দিলীপ মজুমদার: সোমবার, ১৭মে, সারাদিন ধরে টান টান উত্তেজনার মধ্যে বঙ্গরঙ্গমঞ্চে যে নাটকটি অভিনীত হল, তার চিত্রনাট্যটিকে রচনা করেছেন জানি না। চিত্রনাট্যটি চমৎকার। কিন্তু তার মধ্যে এত ফাঁক থেকে গেল যে রচয়িতার কাঙ্খিত ফললাভ হবে না। বরং বলা চলে এই চিত্রনাট্যটি রচয়িতাদের ব্যাক ফায়ার করবে। সোমবার ভোরবেলা বাংলার শাসকদলের দুই মন্ত্রী ও এক বিধায়ক এবং আপাতত কোন-দলে- না থাকা কলকাতার প্রাক্তন মেয়রকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সন্ধেবেলা অবশ্য বিচারক তাঁদের জামিন মঞ্জুর করেন। যে স্ট্রিং অপারেশনকে সুপ্রিম কোর্ট খুব একটা মান্যতা দেন নি, সেই স্ট্রিং অপারেশনের সূত্রে এদের গ্রেফতার। ম্যাথু স্যামুয়েলের একটি ভিডিওতে এইসব নেতাদের টাকা নিতে দেখা গেছে। টাকার অঙ্কটা দু-চার লক্ষ টাকা। সিবিআই যে নেতাদের অভিযুক্ত করেছেন, তাঁরা যে সর্বৈবভাবে দুর্নীতিমুক্ত, সে কথা আমি বিশ্বাস করি না। ভারতবর্ষের রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দুর্নীতি আষ্টেপৃষ্টে জড়িত। টি এন শেষণের বইটি পড়লে কিছুটা বোঝা যাবে। তাই মাত্র দু-চার লক্ষ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে গ্রেফতারের ঘটনায় হাসি পায়। তাছাড়া এক আইনজীবী বলেছেন ভিডিওতে টাকা নিতে দেখা গেছে, টাকা চাইতে নয়; তাই এটা ঘুষ বলে প্রমাণ করা যায় না।
এসব কথা থাক। যে চিত্রনাট্যের কথা বলছিলাম, সেটা একটু সাজিয়ে নেওয়া যাক এক, দুই করে।
১. ২ মে। নির্বাচনের ফল ঘোষণা। তৃণমূলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা। প্রধান ও একমাত্র প্রতিপক্ষ বিজেপি। নির্বাচনের আগে বিজেপির সর্বভারতীয় ও বঙ্গ নেতারা ২০০টি আসন পাবার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিলেন। uএরপর দুয়ের পাতায়
প্রতিটি ফেজে কত আসন পাবেন, তা বলে দিচ্ছিলেন অমিত শাহ।
২. ফল ঘোষণার পরের দিন থেকে বিজেপি অভিযোগ শুরু করলেন তাঁদের কর্মী ও সমর্থকদের উপর হামলা চালাচ্ছে তৃণমূল, হত্যা করছে। মন্ত্রীসভা গঠনের আগেই রাষ্ট্রপতি শাসনের মৃদু দাবি ভাসিয়ে দেওয়া হল।
৩. আসরে নামলেন রাজ্যপাল। শপথ ঘোষণার দিনই তিনি প্রকারান্তরে শাসকদলের সমালোচনা করলেন আইন-শৃঙ্খলা ব্যাপারে। তারপরে তিনি বিজেপির অভিযোগকে মান্যতা দেবার জন্য ঘুরতে লাগলেন নানা জায়গায়, শীতলকুচি থেকে নন্দীগ্রামে। বিজেপি সাংসদকে নিয়ে হেলিকোপ্টারে গেলেন। অত্যাচারিত বিজেপি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করলেন।তাঁকে যখন বলা হল তৃণমূলের কর্মী সমর্থকরাও আক্রান্ত, তখন তিনি বললেন, ‘জানতাম না তো।’ এমন কী হাত ভেঙে উদয়ন গুহ যে হাসপাতালে, সেটাও তাঁর জ্ঞানের অগোচরে।
৪. সিবিআইকে গ্রেফতারের অনুমতি দিয়ে দিলেন রাজ্যপাল। স্পিকার বা মন্ত্রিসভার অনুমতিকে গ্রাহ্য না করে।
৫. এর মধ্যে ক্রমাগত ট্যুইট করে চলেছেন রাজ্যপাল। রাজ্যে ভেঙে পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা। বড় উদ্বিগ্ন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী মোটেই পালন করছেন না রাজধর্ম। রাজ্যপালের অভিযোগ। আইন শৃঙ্খলার অবনতির কথা রাজ্যপাল ও বিজেপি খুব বেশি করে বলছেন। কারণ আছে। এই একটি অস্ত্রে নির্বাচিত সরকারকে খারিজ করা যায়।
৬. ১৭ মে ভোরবেলা সুব্রত মুখোপাধ্যায়, মদন মিত্র, ফিরহাদ হাকিম ও শোভন চট্টোপাধ্যায়কে গ্রেফতার করা হল সংশ্লিষ্ট থানাকে কিছু না জানিয়ে। গ্রেফতারেরও নাটক আছে। বিরাট বাহিনী নিয়ে পাড়া ঘিরে ফেলা হল, ঘেরা হল বাড়ি, যেন দাগী আসামী বা সন্ত্রাসবাদীকে ধরতে এসেছেন তাঁরা। এমন একটা ভঙ্গি করা হল যাতে অভিযুক্তদের ভাবমূর্তি কলঙ্কিত হয়।
৬. নিজাম প্যালেসে রাখা হল অভিযুক্তদের। তৃণমূল কর্মিরা জড়ো হতে লাগলেন প্রতিবাদে। তাঁরা যে জড়ো হবেন, সেটা জানা ছিল অভিযোগকারীদের। জড়ো হবার পরে তাঁদের বিক্ষোভকে নিয়ে আর এক দফা পরিকল্পনা করলেন চিত্রনাট্য রচয়িতারা। তাঁরা এরপরে হিংসা ছড়ানোর অভিযোগ হাজির করলেন। এ কথা অবশ্য ঠিক যে কর্মী-সমর্থকরা অহিংস ছিলেন না, তৃণমূল নেতারা তাঁদের সামলে না রেখে চিত্রনাট্যরচয়িতাদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছেন।
রাজ্যপাল ট্যুইটে পরে ট্যুইটে মুখ্যমন্ত্রীকে এসবের ফলাফলের কথা বলে চোখ রাঙাতে থাকলেন। কোভিড নিয়ন্ত্রণবিধি না মানার অভিযোগও উঠল। বলা-নেই-কওয়া-নেই দলের নেতাদের গ্রেফতার করলে কর্মীরা অশান্ত হয়ে উঠবেন, এটা জেনেই ফাঁদ পাতা হয়েছিল।
এই হল চিত্রনাট্য। চমৎকার। কিন্তু সাধারণ মানুষ, এমন কী তৃণমূলের উপর বিক্ষুব্ধ হয়ে যাঁরা বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন, তাঁদের প্রতিক্রিয়া কী হল? সকলের চোখের সামনে চিত্রনাট্যরচয়িতা কী উলঙ্গ হয়ে গেলেন না? দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে গেল না কি এটা এক গট আপ গেম?
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct