নীপু গোলদার: আমাদের সমাজে নাকি উন্নতি হয়েছে, আসলে কি সত্যি ই উন্নত হয়েছে? সেই কথাটা আমাদের নিজেদেরই বুঝতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, যুগ সত্যিই এগিয়েছে। আজ মানুষ ঘরে বসেই বাজার পেয়ে যায় ।শুধু অনলাইনে অর্ডার করলে। ঘরে বসে অফিসের কাজ করতে পারি। বাড়ি বসে গ্যাসের বিল, কারেন্টের বিল সবকিছু দিতে পারি। কয়েক বছর আগেও এত সহজ ছিল না, মানুষের জীবন। সকাল হলে দেখতাম, বাবা বাজারের ব্যাগটা নিয়ে বাজার যাচ্ছে। আজ দিন বদলেছে, শুধু ফোনটা হাতে নিয়ে অর্ডার’ দিলেই, বাজার বাড়ি চলে আসে।
তাই আমাদের বলতেই হয় সমাজ উন্নত হয়েছে। কিন্তু আমরা কি সত্যিই উন্নত হতে পেরেছি? প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
বাবা-মা সন্তানকে বড় করতে কত কষ্ট করে, কত ত্যাগ স্বীকার, করে সন্তানের জন্য। বাবা-মার জীবনটা সবটাই চলে যায়, সন্তানদেরকে মানুষ করতে।আর সেই সন্তানরাই বাবা-মাকে অস্বীকার করে। যে বাবা-মা সন্তানদের জন্য নিজেদের মূল্যবান সময়কে ব্যয় করেছে যে বাবা-মা তাদের মুখের খাবার তুলে দেওয়ার জন্য ক্রমাগত পরিশ্রম করেছে, এমনকি নিজেদের সুখের দিকে না তাকিয়ে, তাদের পড়াশুনা আর তাদের দাবি পূরণ করেছে। আর তার পরিবর্তে সেই সন্তানদের কাছ থেকে শুধু অবহেলা পেয়ে চলেছে।
যে বাবা-মা দু’তিনটে সন্তানকে, নিজেরাই এক হাতে মানুষ করেছে। আজ সেই সন্তানরা বাবা-মা কে ভাগাভাগি করে দেখে।একজন বাবা সামান্য কাজ করে, দু তিনটে সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে একজনকে উকিল, একজনকে ডাক্তার, একজনকে ইঞ্জিনিয়ার, বানাতে পারে। অথচ সেই সন্তান নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে, অর্থ উপার্জন যখন করে, তখন বাবা-মাকে অস্বীকার করে। তাদের কাছে বাবা-মা হয়ে যায় বোঝা, তখন সামান্য কিছু টাকা দিয়ে বৃদ্ধাশ্রম পাঠিয়ে, নিজেকে দায়মুক্ত করতে চায়।
তাহলে আমরা এই শিক্ষা কে কি বলবো? আর এই বড় মানুষ হওয়া কেই বা কি বলবো? যে শিক্ষার মধ্যে মানবিকতা নেই, যে শিক্ষার মধ্যে ভালোবাসা নেই, যে শিক্ষার মধ্যে সম্মান নেই, সেই শিক্ষার কোন মূল্য ও নেই। যে শিক্ষা বাবা-মাকে মূল্য দেয় না, যে শিক্ষার মধ্যে শুধু অবহেলা, সেই ডাক্তার উকিল হওয়ার থেকে, একজন মানবিক মূল্যবোধ সন্তানের অনেক দাম। সেই সন্তান যদি দিনমজুর হয়, তাও সেই সন্তান হবে, একজন বাবা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তান। বাবা মা সন্তান মানুষ করতে, সংসারের দায়-দায়িত্ব পালন করতে, কখন যে বার্ধক্য এসে যায়, বুঝতেই পারে না। আর যখন বুঝতে পারে, নিজেদের জন্য কিছু করতে হবে, তখন শক্তি থাকে না।
বৃদ্ধ বাবা-মা যখন ঘরের মধ্যে বন্দি হয়ে জীবন কাটায়, তখন যদি তাদের মনে হয়, বাইরে কোথা থেকে একটু ঘুরে আসবে, তাদের নিয়ে যাওয়ার কোন মানুষ থাকে না। এমনকি তাদের সঙ্গে কথা বলার মত, মানুষ তারা পায় না। তাদের জীবন একাকীত্ব ভাবে দিন কেটে যায।যে বাবা-মা, সন্তানদের কে ভালো রাখার জন্য সমস্ত রকম দাবি পূরণ করার চেষ্টা করেছে, আর সেই সন্তান বড় হয়ে বাবা-মায়ের সামান্য ওষুধ টুকু দিতে চায় না। এর জন্য কে দায়ী, আমাদের উন্নত সমাজ? নাকি আমরা নিজেরাই?
বাবা-মা নিঃস্বার্থভাবে ছেলেমেয়েদেরকে মানুষ করে। আর ওই ছেলে মেয়ে বড় হয়ে, বাবা-মাকে দেখেনা। কতটা অসহায় হয়ে পড়লে, বাবা-মা নিজেদের ভরণপোষণের দাবি নিয়ে, আদালতে দাঁড়াতে হয়, সন্তানদের বিরুদ্ধে। সেটা বোঝা, কারো পক্ষে অসম্ভব নয়। কারণ এটা ধ্রুব সত্য যে, বাবা-মা’র মত ভাল, সন্তানদের আর কেউ কোনদিনও চাইতে পারেনা।
আজ যতই মানুষ বলুক সমাজ উন্নত হয়েছে, আমরা কিন্তু সেই পিছিয়ে পড়ে আছি। আমাদের মানসিকতা, আমাদের মুল্যবোধ, সব হারিয়ে গেছে।
তা না হলে, যে বাবা-মাকে আমাদের মাথায় তুলে রাখা উচিত, সেই বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রম পাঠিয়ে দিয়ে, আমরা দায়িত্ব পালন করতে চাই না।
এইরকমই যদি কোন বাবা-মা সন্তানকে জন্ম দিয়ে, অনাথ আশ্রমের পাঠিয়ে দেয় । তখন সেই বাবা-মাকে আমরা বলি, কিরকম বাবা-মা যে, “পালন করতে পারবে না তো” জন্ম দিয়েছে কেন ? এই কথাটা তখন যদি আমরা বলে থাকি । তাহলে এখন সেই সমস্ত ছেলে মেয়েদের কি বলব ? যারা বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়, তাদের কি আমরা বলতে পারি না,-”যে সন্তান বাবা-মাকে দেখেনা, যে সন্তান বাবা-মার দায়িত্ব নেয় না, সে সন্তানের জন্মই বৃথা। মানব জন্ম মূল্যহীন, অর্থহীন।
লেখিকা ঝাড়খণ্ডের গৃহবধূ
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct