দেবাশিস পাল ও বিশেষ প্রতিবেদক: উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংস্কারের কাজ করতে গিয়ে পুরনো বাড়ি ধসে মৃত দুই শ্রমিকের মৃতদেহ বুধবার ফিরল কালিয়াচকের শেরশাহী রন্নুচক গ্রামে। এদিন সকাল দশটা নাগাদ পরপর দুটি মৃতদেহ গ্রামে ঢুকতেই দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কান্নার রোল পড়ে যায়। ঘনঘন মূর্ছা যান মৃত দুই শ্রমিকের স্ত্রীরা। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই গ্রামের একটি কবরস্থানে ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় দুই শ্রমিকের মৃতদেহের। এদিন প্রায় ৮০০ কিমি দূর বারানসী থেকে মৃতদেহ এসে পৌছে যায়। এদিকে এদিন দুপুরে হেলিকপ্টারে করে ফরাক্কায় নামেন রাজ্যের পরিবহনমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। পরে তিনি সড়কপথে শেরশাহী গ্রামে আসেন। সেখানে একটি বেসরকারি ফাইজিয়া হাক্কানিয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে প্রশাসনের তরফে আয়োজিত একটি কর্মসূচিতে মৃত দুই শ্রমিকের স্ত্রীর হাতে রাজ্য সরকারের তরফে দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। সেই চেক নিতে গিয়েও কান্নায় ভেঙে পড়েন দুই শ্রমিকের স্ত্রীরা। পাশাপাশি এদিনই গ্রামে ফিরে আসা সেই বাড়ি ধসে আহত ছয় শ্রমিকের হাতে ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের চেকও তুলে দেন তিনি। আহতরা হলেন, আবদুল জব্বার , আরিফ মোমিন, ইমরাজ মোমিন, সায়েদ আখতার, হাকিম খান, আরিফ মোমিন। এদের সকলের বাড়ি কালিয়াচক তবে আবদুল জাব্বার এর বাড়ি ইংরেজবাজার এর কাঞ্চনটার। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে সেখানে ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ মৌসম নুর, জেলাশাসক রাজর্ষি মিত্র, পুলিশ সুপার অলোক রাজোরিয়া, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গ্রামীন আনীশ সরকার, বৈষ্ণবনগরের বিধায়ক চন্দনা সরকার, হরিশ্চন্দ্রপুরের বিধায়ক তজমুল হোসেন, চাঁচলের বিধায়ক নীহার ঘোষ, মালতিপুরের বিধায়ক আব্দুর রহিম বক্সি, মুখ্যস্বাস্থ্য আধিকারিক শৈবাল ব্যানার্জি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গ্রামীন) অনীশ সরকার, ডিএসপি হেডকোয়ার্টার প্রশান্ত দেবনাথ, কালিয়াচক থানার আইসি আশিস দাস, বিডিও সেলিম হাবিব সর্দার, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি আতিউর রহমান প্রমুখ সহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। ফিরহাদ বলেন, “মৃত ও আহত শ্রমিকরা আমাদের ঘরের ছেলে, বাংলার ছেলে। তাই ‘বাংলার মা’ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন। এর আগে মালদহ বা মুর্শিদাবাদে যখনই কোনও পরিবারে এমন দুর্ঘটনা ঘটেছে মুখ্যমন্ত্রী আমায় পাঠিয়েছিলেন। আমরা এই মৃত ও আহত শ্রমিকদের পাশে থেকে আর্থিক ও সামাজিকভাবে সাহায্য করবো। আহতদের সবরকম চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হবে প্রশাসনের তরফে।”
বারাণসীর কাশী বিশ্বনাথ মন্দির সংস্কারের কাজে গিয়েছেন মালদহের কালিয়াচকের অন্তত দেড়শো শ্রমিক। সোমবার রাতে কাজ শেষে ১৪ জন শ্রমিক মন্দির সংলগ্ন একটি পুরনো বাড়িতে ঘুমিয়ে ছিলেন। মঙ্গলবার ভোর চারটে নাগাদ সেই বাড়িটি ধসে পড়ে এবং ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় কালিয়াচকের মহেশপুরের আমিনুল মোমিন ও এবাদুল মোমিনের। বাকি ১২ জন শ্রমিকও আহত হন। তাঁদের মধ্যে ৬ জনকে স্থানীয় কবীর চাউরা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। জানা গিয়েছে, গতকালই কাশী বিশ্বনাথ মন্দির কমিটির তরফে মৃত দুই শ্রমিকের পরিবারকে দু’লক্ষ টাকা করে চেক এবং আহত ৬ জন শ্রমিককে ২৫ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়া হয়। পাশাপাশি গুজরাটের যে সংস্থার হয়ে এই শ্রমিকরা কাজ করতে গিয়েছিলেন সেই সংস্থার পক্ষ থেকেও মৃত শ্রমিকদের পরিবারপিছু তিন লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে, এদিন সকালে কফিনবন্দি দুটি মৃতদেহ গ্রামে ফেরে। পরিবার ও গ্রামবাসীদের অভিযোগ, মৃতদেহ দুটি শুধু প্লাস্টিকে মুড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। বরফ বা দীর্ঘসময়ের এই রাস্তার জন্য উপযুক্ত সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। মন্ত্রী ফিরহাদের কাছে এ নিয়ে ক্ষোভের কথা জানান গ্রামবাসীদের একাংশ। এ নিয়ে ফিরহাদের কটাক্ষ, “উত্তরপ্রদেশে কী অবস্থা চলছে তা সবাই জানে। করোনা মৃতদেহ নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই রাজ্য থেকে মৃতদেহ যে এসেছে, সে জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।” ফিরহাদ আরও জানান, এক শ্রমিকের স্ত্রী আশাকর্মী পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করেছেন। অন্য শ্রমিকের স্ত্রী এখনও কিছু আবেদন করেননি। আমরা দুই পরিবারের পাশে আছি। পাশাপাশি আহতদের চিকিৎসা করে তাদের কাজের ব্যবস্থা যাতে করা যায় সেটাও দেখা হচ্ছে।
এদিন কালিয়াচকের কর্মসূচি শেষে সুজাপুরে 45 শয্যার একটি কোভিড হাসপাতালে উদ্বোধন করেন মন্ত্রী ফিরহাদ। তবে করোনা স্বাস্থ্য বিধি মেনে উপস্থিতি ছিল একেবারে নিয়ন্ত্রিত। প্রতিমন্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন কোলকাতায় তাই এদিন উপস্থিত ছিলেন না তবে পরিবারের পাশে থাকার বার্তা দেন। এদিকে উত্তরপ্রদেশের ঘটনাস্থল কাজের সংস্থা তিন লাখ টাকা ও মন্দির কমিটি দুই লাখ টাকা করে মোট পাঁচ লাখ টাকা মৃত পরিবারের হাতে চেক প্রদান করেছে বলে জানা গেছে। ফিরহাদ মাত্র ঘন্টা খানেকের ঝটিকা সফরে এসে সরকারের তরফে এসে যে বার্তা দিল তা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct