সময়ের স্বরলিপি
মুসা আলি
___________________
অধ্যায় ১ কিস্তি ২
(একজন ক্ষুদ্র চাল ব্যবসায়ী ‘রক্তকরবী’ নাটক দেখে কীভাবে নিজেকে আমূল পাল্টে নিতে পারলেন, তা নিয়ে এ উপন্যাসের শুরুতে পরতে পরতে বিতর্ক জমে উঠেছে। কে শেষ পর্যন্ত সেই বিতর্কে প্রাণকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারলেন? স্বদেশের বিবেক দেবনাথ, নাকি বিদেশের জুলিয়াস ফুসিক? জানতে হলে পড়তে হবে ‘সময়ের স্বরলিপি’ উপন্যাসের সূচনাপর্ব।)
ভদ্রলোক নিজের পেশার সাথে শেষ জীবনের নেশাকে ঠিকমতো মেলাতে পারেন নি। একদিন সন্ধেয় পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে হইহই করে তাঁর কাছে গিয়েছিল আবদার মিশ্রিত এক অভিনব দাবী নিয়ে। পঁচিশে বৈশাখ উপলক্ষে তারা একটা নাটক মঞ্চস্থ করতে চায় কিন্তু অর্থের অভাবে তা কিছুতেই সম্ভব হচ্ছে না। কিছু সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও রয়েছে। নাচ গান আবৃত্তি ইত্যাদি। কোমলমতিদের ভাবনা, বিবেক দেবনাথকে সভাপতি করা হলে তিনি নাটকের খরচটুকু দিয়ে দিতে পারেন। সরাসরি সেই প্রস্তাবও দিয়েছিল।
বিবেক দেবনাথ নড়েচড়ে বসলেন। ভিতরে ভিতরে বুঝলেন, কেবল নাম সই করার বিদ্যে নিয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করা যায় না। অথচ ছেলেদের প্রস্তাবে বেশ সম্মানবোধ না করে পারলেন না। তো তো করে বললেন, তোরা বরং নাটক নামানোর জন্যে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে যা। আমার পক্ষে ব্যবসার প্রয়োজন মিটিয়ে অনুষ্ঠানে যাওয়া কী সম্ভব?
আবার সকলে অনুরোধ করল বিবেক দেবনাথকে, প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আপনার টাকায় নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, অন্য কাউকে সভাপতি করতে যাব কেন?
বিবেক দেবনাথ কম্পিত না হয়ে পারলেন না। বললেন, তোরা এখন ফিরে যা। আরেকটু ভেবে দেখি। ব্যবসার তাল গুছিয়ে সময়টা আগে ফাঁক করে নিই। দিন দুই পরে ক্লাবের ‘সেকরেট’ একা এলে একেবারে ‘ফইনাল’ বলে দেব।
ফাইনালকে ‘ফইনাল’ এবং সেক্রেটারীকে ‘সেকরেট’ বলার জন্যে সকলের খুব হাসি পেয়েছিল কিন্তু দেবনাথবাবুর আর্থিক চড়ে তা উবে গেল মুহূর্তে। যেমন তেমন—পাঁচ হাজার টাকা!
বিবেকের ভিতরে কেন এত বেশি সংকোচ, তা কেউ ধরতে পারল না। আর্থিক অসুবিধা দুর হওয়ায় ছেলেরা বেজায় খুশি। একরকম হই হই মনোভাব নিয়ে ফিরে গেল তারা। বারান্দায় বসে বিবেক দেবনাথ মনের পুলকে ভাসতে লাগলেন। মানুষের জীবনে অর্থবল এত বড়ো সম্মান এনে দিতে পারে? এ তো টাকার জোরে রাজমুকুট লাভ করার মতো। তখনও বিবেক টাকার বিনিময়ে সমাজ থেকে সব কিছু অত্যন্ত সস্তায় কিনে নিতে ব্যস্ত। বিবেকের ধারণা ছিল, টাকাই জীবনের মূল চালিকাশক্তি। সেই স্তরে তিনি এর চেয়ে বেশি কিছু ভাবতে পারেন নি।
অনুশীলন জোর কদমে এগিয়ে চলল। ছেলের দল সেই পর্বে ভিতরে ভিতরে কত বেশি খুশি, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। অভিনয়ে প্রতিদিন উৎকর্ষতা বেড়ে চলেছে। রাতের অন্ধকার পেরিয়ে সকালে যে সূর্য ওঠে, তাতে দুপুরের তেজ থাকে না। সেই তেজোদীপ্ত কিরণের সাথে সকালের উঁকির কোনো তুলনা চলে না। জীবনের ধাপে ধাপে যে অভিজ্ঞতা জমা হয়, সেই বোধের পূর্ণতা দুপুরের রোদের মতো। অনুষ্ঠানের দিন যত এগিয়ে আসতে লাগল, ছেলের দল নিজেদের অভিনয়ের চমৎকারিত্বে নিজেরাই তত বেশি অভিভূত হল। তাদের শ্রেষ্ঠত্বের মধ্যে লুকিয়ে থাকল বিবেক দেবনাথের অর্থসাহায্যের মাহাত্ম্য। প্রসঙ্গটুকু কিছুতেই তারা ভুলতে পারল না।
পঁচিশে বৈশাখ। সকাল থেকে নানা প্রস্তুতি শুরু হল। গতকাল বিকেলে মঞ্চ বাঁধার কাজ শুরু হয়েছিল। একটু আগে শেষ হয়েছে। সেই মঞ্চের উপরে বসে কয়েকজন অনুষ্ঠান সূচি তৈরির কাজ সেরে ফেলতে ব্যস্ত। উদ্বোধনী সংগীত হিসেবে রবীন্দ্রনাথের একটি গান বেছে নেওয়া হয়েছে। তাতে কেউ দ্বিমত পোষণ করল না।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। প্রস্তুতির কাজ শেষ। জেনারেটর এসে গেছে। সূর্য নামতে নামতে সন্ধের কোলে লুকিয়ে গেল। অনুষ্ঠানের সম্পাদক এসে বলল, একজনকে যেতে হবে বিবেক দেবনাথকে ডেকে আনতে। এ দায় এড়ানো যায় না। সমীর মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে বলল, নিমন্ত্রণ করা হয়েছে, আসার হলে এতক্ষণ এসে যেতেন।
এভাবে ভাবতে নেই সমীর। বলার সঙ্গে সঙ্গে বিবেকজ্যেঠু পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছেন। তার চেয়ে বড়ো কথা, সভাপতিত্ব করা নিয়ে নিজের অনিচ্ছা প্রকাশ করে একটা মস্ত বড়ো উদারতা দেখিয়েছেন। প্রতি বছর অনুষ্ঠান করতে গেলে জ্যেঠুর আর্থিক সাহায্য লাগবে। আমরা অনেক জুনিয়র, ডাকতে যাওয়া নিয়ে এভাবে সেন্টিমেন্টাল হতে পারি না। বরং গেলে বাড়তি সৌজন্য দেখানো সম্ভব হবে।
তাহলে কী যাব?
অবশ্যই যাবে। জ্যেঠু এলে তবেই উদ্বোধনী সংগীত শুরু হবে। সম্পাদক তখনও ভিতরে ভিতরে ভাবছেন, ডাকার জন্যেই ডাকতে যাওয়া। স্রেফ সৌজন্য রক্ষার তাগিদ। এমন মহতি অনুষ্ঠানে বিবেক দেবনাথ আসতে পারেন না। আগেও কোথাও যান নি। মঞ্চে বসার জন্য যে শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে, তা তাঁর নেই। কেবলমাত্র বড়ো ডোনেশন দিয়েছেন বলেই তাঁকে বাড়তি সমাদর দেখানো হচ্ছে। আরেকটা তুলনা সম্পাদকের মনের ইজেলে ভেসে উঠে মিলিয়ে গেল। গ্রামে দুজন মানুষ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ছেলেরা তাঁদের কাছে আগেই গিয়েছিল অর্থ সাহায্য চাইতে কিন্তু বিমুখ হয়ে ফিরতে হয়েছে। নাটক যে গণশিক্ষার অন্যতম প্রধান অঙ্গ, তা ওই দুজন শিক্ষক ভুলে গেছেন। তাঁরা ভেবেছেন, নাটক নিয়ে অনেক কিছু পড়াশোনা করার পরে তা মঞ্চস্থ করা নিয়ে এভাবে সাহায্য করার কোনো মানে হয় না। নাটক যে আম-মানুষের জেগে ওঠার সুলভ মাধ্যম, সেই উপলব্ধি তাঁরা নিজেদের বোধে নিতে পারেন নি। বোধ হয় পড়াশোনার মাত্রা অতি অল্প বলেই বিবেক দেবনাথ সেই প্রসঙ্গ তোলেন নি। শুনেই হ্যাঁ বলেছেন, নিজের মুখে টাকার অঙ্ক বলে দিয়েছেন এবং সভাপতিত্ব করার প্রশ্নে সুকৌশলে এড়িয়ে গিয়েছেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিছু জানা না থাকলে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কী বলবেন তিনি?
বাড়িতে ঢুকে সমীর দেখল, বিবেক দেবনাথ সেজেগুজে বসে আছেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আমার ভাবনা মিলে গেল বাবা। দেখছি, তোমাদের সম্পাদক মনের কথা ভালো পড়তে পারেন। সেজন্যে অপেক্ষা করে বসেছিলুম। জানতুম, কেউ একজন ডাকতে আসবে। তাহলে চলো বাবা, তোমাদের ইচ্ছেটুকু পূরণ করে আসি। একটু দেরি হয়ে গেল যা।
সমীর বুঝল, তার ভাবনা ভুল, সম্পাদকের ভাবনা সঠিক। হেলতে দুলতে সামনে হেঁটে চললেন বিবেক দেবনাথ। পিছনে সমীর। তাকে উদ্দেশ্য করে বলতে বলতে এগিয়ে চললেন, ধুতি পাঞ্জাবী পরতে অনেকটা সময় লেগে গেল সমীর। সেই কবে বিয়ের সময় একবার ধুতি পাঞ্জাবী পরেছিলুম। কেউ একজন পরিয়ে দিয়েছিল। সেই স্মৃতি সামনে রেখে আজ ধুতি পাঞ্জাবী পরে ফেললুম। ওই সময় ডাকতে এলে বেশ লজ্জায় পড়ে যেতুম বাবা। সেদিক থেকে বাঁচোয়া। তা কটার সময় অনুষ্ঠান শুরু করবে?
আপনি গেলেই উদ্বোধনী সংগীত শুরু হবে। তারপর বাকি অনুষ্ঠান। পর পর চলবে। কয়েক পা সামনে ফেলে জেনারেটরের আলো চোখে পড়তেই বিবেক দেবনাথ মনে মনে খুব পুলকিত হলেন। আলোর রোশনাই দেখতে বেশ লাগছে। আবেগে বিবেকের ভিতরটা দুলে উঠল। অলীক কল্পনায় ভেসে যেতে লাগলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে তাঁকে সভাপতি হিসেবে বরণ করে নেওয়া হল। ফুলের তোড়া হাতে তুলে দেওয়া হল। তাঁর নাম বার বার মাইকে ঘোষণা হচ্ছে। ভিতরে ভিতরে উদ্বেলিত না হয়ে পারলেন না। ততক্ষণে সামনে দাঁড়ানো দর্শক শ্রোতাদের মধ্যে তাঁকে নিয়ে নানা বিরূপ মন্তব্য শুরু হয়ে গেছে। পাঁচ হাজার টাকা সাহায্য করেছেন, এ কথা শোনার পরেও সকলে সহমত হল যে কেবল টাকার জোরে বিবেক দেবনাথের মতো মানুষকে সভাপতি করে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথকে কিছুতেই ছোটো করা চলে না।
মৃদু গুঞ্জনও শুরু হল। সবার মনে একটাই প্রশ্ন, মূর্খ বিবেক রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে কিছুই বলতে পারবেন না। বরং বেফাঁস কথা বলে কবিগুরুর প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ভক্তিতে অকারণে আঘাত করতে পারেন। কেবল টাকার জন্যে এভাবে একজন মুর্খ চাল ব্যবসায়ীকে সভাপতি করে আয়োজকরা ঠিক কাজ করল না। সেই অসন্তোষ বাড়তে লাগল দ্রুত তালে। বিশেষ করে যে দুজন শিক্ষক নাটকের জন্যে ডোনেশনের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছিলেন, তারা খুব করে আশা করেছিলেন, অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করার জন্যে নিশ্চয় তাদের ডাক পড়বে। সেই সুযোগ না পেয়ে তাঁরাই বাঁকা কথায় অসন্তোষ বাড়াতে শুরু করলেন। ফলে প্রাসঙ্গিক তিক্ততা প্রচ্ছন্ন অবহেলার সূত্র ধরে তাচ্ছিল্যের হাসিতে এবং বাঁকামনের তির্যকতায় দোল খেতে খেতে একরকম মাটিতে শুয়ে পড়ল। রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এতদিন বাঙালির মনের শিকড়ে যে রসটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা যেন বিরূপতার আগুনে মুহূর্তে সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেল।
চলবে.....
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct