জান্নাতুন ফেরদাউস: একবিংশ শতাব্দীতে এসেও আজও আমরা তথা নারীরা অনেক খানি পিছিয়ে। সভ্যতার উত্থান পতন হয়েছে তবুও আজ কোথাও একটা ফাঁক থেকে গেছে। ভারতীয় সংবিধানের ১৪ নং ধারায় বলা হয়েছে যে আইনের চোখে সকলে সমান। আবার ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে মহিলাদের বিশেষ সুযোগ সুবিধার কথা। এমন নানা সাংবিধানিক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তার কতখানি রক্ষিত হচ্ছে সেটাই দেখার বিষয়। আজকের আলোচনার বিষয় এই পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনী ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা কতখানি। এই প্রসঙ্গে আমার স্বরচিত দুটি লাইন তুলে ধরছি:
“পুরুষ সমাজের কী মানবিক বিকার
প্রতিক্ষেত্রে নারী আজ লাচার।”
উপরোক্ত এই দুই লাইনের মর্মার্থ অনুধাবন করে তার বিশ্লেষণকে তুলে ধরার জন্য মূলত এই কলম ধরা।
আমাদের মাতৃভূমি পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে মহিলাদের শিক্ষার বিকাশ ও বাল্যবিবাহ রোধের জন্য কন্যাশ্রী, রূপশ্রী-র মতো নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই প্রকল্প কিছুটা সাফল্যলাভ করেছে। এই যে নারীদের জন্য এতো প্রকল্প, পরিকল্পনা, নারী স্বাধীনতা, নারীর ক্ষমতায়ন এসব নিয়ে নানা মতবাদ স্লোগান, আইন ইত্যাদি রয়েছে কিন্তু আদৌও কি নারীরা তাদের ন্যায্য অধিকার সমমর্যাদা পেয়েছে? এছাড়াও আজও দেশে প্রতি তিন মিনিটে আটজন ধর্ষিত হয়। শুধু শারীরিক নয় মানসিকভাবেও নির্যাতনের শিকার হয় এই মহিলারা।
পুরুষ শাসিত সমাজের বিরোধিতা নয়, মহিলাদের স্বাধিকার ও তাদের সমান রক্ষার তাগিদের কথাই তুলে ধরা দরকার। কেউ কেউ প্রশ্ন করতে পারেন আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমি কেন এমন প্রশ্ন চিহ্নের সামনে সামনে আসছি? তাঁদের উত্তরে বলছি মহিলাদের অগ্রাধিকার এর পক্ষপাতিত্ব করছি না। শুধু মহিলাদের সমানাধিকার আর প্রাপ্য সম্মানটুকু ফিরে পাক এটাই চাইছি। মহিলাদের সর্বক্ষেত্রে মর্যাদা রক্ষার কারণেই সোচ্চার হয়েছি।
বর্তমানে নারীদের অধিকার নির্বাচনে কতখানি রক্ষিত হল সে বিষয়ে এক মহিলা হিসেবে ভাবনা চিন্তার একটা দায় বর্তায়।
আমাদের দেশের পাশাপাশি রাজ্যের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক চিত্র অবলোকন করলে এই বিষয়ে ধারণাটি সুস্পষ্টভাবে উঠে আসবে।
এই প্রসঙ্গে তুলে ধরছি ২০০৮ সালের ১০৮তম সংশোধনী বিল-এর কথা। যেখানে বলা হয়েছে নির্বাচন ক্ষেত্রে ১/৩ অর্থাৎ ৩৩শতাংশ মনোনীত হবে মহিলাদের মধ্য থেকে। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন ও ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচন এর মনোনীত প্রতিনিধি তালিকা দেখলেই এ বিষয়ে একটা সুষ্ঠু ধারণা পাওয়া যাবে। ২০১৯ সালে ১৭তম লোকসভা নির্বাচনে দেখেছি এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ যেখানে ১৮১ জন মহিলা মনোনীত হবার কথা সেখানে মাত্র ৭৮ জন মনোনীত হয়েছিলেন। আর ২০২১ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মহিলা ভোটার ৪৯শতাংশ। আর মনোনীত প্রতিনিধি যেখানে ৯৮জন হওয়ার কথা সেখানে মাত্র ৫০জন অর্থাৎ ১৭ শতাংশ। আশা করি বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে আপনাদের কাছে। একই ভাবে রাজ্য মন্ত্রিসভায় মহিলা মন্ত্রীর উপস্থিতির হার দেখলেই বোঝা যাবে উপেক্ষার বিষয়টি। যদিও এটা বলতে দ্বিধা নেই যে, রাজ্যের শাসক দলে অন্যান্য দলের চাইতে সবচাইতে বেশি মহিলা বিধায়ক। সেটা খানিকটা আত্মসন্তুষ্টি দিতে পারে। অন্য দলগুলির ক্ষেত্রে তাও নয়।
আজ দেশের তথা আমাদের রাজ্যের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট অবলোকন করলে দেখা পাই যে মহিলারা চূড়ান্ত অবহেলিত, লাঞ্ছিত বঞ্চিত। ঘরে বাইরে কোথাও নিরাপদ নয় মহিলা। প্রাচীন কালেও যেমন মহিলা ছিল ভোগ্যপণ্য আজও ঠিক তেমনি বিবেচিত। এক নারীর গর্ভে জন্মেই আর এক নারীকে অবমাননা। এটা যে একজন নারীর কাছে কতখানি লজ্জার তা বলে বোঝানো যাবে না। যে নারী ছাড়া জগৎ সংসার অচল সেই নারীকেই হতে হয় এমন অকথ্য নির্যাতনের শিকার।
মনের মণিকোঠায় প্রশ্ন জাগে এটাই যে, নারীর ক্ষমতায়ন নারীর উন্নয়নের নামে এইভাবে নারীর অবমাননার মধ্য দিয়ে কী বার্তা দিতে চায় আমাদের সমাজ।
এত অন্যায় অত্যাচার সত্ত্বেও বিশ্বের দরবারে আজও মহিলারা তাদের নিজ কর্মগুণে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজ স্থান অর্জন করেছে। তাঁর প্রমাণ ইতিহাসের পাতায় পাতায় রয়েছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সুলতানা রাজিয়া, লক্ষ্মীবাঈ, ইন্দিরা গান্ধী, বেগম রোকেয়া, জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যারা মহিলাদের দক্ষতা ও উৎকর্ষতার স্বাক্ষর রেখে গিয়েছেন বা রাখছেন তারা কিন্তু পুরুষদের অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারেন।
এই প্রসঙ্গে জাতিধর্মের উর্ধ্বে বিচরণকারী বিশ্বজয়ী স্বামী বিবেকানন্দের নারী শিক্ষা বিষয়ক একটি কথা মনে পড়ছে। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন: “পাখির উড়তে গেলে যেমন দুটি ডানা প্রয়োজন ঠিক তেমনি নারী জাতির অবস্থা উন্নত না হলে জগতের উন্নতি সম্ভব নয়”।
তাই নারীকে যাঁতাকলে পিষে না ফেলে তাদের সুযোগ দিন।
বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের কয়েক দফা ভোটের চিত্র অবলোকন করলে দেখা যায় যে, এই ভোটযুদ্ধে যে খুনোখুনি রক্তারক্তি কাণ্ডহয়েছে সেখানে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নারী, নারীকেই হারাতে হয়েছে সন্তান, স্বামী, ভাই, বাবা ।
নারী মানেই অবহেলা, নারী মানেই হাঁটুর নীচে বুদ্ধি, নারী মানেই দশ হাত কাপড়ের ন্যাংটা- এসব ভাবনার জগদ্দল পাথর যতদিন না সরবে ততদিন নারীর ক্ষমতায়নের নামে এমন ভণ্ডামি চলতেই থাকবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা নারী ক্ষমতায়নের স্বরূপ দেখিয়েছেন। সমগ্র দেশে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনিই এখন সবার আগে বলা যায়। এমনকী সোনিয়া গান্ধিকেও ছাপিয়ে গিয়েছেন রাজনৈতিক জনপ্রিয়তায় কিংবা দক্ষতায়। কিন্তু একা মমতাকে দিয়ে বিচার করা সমীচীন নয়। কেন সমাজে আরও মমতা তৈরি হবে না। তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক থেকে সর্বক্ষেত্রে মহিলাদের বিশেষ ক্ষমতায়ন। তা না দিলে সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করবে না। এই ক্ষেত্রে কবি নজরুলের কবিতার ছত্র মনে পড়ছে, ‘বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ তাই শুধু নারী নয় মানুষ রূপে বাঁচতে দিন। নারীর সাংবিধানিক অধিকার সুযোগ-সুবিধা সর্বক্ষেত্রে ফিরিয়ে দেওয়া অতি প্রয়োজন। নচেৎ, সমাজের প্রকৃত বিকাশ সম্ভব নয়।
(মতামত লেখিকার ব্যক্তিগত)
(লেখিকা মহিলা সমাজকর্মী)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct