সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ কিস্তি ৫
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
করিম খুব সহজে মনে করতে পারল যে এই লোকটা নাটক মঞ্চস্থ করার জন্য ভীষণ উদার মনে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। গ্রামের দুজন শিক্ষক তা পারেন নি। সময় না থাকলেও করিম বিবেক দেবনাথের ডাকে নরম হতে বাধ্য হল। পায়ে পায়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে এক পলক ভেবে নিল। বিবেক আগে এরকম ছিলেন না। টাকার প্রসঙ্গ উঠলে সব সময় এড়িয়ে যেতেন। সম্পদ কাঁমড়ে পড়ে থাকাই তাঁর একমাত্র অভ্যেস।
চা খাবে করিম? বিবেক দেবনাথের মুখে এক চিলতে হাসি।
আবার ওসব কেন?
তাহলে অন্য কিছু খাও।
বাড়িতে টিফিন করেই বের হয়েছি জ্যেঠু।
কোল্ড ড্রিঙ্কস্ আনতে দিই?
করিম চুপ করে থাকল।
গলার স্বর তুলে বিবেক দেবনাথ হাঁকলেন, এই পল্টু, দুটো ড্রিঙ্কস্ এখানে দিয়ে যা। করিমকে বললেন, ভিতরে এসে বসো।
করিম না বলতে পারলো না।
বিবেক দেবনাথের মনে তখন হাজার প্রশ্নের ডালি। নন্দিনী বিশুকে দেখে যা ভেবেছিলেন, তাই নিয়ে অনেকগুলো তির্যক প্রশ্নের ডালি তাঁর মাথার ভিতরে। করিমের কাছে সেগুলোর মূল্যায়ন জেনে নিতে চান। নিজেকে আরও হাল্কা করে নেওয়ার প্রয়াস শুরু হল তাঁর মধ্যে। চাপা স্বরে বললেন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করব করিম ?
কেন করবেন না? আপনার সাহায্যের কথা কোনোদিন ভুলতে পারব না জ্যেঠু।
সত্যি করে বলো তো, তোমরা আমাকে বিশু নন্দিনীদের দলে রাখো, নাকি ধনকুবেরের দিকে?
করিম ভাবতে পারল না, বিবেক জ্যেঠু তাকে এমন প্রশ্ন করতে পারেন। কী উত্তর দেবে, মাথায় এল না। ভিতরে ভিতরে কেমন যেন বিমূঢ় হয়ে থাকল। শুধু ভাবতে পারল যে নাটকের অভিনয় থেকে কঠোর বাস্তবে নেমে পড়েছেন বিবেক দেবনাথ। একবার চোখ তুলে তাকাল তাঁর দিকে। এত জটিল জীবনমুখি প্রশ্ন লোকটার মধ্যে জাগল কী করে? তো তো করে বলল, এ প্রসঙ্গ থাক্ না জ্যেঠু। নন্দিনী-বিশু নাটকের বিশেষ চরিত্র, তা নিয়ে পক্ষ বিপক্ষ করছেন কেন? ইচ্ছে করলে আপনিও বিশু-নন্দিনীর চিন্তা নিজের মতো করে গ্রহণ করতে পারেন। মন চাইলে তাদের মতো হয়ে যেতে পারেন।
তখনও করিমের মনের আকাশে থোকা থোকা মেঘ ভেসে রয়েছে। বিবেক জ্যেঠু এসব নিয়ে এভাবে ভাবতে পারছেন? উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আসছি জ্যেঠু, একটু কেনাকাটা করতে হবে।
বিবেক দেবনাথ দোকানের ভিতরে ঝুম্ মেরে বসে থাকলেন। দুচোখের সামনে করিম ওরফে বিশু পা পা করে সামনে হেঁটে চলেছে। বুকের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল। গলার স্বর উঁচু করে বললেন, আবার বাজারে এলে আমার দোকানে এস বাবা। আমি তোমাদের সাথে আছি। বার বার যাতে এমন জনজাগরণের নাটক মঞ্চস্থ হয়, তা নিয়ে চেষ্টা নিও।
তারপর দিন গেছে, রাত পার হয়েছে, আবার নতুন দিন এসেছে। তাও ফুরিয়ে গেছে। মাস শেষ হয়েছে পলে পলে। ভিতরে ভিতরে বিবেক দেবনাথ অনেকখানি পাল্টে গেছেন। বাঁক ফেরার চিন্তায় তাঁর মধ্যে আরেকটা বিবেক জন্ম নিয়েছে। নিজের পুরনো ব্যক্তিসত্তার সাথে তাৎক্ষণিক দৈনন্দিন জীবন কত বেশি দ্বন্দ্বমুখর হয়ে উঠতে পারে, সেই অনুভূতিও টের পেয়েছেন। একটা বজ্রকঠিন প্রতিজ্ঞা জন্ম নিয়েছে তাঁর মধ্যে। কিন্তু রূপায়ণ নিয়ে যে গভীর দুর্ভাবনা, তা থেকে মুক্ত হতে পারেননি। বরং আরও বেশি করে সেই দুর্ভাবনায় জড়িয়ে পড়লেন। ভিতরের চিন্তা বাস্তব রূপ না পাওয়ার বোধ বিবেককে ভীষণ নাড়া দিতে লাগল। শরীর স্বাস্থ্য দ্রুত ভেঙে পড়তে লাগল সেই ভাবনার স্রোতে। জীবনের শেষ ইচ্ছেটুকু কীভাবে রূপায়ণ করবেন, তাই নিয়ে একটানা পড়ে থাকলেন। একদিন নমিতাকে ডেকে বললেন, আমার অবর্তমানে তোমাকে একটা দায়িত্ব পালন করতে হবে। দুএকদিনের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার টাকা উইল করে দেব। এলাকায় নতুন কোনো নাট্যসংস্থা গড়ে উঠলে তোমার দায়িত্ব হল ওই টাকা তাদের হাতে তুলে দেওয়া। উইলে সেকথাও উল্লেখ থাকবে। গ্রামের পশ্চিমে আমার যে দুবিঘে জমি রয়েছে, রাস্তার পাশ থেকে দশ কাটা লিখে দেব যাতে ওইখানে নাট্যসংস্থা গড়ে উঠতে পারে।
জানো নমিতা, সারা জীবন আমার আমার করে কাটিয়ে দিলাম। এখন বুঝতে পারছি আমাদের ভাবনা গ্রহণ করতে পারলে সকলের পক্ষে তা অনেকখানি মঙ্গলের হত। আমিত্ব মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যায় কিন্তু আমরা ভাবনা চিরদিন বেঁচে থাকে যার মধ্যে আমিত্বও গর্বের সাথে নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারে। নিজেকে সকলের সাথে মিলিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা ভাবনার মধ্যে রয়েছে যে যাদু বাস্তবতা তা আজও লাভ করতে পারলুম না। তাই একটা ছোট্ট আয়োজন করে যেতে চাচ্ছি যাতে অন্তত কিছু মানুষ ভাবতে পারে যে আমিও নন্দিনী হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারি নি। আমার এ যন্ত্রণা তাদের জীবনে মস্ত বড়ো পাওনা হয়ে উঠতে পারে। এখন কী মনে হয় জানো নমিতা, রোজ সকালে সূর্যের যে আলো ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র চরাচরে, দুপুরে তার জ্যোতি বাড়ে সবচেয়ে বেশি। দুঃখ একটাই, নিজের জীবনে শুধু সকালের রোদটুকু দেখতে পেলুম, দুপুরের জ্যোতি আর দেখা হল না।
এর দুদিন দিন পরেই।
মূর্খ চাল ব্যবসায়ীর জীবন-আলেখ্য শুনতে শুনতে সকলে স্তম্ভিত না হয়ে পারল না। অভিভূত হয়ে যাওয়ার মতো ঝড় সবার মনের গভীরে। নাটকের প্রতি আত্মিক শ্রদ্ধার এক অনন্য উদাহরণ হল বিবেক দেবনাথের জীবন। জয়া আবেগতাড়িত হয়ে বলল, বিবেক দেবনাথের জীবন নিয়ে একটা নাটক লিখলে কেমন হয়?
পারভিন বলল, এলাকায় নতুন নাট্যসংস্থা গড়ে উঠলে বিবেক দেবনাথের জীবনকে স্মরণীয় করে রাখা সম্ভব হবে।
জিৎ জোর দিয়ে বলল, নামকরণ নিয়ে আর কোনো ভাবনার অবকাশ নেই পল্লবদা। তোমার কথা শুনে নামকরণের মূল সূত্র ধরে ফেলেছি। বিবেক দেবনাথের স্মরণে আমাদের নাট্যসংস্থার নাম হোক ‘‘বিবেকভাবনা’’।
পল্লব বুঝল অন্য কিছু। আবেগের বশে একটা প্রস্তাব দিলেও এ নিয়ে যে আরও বড়ো ভাবনা রয়েছে, তা জিৎ-এর মাথায় আসেনি। এটাও ঠিক, ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে বিবেক দেবনাথ নিজেকে অনেকখানি পাল্টে নিতে পেরেছিলেন কিন্তু কখনো নাট্যবিপ্লবের সাথে যুক্ত হতে পারেন নি। যে বিপ্লব সকলকে ছুঁয়ে যায়, তা পরিচালনা করা অনেক বড়ো ব্যাপার। বিবেকবাবু সারা জীবন তেমনি কোনো বড়ো কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে ছিলেন না। পল্লব ভাবল, এই অনুভূতি জিৎকে ভালোভাবে বোঝানো দরকার। তবুও অনুরোধের ঢঙে বলল, তুমি মন্দ বলো নি জিৎ কিন্তু আরেকটু বেশি ভাবলে আরও বড়ো প্রস্তাব দিতে পারতে। তোমাকে একটা কথা মনে করিয়ে দিই, মাথার উপরে যে আকাশ দেখছ, দূরে তাকালে মনে হবে, সূর্য সবুজ মাঠে শুয়ে পড়েছে। পায়ে পায়ে সেখানে গেলে দেখতে পাবে, আকাশের সূর্য উঁচু আকাশেই রয়ে গেছে। পৃথিবীর সর্বত্র নাট্যবিপ্লব নিয়ে যিনি সবার মাথার উপরে রয়েছেন সূর্যের মতো, তিনিই জুলিয়াস ফুসিক। তাই বলছি, যদি তার নামে...।
প্রতিবাদে গর্জে উঠল জিৎ, এসব কী বলছ পল্লবদা? তাহলে বিবেক দেবনাথের জীবন নিয়ে এত ঘটা করে গল্প করতে গেলে কেন? জুলিয়াস ফুসিককে টেনে আনলে গ্রামের লোক আমাদের বিশ্বাসঘাতক ভাববে না? বিবেক দেবনাথের টাকা আর জায়গা নিয়ে জুলিয়াস ফুসিককে প্রতিষ্ঠা করতে যাব কেন শুনি? এ তো চরম দ্বিচারিতা। বিবেক দেবনাথকে সামনে রেখে ভালো কিছু করার ভাবনায় এ নাট্যসংস্থা গড়ে তোলো পল্লবদা। শুরুতেই যদি জগৎ শেঠের মতো প্রচ্ছন্ন বিশ্বাসঘাতকতা নিয়ে চলতে শুরু করি, তাহলে দেশের মানুষ আমাদেরকে ভালো চোখে দেখবে না।
পল্লবের মধ্যে নতুন অস্থিরতা শুরু হল। ভিতরে ভিতরে দুলতে লাগল। বুঝতে পারল, জিৎ-এর প্রতিবাদের ভাষায় মূল প্রসঙ্গটা পাল্টে যেতে বসেছে। আবার বোঝানোর ভঙ্গীতে প্রশ্ন করল, বিষয়টাকে এভাবে নিচ্ছ কেন জিৎ?
কেন নেব না শুনি? একজন বিদেশী মানুষের কথা বলতে তোমার বিবেকে বাধল না, আর আমি দেশের মানুষের কথা বলে অপরাধী হয়ে গেলাম? টাকা দিলেন বিবেক দেবনাথ, নাট্যসংস্থা গড়ে উঠল জুলিয়াস ফুসিকের নামে। এভাবে বিদেশের গোলামি করলে দেশের মানুষ ভালো চোখে দেখবে না পল্লবদা। পরম হিতাকাঙ্খী বিবেক দেবনাথকে আমি সামনে আনতে চাচ্ছি, যাতে দেশের মানুষ আরও বেশি করে উদ্বুদ্ধ হতে পারে। তুমি সেই প্রচেষ্টায় কৌশল করে বাধা দিয়ে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে চাচ্ছ। শুরুতে কেন যে এমন বিদেশী ভাবনা তোমার মাথায় ভর করল, তা মাথায় ঢুকছে না। ফুসিকের নামে নামকরণ করা মানেই তো আমরা নাট্য বিপ্লবের ক্ষেত্রে বিদেশমুখি হয়ে পড়লাম। এতে না বাঁচবে স্বাদেশিকতা, না বাঁচবে দেশপ্রেম। শুধু শুধু চাটুকারিতা নিয়ে নাটকের দল গড়ে না তোলাই ভালো।
নাটক নিয়ে এভাবে দেশ বিদেশের প্রসঙ্গ তুলতে নেই জিৎ।
আবার নতুন ফিকির নিয়ে কথা বলতে শুরু করলে তুমি? তাহলে কী নাটকে দেশপ্রেম বলে কিছুই থাকবে না? আমাদের নাট্য ভাবনায় দেশীয় কোনো মানুষের স্মৃতি বড়ো হয়ে উঠতে পারে না?
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct