মোঃ আরিফ বিল্লাহ: ১৫ ই এপ্রিল ২০২১,রোজ বৃহস্পতিবার সুবেহ সাদেকের পূর্বে (রাত ৩:৩০ নাগাদ) না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন আমার চোখে দেখা জীবন্ত জীবাশ্ম, আধুনিক বাংলার সংখ্যালঘু সমাজের নবজাগরণের পথ প্রদর্শক ৮৭ বছর বয়সের সুপারম্যান জনাব আলহাজ্ব, হাফেজ গোলাম আহমাদ মোর্তজা সাহেব (রহ.)!
কারো কাছে তিনি বক্তাসম্রাট, কারো কাছে গ্রন্থ প্রণেতা, কারো কাছে সমাজসেবী, কারো কাছে মনীষী, কারো কাছে ঐতিহাসিক , আবার কারো পিতা............!
আর আমাদের (মামূন স্কুলের ছাত্র/ ছাত্রী) কাছে আবেগ আর ভালোবাসার দাদাজী!
আমাদের দাদাজ্বীকে আমরা যেভাবে জানি পৃথিবীর আর কেউ হয়তো সেভাবে জানে না!
কারণ?- কারণ আমাদের কাছে উনি নিজেকে যেভাবে প্রকাশ করেছেন সেই রূপে হয়তো অন্য কোথাও নিজেকে প্রকাশ করেননি! তাই আমাদের ও একটা দায়িত্ব থেকে যায় আমাদের দাদাজ্বী কেমন ছিলেন তা আমাদের বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার!!
আমি তখন খুব ছোট, শৈশবের কাঁটাতার তখনও পেরোয়নি, সম্ভবত ক্লাস ফোর কি ফাইভে পড়ি !সেই সময়ে মেমারি জামিয়া থেকে আব্বু কিছু বক্তৃতার ক্যাসেট কিনে এনেছিলেন, টেপ রেকর্ডারে বাজতো! প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে টেপ রেকর্ডারে বাজতে থাকা সেই বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা আমার জন্য অলিখিত নিয়ম হয়ে গিয়েছিলো!
তখন আমার কাছে তিনি বক্তা সম্রাট গোলাম আহমাদ মোর্তজা সাহেব হিসেবেই পরিচিত!
তারপর ২০০৮ সাল, আসলো সেই মাহিন্দ্রক্ষণ তাঁরই হাতে গড়া প্রতিষ্ঠান “Mamoon National School” এর ছাত্র হিসেবে জীবনের নতুন ইনিংস শুরু!
স্কুলের উদ্বোধনীর তৃতীয়বর্ষে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম ২০০৮ সালে !তখন থেকে গোলাম আহমাদ মোর্তজা সাহেব আমাদের কাছে “দাদাজী!”
উচ্চমাধ্যমিক শেষ করে যখন বের হয় তখন সালটা ২০১৫ ! কেটে গিয়েছে দীর্ঘ্ ৮ বছর!
শৈশব, কৈশোর আর যৌবনের সোনালী মুহূর্ত কেটেছে প্রাণের ক্যাম্পাস”Mamoon National School”এ!
৮ বছরের এই দীর্ঘ সময়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি তাঁকে! আর আমি এদিক থেকে একটু বেশিই সৌভাগ্যবান কারণ তাঁর স্নেহের পরশ খুব কাছ থেকে যারা পেয়েছে আমি ও তাদের একজন! আমাদের সময়কালে যারা মামূনে ছিল তারা ও জানে “দাদাজী!”আমাকে ঠিক কতোটা বেশি স্নেহ করতেন!
আমাদের সময়ে সাপ্তাহিক সান্ধ্যকালীন বক্তৃতার যে আসর বসতো সেই প্রোগ্রামের মাইক ঠিক করা, চেয়ার নিয়ে আসা, জলের গ্লাসে জল নিয়ে “দাদাজী!”র হাতে তুলে দেওয়া! জল খাওয়া হয়ে গেলে জলের গ্লাসটা গেস্ট রুমে রেখে আসা এসব কাজের মাক্সিমামগুলো আমি নিজ হাতেই করতাম!
জীবন পরিচালনা ,জীবনের নীতিনির্ধারণ, আনন্দ-দুঃখ ,হাসি কান্না চড়াই উৎরাই জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্র সহজভাবে কি করে মানিয়ে নেওয়া যায় তার শিক্ষা দিতেন! তাঁর আধ্যাত্বিক ও জাগতিক জ্ঞান ভান্ডারের দার সবসময় আমাদের জন্য উন্মুক্ত রাখতেন!! তুচ্ছ থেকে বৃহৎ জীবনের যেকোনো সমস্যা সমাধানের জন্য দিতেন অমূল্য দিকনির্দেশনা !
তিনি স্বপ্ন দেখতেন আধুনিক শিক্ষার সাথে ধর্মীয়শিক্ষার সংমিশ্রণের! আমাদের বার বার বলতেন-” ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার উকিল ,মাস্টার, সাংবাদিক যা হবে হও ঈমানের পথ থেকে হারিয়ে যেও না! ডাক্টার, মাষ্টার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল ছেলের বাবা /মা মারা গেলে জানাযাহ নামাজের ইমামতি যেনো সে করতে পারে! তবেই সে প্রকৃত শিক্ষিত, তবেই সে এক্সট্রা অর্ডিনারি “!
Mamoon National School এর ছেলেদের অধিকাংশেরই চল্লিশটা হাদীস মুখস্থ থাকতো! আলহামদুলিল্লাহ অনেক প্রাক্তনীর এখনো মুখস্থ আছে হয়তো! এই হাদীস মুখস্থ করার জেদটা ও তৈরি করে দিতেন আমাদের প্রিয়”দাদাজ্বী!”!
ছোট্ট একটা ঘটনা বলি - একদিন সন্ধ্যাবেলা “দাদাজী”এসেছেন সাপ্তাহিক সান্ধ্যকালীন বক্তৃতা দিতে ! ফার্স্টফ্লোরের সভাগৃহের বাইরের চাতালে বসে আছেন!
উনাকে দেখা মাত্রই সালাম দিলাম সালামের উত্তর দিলেন এবং সাথে সাথেই বললেন _“তুই তো হাদীসের হিরো হয়ে গেলি রে, যাহ তোর জন্য দুয়া করে দিলাম ফর্সা বউ পাবি ( জানিনা এটা আমি কালো বলেই হয়তো বলেছিলেন ফর্সা বউ এর কথা হাহা...!)”
কথাটা শুনে আমি লজ্জা পেয়ে গিয়েছিলাম ! মাথা নিচু করে বললাম “দাদাজী! আপনাকে এক বৈঠকে চল্লিশটা হাদিস শুনাতে চাই একদিন”। উত্তরে তিনি বললেন “যারা মেহেন্দি বাঁটে তাদের কে আলাদা করে মেহেন্দি লাগাতে হয়না, আমি জানি তুই পারবি! আই একটা চুমু খায় তোর কপালে”। এটা বলে কাছে ডেকে নিয়ে কপালে চুমু খেয়েছিলেন!!
আমার জীবনের স্মরণীয় একটা দিন ছিলোওটা!আনন্দে চোখে জল চলে এসেছিলো !তাঁকে ঘিরে হাজারো স্মৃতি ভিড় করেছে আমার স্মৃতির সমুদ্র বন্দরে! সব বলে শেষ করা সম্ভব না!
১৯৩৫ সাল দেশ তখনো পরাধীন ঠিক সেই সময় বর্ধমানের অজ পাড়া-গাঁ মিরেটডাঙ্গার আব্দুল আজিজ ও নাসিফা খাতুনের কোল আলো করে জন্মনিলেন আধুনিক বাংলার দীপ্তসূর্য্য গোলাম আহমেদ মোর্তজা!
প্রথম জীবনে গৃহ শিক্ষকের কাছে তালিম এবং পরবর্তীতে বর্ধমানের করচগ্রাম মাদ্রাসা থেকে হাফিজ পাশ!
তিনি বলতেন প্রথম জীবনে তিনি তোতলা ছিলেন, জিহ্বার আড়ষ্টতার জন্য বক্তৃতা দেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও কথা বলতে সমস্যা হতো তাই বক্তৃতা করতে পারতেন না!
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত নবী মুসা (আঃ) র ঘটনা দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন!!
মুসা (আ. ) প্রথম জীবনে ভালোভাবে কথা বলতে পারতেন না পরে আল্লাহ্ র কাছে দুআ চেয়ে একজন সুবক্তা হয়ে উঠেছিলেন!
তিনি ও মুসা আ.-এর মতো আল্লাহর কাছে দুআ চাইলেন আল্লাহ্ তা কবুল করলেন এবং জিহ্বার আড়ষ্টতা কেটে গেলো! হয়ে উঠলেন সুবক্তা, শুধু সুবক্তাই না পরবর্তীতে সেই তোতলানো মানুষটারই বক্তা সম্রাট হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটোল!
তাবলীগ জামাতের প্রীতি তাঁর ছিলো অসীম ভক্তি আর ভালোবাসা। তিনি বলতেন তাবলীগ জামাতের মগরাহাটের সেই সময়ের আমিরের সংস্পর্শে এসে তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছিল! স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থান সামনে থেকে প্রত্যক্ষ করেছিলেন একই সাথে প্রত্যক্ষ করেছিলেন দেশ ভাগ ও মুসলিম সমাজের বঞ্চনা!
ধর্মীয় গোঁড়ামি দূরীকরণ ও সমাজ সংস্কারের লক্ষ্যে শুধূ মাত্র বক্তৃতা করেই থেমে থাকেননি লিখেছে বেশ কিছু অমূল্য রত্নগ্রন্থ!
তাঁর জীবনের প্রথম লিখিত মুদ্রিত ও প্রকাশিত বই ছিলো “পুস্তক সম্রাট” যা জাতি-ধর্ম ,ভাষা-বর্ণ আবালবৃদ্ধবনিতা সকলের কাছে সমাদৃতও গ্রহনযোগ্য হয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল!
পরবর্তীতে তাঁর লেখা “ইতিহাসের ইতিহাস”বইটি ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয় এবং ১৯৮২ সালে বইটি নিষিদ্ধ হয়ে যায়! সেই সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ছিলেন দেশের বাইরে ! আর এস এস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের পক্ষ থেকে বিধানসভার তৎকালীন ডেপুটি স্পিকার কলিমুদ্দিন শামসের কাছে দাবি করা হয় বইটি নিষিদ্ধ করার ,বইটি ভালো মতো না পড়েই নিষিদ্ধ করা হয়!
কিন্তূ তিনি তো থেমে যাওয়ার পাত্র না নাম পরিবর্তন করে ঐ বইটি আবার প্রকাশ করলেন নাম দিলেন “চেপে রাখা ইতিহাস”! তাঁর অশ্বমেধের ঘোড়া এভাবেই চলতে থাকে ঝলসে উঠে লেখকের কলম একে একে লিখতে থাকেন “ইতিহাসের এক বিস্ময়কর অধ্যায়”. “বিভিন্ন চোখে স্বামী বিবেকানন্দ”, “৪৮০ টি হাদীস ও বিশ্ব সমাজ” , জাল হাদীস ও বিশ্ব সমাজ” “ এ সত্য গোপন কেনো” এ এক অন্য ইতিহাস”, বাজেয়াপ্ত ইতিহাস”, সেরা উপহার, রক্তমাখা ছন্দ, অনন্য জীবন, সৃষ্টির বিস্ময়, বজ্রকলম, মুসাফির সহ বেশ কিছু অমূল্য গ্রন্থ! এবং সব শেষে লিখলেন, “পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ”।
মুসলিম সমাজের সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৮৩ সালে তিনি গড়ে তুলেছিলেন ইংরেজি মাধ্যম স্কুল দীর্ঘ ১১ বছর চলার পর সেটা বন্ধ হয়ে যায় রাজনীতির শিকার হয়ে!
তার আগে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন “ইসলামিয়া মাদ্রাসা কারিগরি শিক্ষাকেন্দ্র “ যা পরবর্তীতে “জামিয়া ইসলমিয়া মদিনাতুল উলুম মেমারী” নামে আত্মপ্রকাশ করে!
পরবর্তীতে গড়ে তোলেন “মেমারি হাই মাদ্রাসা “ বর্তমানে সেটা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত!
এরপর গড়ে তোলেন স্বপ্নের “ Mamoon National School (Boys)!
“নারী শিক্ষার গুরুত্বের কথা ভেবে ২০১১ সালে পানাগড়ে ভিত্তি স্থাপন করেন “Mamoon National School (girls)” ক্যাম্পাসের! তিনি বলতেন নারীদের হিজাব থাকবে, অবরোধ থাকবে না, শালীনতা থাকবে!
মুসলিম সমাজকে শিক্ষার মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে তিনি ছিলেন “হ্যামিলিওনের বাঁশিওয়ালা”!
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই কিন্তূ তাঁর আদর্শ তাঁর স্মৃতি আমাদের সাথে থেকে যাবে আমৃত্যু!.... ইনশা আল্লাহ!
সেদিন দ্বিতীয় রমজান,১৫ই এপ্রিল ২০২১ !ওদিকে মেমারি জামিয়ার মসজিদে আসরের নামাজ চলছে এমন সময় “দাদাজী!”র শববাহী গাড়ি এসে থামলো জামিয়ার”শেফা খানা” র সামনে! দীর্ঘদিন পর তাঁর সাথে দেখা হলো কিন্তূ কথা হলো না ! কফিনবন্দি দেহ নিয়ে যাওয়া হল সোসাইটি বিল্ডিং এ! করোনা মহামারীর সময় তাই সামাজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে রাত ৮ টায় তাঁর জেষ্ঠো পুত্র, মামুন স্কুলের সুনামধন্য কর্ণধার কাজী ইয়াসিন সাহেবের ইমামতিতে জানাজা নামাজ সম্পন্ন হল জামিয়া ক্যাম্পাসে!
তাঁর মৃত্যু দেহের খাটিয়া নিয়ে আশা হলো জামিয়া ক্যাম্পিসস্থিত মাকবুরাতে (কবর)! বাঁশের ব্যারিকেডে ঘেরা কবরের নিকট হাতে গোনা কয়েকজন ঢুকলো আমিও ছিলাম তাদের একজন!
খাটিয়া ধরে শেষ ঠিকানায় নিয়ে যাওয়া ও কবরে নামানো পর্যন্ত কাজে আমিও অংশ গ্রহণ করলাম! নিথর দেহটা কবরে নামিয়ে বাঁশের ( প্রচলিত) পরিবর্তে সাদা মোজাইক পাথর দিয়ে উপরে ঢেকে দেওয়া হলো! সেই চারটে পাথরের প্রত্যেকটা পাথর স্পর্শ করলাম কবরে নামাতে অংশগ্রহন করলাম ,শেষ বারের মতো দেখলাম যুদ্ধজয়ের হাসি হেসে প্রিয় প্রভুর সাথে সাক্ষাত করতে চলে গেলেন!! আল্লাহ্ আমাদের প্রিয় দাদাজি কে জান্নাতুল ফেরদাউসের সর্বোচ্চ মাকাম দান করো!! আমিন!!!
(লেখক প্রাক্তন ছাত্র, মামুন ন্যাশনাল স্কুল)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct