আব্দুল মাতিন: বছর কয়েক আগেও, যখন মানুষের হাতে স্মার্টফোন অতটা সহজলভ্য ছিলো না, ইন্টারনেটের এতো অবাধ ব্যবহার ছিলো না তখন গ্রাম-গঞ্জের তরুণ-যুবাগুলো অবসর পেলে মাঠে বেরিয়ে পড়ত। ফুটবল, ক্রিকেট বা ভলিবল খেলায় মেতে উঠত। কিন্তু আজকের তরুণ ও যবসমাজের চিত্র একেবারেই ভিন্ন। এখন দেখা যায় জটলা বেধে রাস্তার ধারে বসে থাকা তরুণ-যুবাদের করুণ চিত্র! যাদের হাতে একটি স্মার্টফোন এবং তারা তাতে অনলাইন গেইম খেলায় মত্ত! প্রযুক্তির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও আধুনিক অনুষঙ্গ মোবাইল। এর কল্যাণে আমাদের জীবন-যাপনও অনেক সহজ হয়েছে। তবে এর কিছু ক্ষতিকর দিকও ইদানিং উন্মোচিত হচ্ছে বড় আকারে। আর তার অন্যতম একটি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের অনলাইন গেইমের প্রতি প্রবল আসক্তি।
চিকিৎসা বিজ্ঞানের দাবি, ‘শিশুদের হাতে মোবাইল ফোনসহ কোনো ইলেকট্রনিক্স গেজেট দেওয়া উচিত নয়। এতে তাদের শরীরে নানা রোগের জন্ম হয়। মোবাইল ফোন শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। মোবাইল থেকে নির্গত রশ্মি শিশুদের দৃষ্টিশক্তির ভীষণ ক্ষতি করে। যেসব শিশু দৈনিক পাঁচ-ছয় ঘন্টা মোবাইল ব্যবহার করে, খুব অল্প বয়সে তারা চোখের সমস্যায় পড়বে’। সেদিন খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন মোবাইল ফোনকে তামাক জাতীয় দ্রব্যের থেকেও বেশি ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। মোবাইলের প্রতি আসক্তি তরুণদের সামাজিক দক্ষতা নষ্ট করে। ফলে তৈরি হয় তাদের নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এ ছাড়া প্রযুক্তির এ আসক্তি তাদের জীবনে বড় ধরনের দীর্ঘ মোয়াদি নেতিবাচক প্রভাবও ফেলছে। দীর্ঘ সময় স্ক্রিনে চোখ রাখার ফলে চোখের সমস্যা তৈরি হতে পারে। আবার বেশি সময় বসে থাকলে স্থুলতাও বেড়ে যায়। কমে যায় কল্পনাশক্তিও। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোগব্যাধির শ্রেণি বিন্যাসের তালিকায় এই ভিডিও বা অনলাইন গেইমে আসক্তিকে “গেমিং রোগ” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অনলাইন গেইম খেলা কোনো নিষিদ্ধ বিষয় নয়। কিন্তু এর ক্ষতিকর, অযৌক্তিক, অপরিমিত ব্যবহার চিন্তা আর আচরণের ওপর প্রবল প্রভাব ফেলে। এই গেইম খেলার বিষয়টি যখন তার চিন্তা আর আচরণের ওপর খারাপ ধরনের প্রভাব ফেলবে, সামাজিক দক্ষতা কমিয়ে দেবে বা দৈনন্দিন জীবনযাপনের মান খারাপ করে দেবে, তখন তা আসক্তির পর্যায়ে চলে যাবে। অনলাইন গেইমে আসক্তরা বহুবিদ শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় ভুগেন। যার পরিণাম অত্যন্ত ভয়াবহ। যেমন, প্রতিনিয়ত ভিডিও বা অনলাইন গেইম খেললে শরীরে একধরণের হরমোন নিঃসরণ হয়। এতে, আসক্ত ব্যাক্তি সব কিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। মা বাবার অবাধ্য হয়ে যায়। এছাড়াও এই গেইম আসক্তি মানুষের মূল্যবান সময়ের অপচয় করে। পড়াশোনায় অমনোযোগি করে তুলে। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে। আচরণগত ভারসাম্য নষ্ট করে। বিভিন্ন বিষয়ে হতাশা সৃষ্টি করে। সর্বোপরি এই গেইম আসক্তকে উন্নত জীবন গঠনে বাধাগ্রস্ত করে। গেমিং আসক্তির কারণে ঘুমের সমস্যা অনিদ্রা, হতাশা, আগ্রাসন, এবং উদ্বেগের সৃষ্টি করে। অনেক সময় গেইমে এ দেখা যয় যে, চরম সহিংসতার, নিসংসতা এই বিষয়গুলি কিছু কিছু তরুণকে সহিংসতার জন্য অস্থির করে তোলে। অল্প বয়সীদের মধ্যে বাড়ছে হিংসা। ভার্চুয়াল জগতের মোহে তারা সরে যাচ্ছে বাস্তবতা থেকে। এই অভিযোগে একাধিক দেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বেশকিছু গেইম। টেলিকম নিয়ন্ত্রক কতৃপক্ষের দাবি হল, ব্যবহারকারীদের ওপর কুপ্রভাবের জেরেই এই নিষিদ্ধ করণ। তাদের আরো দাবি হল, কিছু কিছু খেলার নিয়মই হল খেলার সময় অন্য খেলোয়াড়দের নৃশংসভাবে হত্যা করা। এই ধরনের গেম-প্লে তরুণদের মধ্যে হিংসার জন্ম দিতে পারে। তাছাড়া ইহা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ও অসহিষ্ণু বা সহ্য ক্ষমতা হ্রাস করে ফেলে। মূলত অনলাইন গেইম আসক্তি অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তির মতোই। পার্থক্য হচ্ছে এটি আচরণগত আসক্তি, আর অন্যান্য নেশাজাত দ্রব্যের আসক্তি, রাসায়নিক আসক্তি। মস্তিষ্কের যে অংশে (রিওয়ার্ড সেন্টার) ইয়াবা বা গাঁজার মতো বস্তুর প্রতি আসক্তি জন্মায় ঠিক সেই অংশেই কিন্তু অনলাইন গেইমের প্রতি আসক্তি জন্মায়। তাই একে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই।
অনলাইন গেইম সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে অত্যন্ত ব্যপকভাবে। পাশাপাশি এইসব গেইমে আসক্ত মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে হু হু করে। গেইমগুলির আসক্তি আপনার জীবনটা বিষিয়ে তুলতে পারে অনেক সহজে। আপনার কর্মজীবনের ক্ষতিসাধন করতে এই গেইমে আসক্তিই যথেষ্ট। যেসব তরুণ তরুণিরা এই গেইম খেলে, তাদের পড়াশোনা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, দিনদিন তাদের ফলাফল নিচের দিকে যাচ্ছে। তাই সবারই উচিৎ এই ব্যাপারে সতর্ক থাকা। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পশ্চিমা বিশ্বের শিক্ষার মান অনেক কমে গেছে। ১৯৮২ সালের পর আশ্চর্যজনক ভাবে ২০২০ সালে প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে সাহিত্য পড়ার হার সবচেয়ে কম। গবেষণায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালে মাত্র ৪৩ শতাংশ মানুষ বছরে মাত্র একটি বই পাঠ করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রতিদিনই বাড়ছে তরুণদের অনলাইনে কাটানো সময়ের হার। পাঁচ থেকে পনের বছর বয়সীরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ১৫ ঘন্টা অনলাইনে কাটায়। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে কিশোর বয়সীদের মধ্যে একাকীত্বের মাত্রা সবচেয়ে বেশি এবং ২০০৭ সালে আইফোন বাজারে আসার পর থেকে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যেরও অবনতি ঘটেছে প্রবলভাবে। বুকার পুরষ্কার বিজয়ী বিখ্যাত ব্রিটিশ লেখক হাওয়ার্ড জ্যকবসন বলেন, স্মার্টফোনের ব্যবহার এবং প্রচুর পরিমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারের কারণে নাটকীয়ভাবে তরুণ প্রজন্মের যোগাযোগ পদ্ধতি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। আর এসবের কারণে তারা হারাচ্ছে বই পড়ার অভ্যাসও। তাই তো মনের মধ্যে বারবার এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে স্মার্টফোনের আধিপত্যের কারণে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিশুরা অশিক্ষিত হয়ে যাবেনা তো?
লেখক: গবেষক, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct