মতিরুল রহমান সেখ: এইচ আর সিটি স্ক্যান কি? সিটি সিভারিটি স্কোর কি? আরটিপিসিআর কি? এই নিয়ে আজকাল অনেকের মনেই প্রশ্ন। অবশ্য কোভিড রোগ নির্ণয়ের এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিস্তারিত আলোচনার পূর্বে বলে নিতে চাই কোভিড রোগ নির্ণয়ের জন্য বর্তমানে তিনটি পদ্ধতি ব্যবহৃত হচ্ছে । ১) র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট (RAT) ২) আর টি - পি সি আর ( RT- PCR) ৩) সিটি স্ক্যান ( HRCT scan of Thorax)। এই সম্পর্কেই আজকের আলোচনা। সর্বপ্রথম বহুল প্রচলিত ছিল rt-pcr প্রযুক্তি। এই পদ্ধতিতে করোনা ভাইরাসের জিন শনাক্তকরণ এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা হয়। কোভিড প্রথম ঢেউয়ে এই পদ্ধতিটি কার্যকরী ভূমিকা রাখে । কিন্তু বেশকিছু কারণ যেমন- স্যাম্পেল কালেকশন, ট্রান্সপোর্ট, সংরক্ষণ পদ্ধতি সঠিকভাবে না হওয়ার কারণে কার্যকরী ফলাফল ত্রুটিপূর্ণ আসে। যেখানে প্রথম ঢেউয়ে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সঠিক রিপোর্ট শনাক্তকরণ সম্ভব হচ্ছিলো। দ্বিতীয় ঢেউয়ে ভাইরাসটির জিনগত মিউটেশন-এর কারণে RT-PCR প্রযুক্তি ব্যবহার করে 50% আশেপাশে সঠিক রিপোর্ট আসছে। ফলে এই পদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা 50% কেস সনাক্ত করতে পারছিনা। দ্বিতীয় যে সমস্যাটি রয়েছে তা হলো RT-PCR পরীক্ষাটি সব হসপিটাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে উপলব্ধ নয়। এর জন্য চাই দামি যন্ত্রপাতি যা কেবল শহরের বড় বড় হসপিটাল গুলোতেই উপলব্ধ। এছাড়াও রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য একটি নির্দিষ্ট বিধি রয়েছে সেজন্য সময়ের প্রয়োজন। আর এই জন্য RT-PCR রিপোর্ট আসতে ৩ থেকে ৪ দিন কখনো কখনো ৫ দিনের অধিক সময় লেগে যায় ফলে রিপোর্ট পেতে পেতে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যায় এবং চিকিৎসা শুরুতে বিলম্ব হয়। অর্থাৎ RT-PCR খুব ভালো একটি প্রযুক্তি হওয়া সত্ত্বেও এর কিছু লিমিটেশন রয়েছে।
এবার জেনে নেওয়া যাক র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ে। কিট টেস্টের মাধ্যমে এটি করা হয়। পরীক্ষা টি খুবই সহজ এবং তৎক্ষণাৎ রিপোর্ট পাওয়া যায়। কিন্তু সমস্যা হল এর গ্রহণ যোগ্যতা কম। ফল্স পজিটিভ, ফল্স নেগেটিভ রিপোর্ট দেয়। এই পদ্ধতিতে ন্যাসোফ্যারিন্জিয়াল সোয়াব সংগ্রহ করা হয় যা মূলত কোভিডের অ্যান্টিজেন, তার সঙ্গে ব্যাফার মিশ্রিত করা হয় এবং সেই স্যাম্পলের এক ফোটা কিটের উপর চালনা করা হয়। এই কিটে কোভিডের অ্যান্টিবডি কোড করা থাকে। সংগৃহীত সোয়াবে কোভিডের অ্যান্টিজেন উপস্থিত থাকলে, কিটের মধ্যে অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডির বিক্রিয়া সংঘটিত হয়ে একটি বিশেষ রং উৎপন্ন করে। কিটের উপর দুটি রেখা দেখা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশ কয়েকটি কারণে ভুল রিপোর্ট আসছে। যেমন - ১) সংগৃহীত সোয়াবের মান ভালো নয়। ২) সংগৃহীত সোয়াবের সঙ্গে যুক্ত করা বাফারের মাত্রা কম হওয়া। ৩) নমুনা পরীক্ষার পদ্ধতি গোলমাল থাকা। প্রভৃতি কারনে এই পদ্ধতিতে সঠিকতার মাত্রা কম। এই রিপোর্টের উপর নির্ভর করা বা নিশ্চিত হওয়া যায় না।
উপরোক্ত দুটি পদ্ধতির সাহায্যে আমরা পজিটিভ বা নেগেটিভ এর ব্যাপারে জানতে পারলেও। পেশেন্টের অবস্থা কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারি না। যদিও বা আর টি পি সি আর এর মাধ্যমে ভাইরাল লোড সম্পর্কে জানতে পারি।
অন্যদিকে চেস্টের এইচ আর সিটি স্ক্যানের মাধ্যমে ঐ মূহুর্তে ফুসফুস কতটা কোভিড সংক্রমিত হয়েছে তা জানতে পারি। স্ক্যান নেওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ফিল্ম পাওয়া যায়। এই ছবি দেখে ডক্টররা সহজেই বুঝতে পারে ফুসফুসের কোন ভাগে কতটা সংক্রমণ ঘটেছে। রিপোর্ট পাওয়া যায় ৩ থেকে ৪ ঘন্টার মধ্যে, ফলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসা শুরু করা যায়। কিছুদিনের পরে দ্বিতীয় বার স্ক্যান নিলে আগের রিপোর্টের সঙ্গে তুলনা করে দেখে নেওয়া যায় রোগির অবস্থা উন্নতির নাকি অবনতির দিকে। সিটি স্ক্যানে রোগ নির্ণয়ে সঠিকতার মাত্রা ৯০ শতাংশের অধিক। নিঃসন্দেহে সিটি স্ক্যান একটি নির্ভরযোগ্য প্রযুক্তি।
এইচ আর সিটি স্ক্যান : হাই রেজল্যুশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি একটি স্ক্যানিং প্রোটোকল যা বিশেষ অ্যালগোরিদমের মাধ্যমে (থিন কাট ইমেজ ) সূক্ষাতি সূক্ষ ছেদ ছবি সংগ্রহ করতে সক্ষম। ফুসফুসে অ্যালভিওলাইয়ের সূক্ষাতি সূক্ষ পরিবর্তন গুলিও ধরা পড়ে যায় এই স্ক্যানে। RT-PCR বা RAT টেস্টের রিপোর্টে নিশ্চিত না হওয়া গেলে অবশ্য সিটি স্ক্যান রিপোর্টে নিশ্চিত হওয়া যায়। শুধুমাত্র কোভিড নয় চেস্টের যেকোন ধরনের অস্বাভাবিকতা যেমন, সি ও পি ডি, নিউমোনিয়া, টিউবারকিউলোসিস, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, লাং কোলাপস্ড, অ্যালভিওলাইয়ের পরিবর্তন, বুকে জল জমা, এমনকি ফুসফুসের ক্যান্সার ও
শনাক্ত করা যায় এই পরীক্ষার দ্বারা।
মেডিক্যাল ইমেজিং এর মধ্যে সিটি স্ক্যান সহ বেশ কয়েকটি ডায়াগনস্টিক মডেল রয়েছে যাতে এক্স রশ্মি পরিচালিত করে সুবিধা নেওয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ এক্সরে, ম্যামোগ্রাফি, ডেন্টাল ওপিজি, সি -আর্ম ফ্লুরোস্কোপ ইমেজিং, ক্যান্সার চিকিৎসায় রেডিওথেরাপি ইত্যাদি।
বহুল চর্চিত প্রশ্ন, রেডিয়েশন কি শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ? উত্তর, যে কোনো তেজস্ক্রিয় রশ্মি অবশ্যই ক্ষতিকর। যদি লাভ ক্ষতির দিকটা দেখি, করোনার সঠিক চিকিৎসা না হওয়ার যে ক্ষতি সেই তুলনায় এই ক্ষতির পরিমাণ নগণ্য। দ্বিতীয় প্রশ্ন এক্সরের তুলনায় সিটি স্ক্যানে রেডিয়েশনের পরিমাণ কি অনেক বেশি। উত্তর, হ্যাঁ । তবে এই ধারণা ৪০-৫০ বছরের পুরোনো। বর্তমানে আল্ট্রামডার্ন ( মাল্টিস্লাইস) সিটি স্ক্যানে রেডিয়েশন হ্যাজার্ড খুবই স্বল্প। ALARA (as low as readable achievable) নীতি মেনে কম রেডিয়েশন দিয়ে সর্বাধিক সুবিধা নেওয়া হয়। ফলে ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। এই বিষয়ে ‘ইন্ডিয়ান রেডিওলজিকাল অ্যান্ড ইমেজিং অ্যাসোসিয়েশন’ একটি বিবৃতি দিয়ে স্পষ্ট জানিয়ে দেন : সিটি স্ক্যানের যে সুবিধা রয়েছে তা রেডিয়েশনে ক্ষতির তুলনায় অনেকগুন বেশি।
সিটি সিভারিটি স্কোর কি ?
এই স্কোর বলে দেয় ফুসফুসে করোনা ভাইরাস ইনফেকশন / ইনভল্ভমেন্টের ধরন ও পরিমাণ। বুকের মধ্যে অবস্থিত শ্বাসযন্ত্র ফুসফুসের প্রথমত দুটি অংশ ডান ও বাম (Right lung & left lung)। ডান অংশের আবার তিনটি ভাগ রয়েছে, অনুরূপ ভাবে বাম অংশের দুটি ভাগ রয়েছে। অর্থাৎ ফুসফুসের মোট পাঁচটি ভাগ (lobe) রয়েছে। প্রতিটি ভাগে ৫ পয়েন্ট নিয়ে ২৫ পয়েন্ট হলো মোট সিভারিটি স্কোর। বিভিন্ন লোবে ইনভল্ভমেন্ট দেখে স্কোর দেওয়া হয়। রিপোর্টে সিটি সিভারিটি স্কোর ও রোগীর লক্ষন দেখে কোভিডের চিকিৎসা করা হয়। অক্সিজেন স্যাচুরেশন (SpO2) লেভেল কম থাকলে অক্সিজেন দিতে হবে। প্রয়োজন পড়লে ডক্টরের পরামর্শে ভর্তি করতে হতে পারে। এই ধরনের ইনফেকশনে ফুসফুসে এক নতুন প্যাচি অপাসিটি দেখা যায়, যাকে বলা হয় গ্রাউন্ড গ্লাস অপাসিটি (GGO) ।
ডা. চন্দন বানসাল
(MD Medicine & Diabetologist) এর বিবৃতি অনুস্মরণে লিখেছেন মতিরুল রহমান সেখ
(Radiographer)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct