দিলীপ মজুমদার: ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত, বিশেষ করে হিন্দুস্থানী ও কর্ণাটকী সংগীতে প্রচলিত আছে ‘যুগলবন্দি’। এটা ‘সওয়াল জবাব’ নয়। এতে দুজনের কণ্ঠ বা যন্ত্রসংগীত পরিবেশিত হয়। প্রথমে এক একজন নিজস্ব রীতির কম্পোজিশন পরিবেশন করেন, তারপর দুজনে মিলে কোন সাধারণ কম্পোজিশন পরিবেশন করেন।
সেই সাধারণ কম্পোজিশনের ভিত্তি কোন ‘রাগ’, যে ‘রাগ’-এ দুজনের সাংগীতিক ঐতিহ্য আছে ; যেমন ইমন-কল্যাণী, ভৈরবী-সিন্ধুভৈরবী। যুগলবন্দির কথা উঠলে আমাদের মনে পড়ে যায় আলি আকবর খানের সরোদ আর পণ্ডিত রবিশংকরের সেতারের কথা।
এরপরে আরও অনেক ‘যুগলবন্দি’ হয়েছে। যেমন রাশিদ খান ও বাবুল সুপ্রিয়, হারিহরণ ও বিক্রম ঘোষ ইত্যাদি।
যুগলবন্দির রীতিটি বাংলা সাহিত্যেও আমদানি করার চেষ্টা হয়েছে। যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের যুগলবন্দি কবিতা। কিন্তু রাজনীতিতেও যে যুগলবন্দি হয়, এবং তা হলে যে বাজিমাৎ করতে পারে, তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন ড. বিনয় সীতাপতি তাঁর বই ‘যুগলবন্দি : দ্য বিজেপি বিফোর মোদি’তে। সে বইএর কথা পরে বলছি। কিন্তু বিন্য় সীতাপতির আলোচনার মাধ্যমে আমি সিপিএম দলের এক অনন্য যুগলবন্দিকে দেখতে পেলাম।
বলছি জ্যোতি বসু আর প্রমোদ দাশগুপ্তের কথা। জ্যোতি বসু সামলাতেন প্রশাসন, প্রমোদ দাশগুপ্ত সামলাতেন পার্টি সংগঠন। এটাই ছিল সিপিএমের শক্তির উৎস। এরই জোরে সত্তর, আশি, নব্বুইএর দশকে বঙ্গ রাজ্যে দাপিয়ে বেড়িয়েছে সিপিএম। প্রমোদবাবু মারা যাবার পরে তাল গেছে কেটে। সরোজ মুখোপাধ্যায়, অনিল বিশ্বাসরা সংগঠনের প্রধান হয়ে এসেছেন কিন্তু যুগলবন্দির ছন্দ বজায় রাখতে পারেননি। বিনয় সীতাপতি আমাদের দেখিয়েছেন বিজেপির ‘যুগলবন্দি’। আজ যে বিজেপি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারা ভারত, প্রায় আঠারোটি রাজ্যে করায়ত্ত করেছে ক্ষমতা, তার মূলে আছে এই যুগলবন্দি। এ দলে গোড়া থেকেই ছিল এই যুগলবন্দি। ছিলেন একজন বক্তা আর একজন সংগঠক ; একজন প্রশাসনের দিকটা দেখবেন, আর একজন দেখবেন পার্টির সংগঠনের দিকটা।
জনসংঘের আমলে একদিকে ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, আর একদিকে ছিলেন দীনদয়াল। ১৯৮০তে বিজেপির জন্ম হল। তখন দেখা গেল অটলবিহারী বাজপেয়ী আর লালকৃষ্ণ আদবানি জুটিকে। এই জুটি হিন্দত্বের ধারণাকে, বিজেপিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিল।
২০১৪তে আমরা দেখলাম আর এক আশ্চর্য জুটিকে। দেখলাম আশ্চর্য এক যুগলবন্দি। নরেন্দ্র মোদি আর অমিত শাহকে। এঁদের আমলে হিন্দুত্ব ও বিজেপি ছড়িয়ে পড়ল ভারতময়। যেন হিন্দুত্বের যৌবনজলতরঙ্গ।
এখন সেই জলতরঙ্গ বঙ্গভূমে আছড়ে পড়ছে। মমতা কী রুখতে পারবেন সে জলতরঙ্গ ? পারতেন, যদি তাঁর দলে ‘যুগলবন্দি’ থাকত। তাঁর দল একটা আছে। তৃণমূল কংগ্রেস।
কিন্তু সে দলের যুগল নেই। তাই মমতাকে বলতে হয় ২৯৪টি আসনে তিনিই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। মানুষ যেন তাঁকে ভোট দেন। এ কথা প্রমাণ করে তিনি কার্যত একা। ছিন্নপাতায় সাজাই তরণি একা একা।
(মতামত লেখকের নিজস্ব)
(লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct