃতজ্ঞতায় তিনি চেয়েছেন নাট্য বিপ্লব গড়ে তুলতে। সেই তাগিদে তিনি উইল করে টাকা রেখে গেছেন কিংবা নাট্য সংস্থা গড়ে তোলার জন্যে জায়গা দান করেছেন। এসবের পাশে জুলিয়াস ফুসিকের ব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ধরণের। নাটক নিয়ে তিনি শুধু ভাবেন নি, পৃথিবীর সব মানুষের জন্যে নাট্য আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করে যেতে পেরেছেন। জীবন গড়ার এ অভিনব প্রয়াস সারা পৃথিবীতে আছে, থাকবে। এখন তুমি বলো, কাকে অনুসরণ করে নামকরণ করলে তুমি খুশি হও।
শুধু বড়ো বড়ো কথা বলে আমাদের দেশপ্রেম নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করো না পল্লবদা। ফুসিক আছেন তাঁর দেশে, বিবেক দেবনাথ আছেন আমাদের অন্তরে। তাছাড়া আমরা তো বিশেষ এলাকার মধ্যে একটা ক্ষুদ্র নাট্যসংস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছি। এতে এত মতাদর্শ খোঁজার কী আছে?
মতাদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যেই নাট্য আন্দোলনের সাথে যুক্ত থাকতে হয়। আলো চাই, না অন্ধকার চাই, তা কেবল নাট্যচেতনা ঠিক করে দিতে পারে। চলার পথে ফুসিক কেন গ্রহণীয়, হিটলার কেন নয়, তার পরিচয় মেলে নাটকের দ্বান্দ্বিক চেতনার মধ্যে। ভারতের গণতান্ত্রিক বুনিয়াদের জোরে আমরা আজও সামন্ততান্ত্রিক হিটলারের বিরোধিতা করার সাহস পাই। এভাবেই আমাদের মধ্যে মতাদর্শকেন্দ্রিক মনোভাব বড়ো হয়ে ওঠে। এটুকু না থাকলে জীবন শূন্য কলসির মতো হয়ে যায় জিৎ।
নাটকের দল গড়ার আগে দেশ বিদেশ নিয়ে নতুন নাটক শুরু করলে পল্লবদা? জুলিয়াস ফুসিক ছাড়া যদি চলতেই পারবে না, তাহলে আমাদের ডাকলে কেন? বিবেক দেবনাথ নিয়ে এতক্ষণ যে ভালো ভালো কথা বললে, তার কী কোনো বাস্তব তাৎপর্য নেই? শুধু শুধু এতক্ষণ মিথ্যে সময় নষ্ট করলে আমাদের জন্যে?
পারভিন এগিয়ে এস বলল, আমাদের নাট্য সংস্থার নাম হোক ‘সোপান’।
জিৎ-এর উত্তেজিত প্রশ্ন, কেন?
এতে বিবেক দেবনাথ থেকে যেতে পারলেন, জুলিয়াস ফুসিককে নিয়েও কোনো বিতর্ক থাকল না। অন্য সকলেও সোপানে থাকতে পারেন। জীবনের যে উঁচু সোপান খোঁজার জন্যে আমরা নাটকের দল গড়তে চলেছি, শুরুতে দুটো বড়ো সোপানকে সেই প্রচেষ্টার সাথে আমরা যুক্ত করতে পারলাম।
পল্লব চমকে উঠল পারভিনের উপলব্ধির বহর দেখে। জিৎও বেশ অবাক হল। মুখ ঘুরিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল, পারভিন ঠিক কথাই বলেছে। একটা ছোট্ট প্রসঙ্গ নিয়ে এভাবে নিজেদের মধ্যে বিরোধ করতে আমার এতটুকু ভালো লাগে নি। পল্লবদা জোর করে নিজের ইচ্ছে সকলের উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। জুনিয়র বলে কী আমরা ন্যূনতম গণতান্ত্রিক অধিকার পেতে পারি না? আমাদের কী কোনো মূল্য নেই? স্রেফ হুকুম মেনে চলতে হবে আমাদের? নাটকের ক্ষেত্রে ফুসিক নিশ্চয় সেটা চান নি। পারভিনের মতো জুনিয়র যে প্রসঙ্গটা এত সহজে বুঝতে পারল, পল্লবদা কেন তা বুঝতে চাইল না, তা আমার মাথায় ঢোকে না। এতক্ষণ শুধু শুধু ঘোঁট পাকিয়ে সময় নষ্ট করে দিল।
পল্লব হাসল জিৎকে খুশি করতে। সেই সাথে ধন্যবাদ জানালো পারভিনকে। বলল, মেনি থ্যাঙ্কস টু ইউ। কেবল তোমার জন্যেই আমি জিৎকে মন দিয়ে গ্রহণ করতে পারলাম। আজ থেকে আমরা সকলে ‘সোপান’ নাটক সংস্থার সৈনিক হয়ে গেলাম। জিৎ আমার ছোটো ভাই। ওর গণতান্ত্রিক বোধ এত প্রবল বলেই আমার সাথে নাটকের নামকরণ নিয়ে এভাবে টক্কর দিতে পারল। এটাই জীবনের সোপান। আমার দৃঢ় প্রত্যাশা, জিৎ আগামী দিনে ‘সোপান’ এর মূল প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারবে। সেই যোগ্যতা ওর আছে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডসেক করে বলল, আজ জিৎ এর সাথে আমি হাত মিলিয়ে দিলাম। জিৎ জিতলে আমি জিতব। জিৎ হারলে আমি হারব। সব ক্ষেত্রে জিৎ এর জয়লাভ দেখার জন্যে এখন থেকে মুখিয়ে থাকলাম।
জিৎ না হেসে পারল না, তবে ভিতরে ঝাকুনি লুকিয়ে রাখল খুব গোপনে। নাট্য আন্দোলনের প্রতিটা ধাপে এভাবেই সে পল্লবকে টপকে যেতে চায়। প্রথম দিনের জয়লাভে যেন সেই সূত্রপাত ঘটিয়ে দিল। ভালোভাবেই বুঝিয়ে দিল, জোর দেখালে সেও পারে পল্লবকে মচকে দিতে। ভিতরে ভিতরে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হল, আগামি দিনে সেই অস্ত্রকে সে আরও ধারালো করে তুলবে।
ক্রমশঃ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct