সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ কিস্তি ৪
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
নমিতা বিবেক দেবনাথের ভিতরের কথা যে বুঝতে পারত না, তা নয় কিন্তু তা নিয়ে কোনোদিন আপত্তি জানাতে পারে নি। স্বামীর ঘর, নিজেকে অনেকখানি সামলে নিয়ে চলতে হত তাকে। ভালো করেই বুঝত, স্রেফ কৃপণতা রক্ষার জন্যে লোকটা এত বেশি ছলছুতো দেখাতে শিখেছে। শুধু কাজের মেয়ে রাখা নিয়ে নয়, অসুখ বিশুখ হলে বিবেকের ভিতরের ভাবনা আর্থিক কৃপণতায় আবদ্ধ হয়ে থাকত। পথে বন্ধ করে ঘুরত। নমিতাকে শুনিয়ে বলতেন, শরীরের নাম মহাশয়, যা সহাবে তাই সয়। সামান্য অসুখ বিশুখ হলে ডাক্তার দেখিয়ে কোনো লাভ নেই গো। তাতে শরীরের সহনশীলতা কমে যায়। পরে পরে ডাক্তার দেখিয়েও কোনো লাভ পাওয়া যয় না। বরং যদি ভাবো, শরীরে উড়ো রোগ খুব বেশি দিন চেপে থাকতে পারবে না, তাহলে দেখবে, সেই ভয়ে রোগশোক নিজেই পালাবে।
নমিতা বেশ বুঝতে পারত, মাত্র কটা টাকা খসানোর জন্যে তার সোয়ামী এভাবে শরীর নিয়ে বেদবাক্য আউড়ে চলেছে। সেই কঠিন মানুষটাকে এভাবে বারান্দার উপর থপ করে বসে পড়তে দেখে ছুটে এল কাছে। —হ্যাগো, কোনো অসুখ বিশুখ করে নি তো?
ওসব কিছু নয়।
তাহলে অমন করে বসে পড়েলে যে?
অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে নমিতা।
আসার পথে গেঁটের টাকা কোথাও পড়ে যায় নি তো?
বিবেক দেবনাথ কঠিন মুখে বলল, না।
খুলে না বললে তো কিছুই বুঝতে পারছি নে।
সে ক্ষতি পূরণ করার ক্ষমতা তোমার নেই গো।
এসব কী বলছ তুমি?
এতদিন পরে বুঝলুম, আমার জীবনটা ছাইপাঁশ হয়ে গেছে। সব মিথ্যে। কেবল জঞ্জাল টেনে মরছি। এত দিনের পরিশ্রম একেবারে পন্ডশ্রম হয়ে গেল।
নমিতার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। ঝংকার দিয়ে উঠল, তোমার মাথায় এসব কে ঢোকালো শুনি?
ওই নন্দিনী, মেয়েটা বড়ো ভালো।
বলে কী লোকটা? এতদিন তার সাথে ঘরসংসার করে এখন নন্দিনীকে নিয়ে পড়ল? লাগাম টেনে ধরতে আবার ঝংকার দিল, মেয়েটা কে শুনি? আগে বলো, এত রাতে তাকে নিয়ে পড়লে কেন?
আজ থেকে কেবল ওই মেয়েটার সাথে থাকতে হবে গো। হাতে লাল গোলাপ নিয়ে এমন করে সামনে এসে দাঁড়াল যে কিছুতেই তাকে ভুলতে পারছি নে।
এ সব কী বলছ তুমি? ফেরার পথে তোমার ঘাড়ে এ ভূত চাপল কী করে?
ভূত নয় গো, জীবন্ত প্রেতনি। শুধু কাছে ডাকছে। আমাকে সাথে নিয়ে থাকতে চাচ্ছে। তাতেই চমকে উঠছি।
নমিতার তীব্র ঝংকার, এ্যাদ্দিন চাল ব্যবসা করে খাচ্ছিলে, এখন দেখছি, একটা বাজে মেয়ের পাল্লায় পড়ে নিজেকে শেষ করে দেবে। সংসারটাকে না ডুবিয়ে ছাড়বে না।
এভাবে ভাবতে নেই নমিতা। আগে এ সংসারটাকে টাইটানিক জাহাজ বলে ভাবতুম। আমি ছিলুম পাইলটের ভূমিকায়। এখন ভাবছি, এ জাহাজ ডুবে যাক। ইতিহাসের টাইটানিক ডুবে গিয়েছিল চাঁই বরফের ধাক্কায়, আমি নিজেই ধাক্কা মেরে সংসারের টাইটানিকটাকে ডুবিয়ে দিতে চাচ্ছি।
নমিতা স্তম্ভিত না হয়ে পারল না। মুখে যা আসছে, লোকটা তাই বলে যাচ্ছে। এত বড়ো সংসার। ব্যবসায় অভাবণীয় সাফল্য। এসবের কোনো মূল্য নেই লোকটার কাছে? নন্দিনীকে নিজের জীবনের সঙ্গী করে নিতে এতটুকু আক্কেলে বাঁধল না? ভিতরে ভিতরে একেবারে অসহনীয় হয়ে উঠল। আবার ঝংকার দিল, এ্যাদ্দিন চলছিল কী করে শুনি? বুড়ো বয়সে এসব কী শুরু করলে তুমি? লোকে শুনলে কী ভাববে, তা একবার ভেবে দেখেছ? এই বয়সে নন্দিনীর সাথে....।
নমিতাকে সঙ্গে না নিয়ে গিয়ে যে মস্ত বড়ো ভুল হয়েছে, তা বিবেক দেবনাথের মনের ইজেলে ছবি হয়ে ভেসে উঠল। তাহলে অন্তত নমিতা তার উপর এতটা রাগ করতে পারত না। ক্লাবের ছেলেদের উপর বেশ অভিমান হল বিবেক দেবনাথের। গ্রামের বাইরের বহু লোক নাটক দেখতে এসেছিল। একজন সাধারণ দর্শক হিসেবে নমিতাও তো এ নাটক দেখার সুযোগ পেতে পারত। চাইলে তিনি নাটকের জন্যে আরও কয়েকশ’ টাকা বেশি দিতে পারতেন। সেই সুযোগটুকুও দেওয়া হল না। নমিতাকে যে দ্রুত নরম করে দেওয়া প্রয়োজন, তা ভালো করে বুঝে গেলেন। শুধু নিজেকে নয়, নমিতার জীবনে বদল আনতে না পারলে নন্দিনীকেও এ বাড়িতে ঢোকানো যাবে না। গলার স্বর নামিয়ে বললেন, আমার কথাগুলো আগে শোনো, তারপর না হয়....।
নমিতা কোনো উত্তর দিল না। রাগে ভিতরে ভিতরে ফুসতে লাগল। লোকটার কী নেহাত কম বয়স হল? তার পরেও অন্য মেয়ে মানুষকে জড়িয়ে সামনাসামনি এভাবে কথা বলতে পারল? গজগজ করতে করতে হন্হন্ পায়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল, তোমার কোনো কথা শুনব না আমি।
বিবেক দেবনাথ বিমূঢ় মুখে বসে থাকলেন বারান্দার উপরে। সংসারের যাঁতাকল যে কত বেশি যন্ত্রণার, তা অন্তর দিয়ে অনুভব করতে লাগলেন। একদিকে নন্দিনী, অন্যদিকে নমিতা— দুই বিপরীত টানে তাকে যে আরও বেশি খেসারত দিতে হবে, তা নিয়ে একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলেন। রান্নাঘর থেকে নমিতার কণ্ঠস্বর ভেসে এল, ভাত বেড়েছি খেয়ে নাও। রাত অনেক হয়েছে। সারা দিন খাটাখাটুনির পরে এ নাটক ভালো লাগে না। পাশের ঘরে শুয়ে পড়ছি, খুব ঘুম পেয়েছে।
খেতে খেতে নানা ভাবনার জোয়ারে ভেসে গেলেন বিবেক দেবনাথ, যদিও তিনি কেনো বিশেষ ভাবনায় খুব বেশি সময় স্থির হয়ে থাকতে পারলেন না। খাওয়া শেষ হতে মিনিট কুড়ি লাগল। হাত মুখ ধুয়ে শোবার ঘরের ভিতরে চলে গেলেন। নমিতা যে তার উপর খুব রাগ করেছে, তাও বুঝতে পারলেন। বিছানার উপরে বসে নতুন করে ভাবতে শুরু করলেন। উত্তর খুঁজে না পাওয়ার যন্ত্রণায় মাথাটা টনটন করছে। চিবুকের দুদিকে দুহাতের তালু রেখে বসে থাকতে থাকতে উঠে দাঁড়ালেন প্রবল মানসিক যন্ত্রণায়। এতদিন যা চেয়েছেন, তা দুহাত ভরে পেয়েছেন। নতুন পরিস্থিতিতে সেই চাওয়া-পাওয়ায় কোনো স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। রাতের প্রহর পর পর পার হচ্ছে। তারস্বরে চীৎকার করে রাতপ্যাঁচা ডাকছে। ডাহুকির ডাক ভেসে আসছে জানালা পার হয়ে। তাতেও বিবেক এতটুকু কম্পিত হতে পারলেন না। রাত দুটো পর্যন্ত জেগে থাকার পরে অন্ধকার রাতের সাথে আর পাল্লা দেওয়া সম্ভব হল না। ঢুলু ঢুলু চোখে বিছানার উপর ঢলে পড়লেন জীবন জিজ্ঞাসার নানা অচেনা প্রশ্ন বুকে জড়িয়ে। দেরিতে ঘুমানোর জন্যে রাত কখন শেষ হয়েছে, জানতে পারলেন না। আটটার দিকে ঘুম ভাঙল। বেডরুম ছেড়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। সেদিন প্রথম সূর্যের সাত রঙের মধ্যে জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেলেন। আগে প্রতিদিন সকালে সূর্য দেখলেও এ তাৎপর্য কোনোদিন ধরা পড়ে নি তাঁর চোখে।
দুপুরের আগে আর দোকানে গেলেন না। মন চাচ্ছে না বলে বাড়িতে বসে থাকলেন। নমিতাও এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলল না। লোকটার মুখ এত থমথমে যে প্রশ্ন করার সাহস পেল না। দুপুরের খাওয়া সেরে বিবেক দেবনাথ একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু তাও পারলেন না। দুশ্চিন্তার ফাঁক গলে ঘুমপরি এসে কিছুতেই দুচোখে ভর করতে পারল না।
বিকেলে বাজারে গিয়ে দোকানের ভিতরে আনমনে বসে থাকলেন। তখনও নতুন একটা দায়ভার মাথার ভিতরে চরকির মতো ঘুরছে। নন্দিনী বিশু মিলে যে লোকটাকে হারিয়ে দিল, তার কী ছিল না? অঢেল সম্পত্তি। প্রিয় পারিসদবর্গ। অনেক লোক লস্কর অথচ তাকেই দুজনের খালি হাতের লড়াইয়ের কাছে কী সাংঘাতিকভাবে হার স্বীকার করতে হল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে সামনে চেয়ে দেখলেন, ক্লাবের সম্পাদক করিম থামথাম পায়ে সামনে হেঁটে চলেছে। ছেলেটা ভীষণ কর্মঠ। ভারি মিশুক। ভালোবাসা দিয়ে মানুষকে দারুণ কাছে টানতে পারে। আন্তরিকতার জৌলসে একাই একশ। অনুষ্ঠানের দিনে তা করেও দেখাতে পারল। বিবেক দেবনাথের মনে হল, ছেলেটা নিশ্চয় বাজার করতে এসেছে। বিশুর ভূমিকায় করিম নিজেকে দারুণ মানিয়ে নিতে পেরেছিল। দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, আত্মিকতার জোরে সে নন্দিনীকেও ছাপিয়ে যেতে পারে। হৃদয়-ভাবনার পরশ মেশানো অনেক দামী দামী কথা বের হয়ে এসেছিল তার মুখ থেকে। ভাবতে ভাবতে নতুন করে কম্পিত হলেন বিবেক দেবনাথ। করিমকে উদ্দেশ্য করে চাপাস্বরে ডাকলেন, বাজার করতে এসেছ নাকি?
করিম মুখ তুলে বলল, কদিন নানা কাজে বাজারে আসতে পারি নি। আজ না এসে উপায় ছিল না।
অনুষ্ঠানটা ভারি সুন্দর করে করতে পারলে হে। এস না আমার দোকানে, তোমার সাথে কথা বলতে আমার খুব ভালো লাগে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct