এস এম শামসুদ্দিন: বর্তমান পশ্চিম বাংলার রাজনীতিকদের গতিপ্রকৃতি সর্বোপরি দলবদলের খেলা দেখতে দেখতে মানুষ ক্লান্ত। পরিচিত রাজনীতিকদের একই মুখে বিপরীতমুখী কথা শুনতে শুনতে কটু তির্যক অশালীন মন্তব্য করে। সংবাদ দেখা ও পড়াকে এড়িয়ে চলছে সচেতন মানুষ। এমনিতেই দুর্মূল্যের সাথে লড়াই করতে করতে সাধারণ মানুষের অবস্থা বেহাল। তার উপর দাদাদের প্রত্যেকদিনের ব্রেকিং নিউজ। কে কোথায় গেল, বিতর্কমূলক আলোচনা -সমালোচনা। এর উপর গোদের উপর বিষ ফোড়ার মতো সংখ্যালঘু ভোট ব্যাংকের ভোট বিভাজনের সম্ভাবনা এবারের নির্বাচনকে এক অন্যমাত্রা এনে দিয়েছে। সংখ্যালঘু ভোট কোনদিকে যায় সেই নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। রাজনৈতিক নেতাদের দলবদল ও নতুন দল গঠন নিয়ে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের আলোচনা পর্যালোচনার শেষ নেই।
সংখ্যালঘুদের নিয়ে ভোটব্যাংক বলে একটা বহুল প্রচলিত বাক্য আজ আর কারও অজানা নেই। আজ সেই ব্যাংকের আমানত নষ্ট নাকি আমানতের সঠিক ব্যবহার করার প্রচেষ্টা চলছে? যেমন একটা শ্রেণি করছে বলে আর একটা শ্রেণির দাবি উঠছে। তেমনি ধর্মীয় এজেন্ডাকে সামনে রেখে যাঁরা রাজনীতিতে বিরুদ্ধদের কুপোকাত করতে চান তাঁরাও অতি সক্রিয়। যেহেতু এ রাজ্যের একাধিক জেলায় যেকোনও দলের প্রার্থীর জয়পরাজয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয় সংখ্যালঘু ভোটাররা, তাই এদের সমর্থন ভোটার বাজারে বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা ফ্যাক্টর। মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর সহ রাজ্যের একাধিক জেলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য ও একাধিক জেলায় নিয়ামকের ভূমিকা থাকায় এদের অন্তত ভোটের বাজারে এদের গুরুত্ব ও চাহিদা মূল্য বেড়ে যায় অনেকটাই। সংখ্যালঘু ভোটারদের বিশেষ করে মুসলমান ভোটারদের একটা প্রবণতা হল এরা যেদিকে সমর্থন করে সেদিকে শতাংশের হিসাবে অধিকাংশই সমর্থন করে। দীর্ঘ ৩৪ বছর বাম শাসনে মুসলমানরা বলা যায় একচেটিয়া সমর্থন দিয়েছিল বামফ্রন্টকে। সাচার কমিটির দেওয়া রিপোর্টে তাঁদের বঞ্চনা অবহেলার পরিসংখ্যান দেখে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ে সমর্থন করেছে মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন তৃণমূল দলকে।
রাজ্যে ২৭ শতাংশ মুসলমান ভোটারের (অনেকে মনে করেন এই সংখ্যা সঠিক নয়,প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি ) বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমর্থন বিভাজনের আশংকার ফল কি হতে পারে এই নিয়ে বাসে ট্রামে ট্রেনে লোকালয়ে চলছে বিতর্ক আলোচনা সমালোচনা বিশ্লেষণ।
আমরা যদি বিগত বছর ও আজকের অবস্থার তথ্য পরিসংখ্যান সহ পর্যালোচনা করি দেখব যে, ১৯৫২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মোট ১৬ বার নির্বাচন হয়েছে তার সবগুলোতেই মুসলমানদের সমর্থন একটা বড় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করেছে। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা সংখ্যালঘুদের নানান উপায়ে। কর্মসূচি ঘোষণা থেকে ধর্মীয় নেতাদের দরবারে হাজির হয়েছে আশীর্বাদ নিতে। কিন্তু ২০২১ নির্বাচনের অবস্থাতা পাল্টে গেছে বিপরীত মেরুতে। অর্থাৎ আগে মুসলমান ভোট অধিকাংশ একই দিকে যেত। সংখ্যাগুরু ভোট নানান দলে ভাগ হয়ে যেত। কখনো কংগ্রেস, আরএসপি, সিপিআইএম, ফরোয়ার্ড ব্লক, তৃণমূল সহ নানান ভাগে ভাগ হতো। কিন্তু মুসলমান ভোট ভাগ হতো না। ফলে এদের সমর্থন লাভে অন্তত নির্বাচনের সময় এদের গুরুত্ব বেড়েই গেছে কমেনি।
আমরা যদি ফেলে আসা ইতিহাস খুঁজি দেখব, রাজ্যে কংগ্রেস শাসনে সিদ্ধার্থ শংকর রায় বা তারও আগে বিধান রায় সে সময় এরা কংগ্রেসকে পরে বামকে এবং বর্তমানে তৃণমূলকে সমর্থন দিয়ে আসছে। কিন্তু আগামী নির্বাচনে মুসলমান ভোট ভাগের আশংকা। অন্যদিকে হিন্দু ভোট এক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে বলে অনেকেই মনে করছেন।
ধর্ম ভিত্তিক দল ও দলের সমর্থনের এই প্রবণতা স্বাধীনতার পর দেখা যায়নি। বর্তমানে কিছু কিছু ধর্মীয় প্রবক্তার সরকার বিরোধী প্রচারণায় মুসলমান ভোট ভাগ হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। মুসলমান ভোট ব্যাংকে থাবা বসাতে যাঁরা নিরন্তন তৃণমূল সরকার বিরোধী কটূক্তি সমালোচনা করে সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট তাদের যুক্তি, তাদের যথেষ্ট উন্নয়ন করা হয়নি। কথা রাখেনি সরকার, উন্নয়নের নানান প্রচার প্রসার করলেও আসলে প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি। এর ফলে অন্য সম্প্রদায়ের চোখে শত্রু করা হয়েছে অথচ বাস্তবে তেমন আহামরি উন্নয়ন হয়নি বলে এই সমস্ত প্রবক্তাগণ মনে করছেন। অন্যদিকে বিজেপির সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতি নিয়ে এই রাজ্যে আগমন এবং বাংলায় ক্ষমতা দখলের হুঙ্কার ও শাসকদলের কিছু কিছু নেতাদের দলবদল করে যাওয়া নিয়ে চলছে আলোচনা সমালোচনা।
এক কথায় আগামী বিধানসভা নির্বাচনে কে আসবে ক্ষমতায়, আর কে হারাবে ক্ষমতা আর এই ঘোলা রাজনীতির জলে কে বা কারা কিছু ক্ষমতা বা মাছ ধরে নিতে পারবে চলছে সেই প্রচেষ্টা। চলছে সেই অংকের হিসেবে নিকেশ। স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ রাজ্যবাসীদের মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, রাজ্যে সংখ্যালঘু সমর্থনের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে যাঁরা খোঁজ খবর রাখেন তাঁরা জানেন যে এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশ মানুষ যখন যেদিকে সমর্থন করেন সেদিকেই কিন্তু অধিকংশই সমর্থন করেন। অন্য সম্প্রদায়ের সমর্থন যখন নানান দলে ভাগ হয়ে যায়, সংখ্যালঘু ভোট তখন যায় একসঙ্গে একদিকেই।
আমরা বিশ্লেষণ করলে দেখব দীর্ঘ তিন দশক এরা বাম শাসনকে অর্থ শক্তি, বুকের রক্ত দিয়ে এমনকি দলকে প্রতিষ্ঠা করতে ভায়ের বিরুদ্ধে ভাই অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধা করেনি। সাচার কমিটির রিপোর্টে তাঁদের বঞ্চনা অবহেলার করুণচাল চিত্র দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল তারা।
তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে শাসক পরিবর্তনের আন্দোলনকে সমর্থন করে তারা। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের জীবন ও জীবিকার উন্নয়ন ও বিকাশের কর্মসূচি ও ভাবনার পাশে থেকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। শুধুমাত্র সংখ্যালঘু নয় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত শ্রেণীর মানুষের উন্নয়ন ও বিকাশে নানান কর্মসূচি নিয়ে মমত্ ব্যানার্জি এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু একটা শ্রেণী সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে ক্রমশ প্রচার প্রসার করে গেছে মমতা সরকার যা করছে সবই নাকি মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য করছে। ধারাবাহিক এই প্রচারে একটা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। এর বিপক্ষে শাসক দলের নেতৃত্বকে মানুষের কাছে জনহিতকর কর্মসূচি ও কর্মকাণ্ড প্রচার প্রসার না করতে পারায় মিথ্যা প্রচার সত্য রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন।
ফলে অন্য সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে শত্রু হিসাবে গণ্য হয়েছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটা শ্রেণী যাঁরা সরকার বিরোধী প্রচার প্রসার করে সংখ্যালঘু ভোট ধর্ম ভিত্তিক দলের দিকে প্ররোচিত করতে চায় তাঁরা ক্ষমতার ভাগ রাখতে চায় নিজেদের হাতেই। তারা শাসক দলের কিছু কিছু নেতাদের ব্যবহারে অসন্তুষ্টি-অসহযোগিতা থেকে জন্ম ক্ষোভ থেকে তারা সাধারণ মানুষকে বিরুদ্ধ প্রচারে বিভ্রান্ত করছেন বলে সচেতন মানুষদের ধারণা।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে দীর্ঘ বাম বঞ্চনার শূন্যতা সম্পূর্ণ পূরণ করতে পারেনি এই সরকার বলে সচেতন মানুষজন মনে করে। সম্প্রদায়ের একশো শতাংশ দাবি পূরণের দাবিও সঠিক নয় বলেও এরা বিশ্বাস করেন।
যে কোনও ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকদের বিভাজন ও ক্ষমতা দখলের এই আস্ফালন এবং উগ্রতা যে রাজনীতির বিতর্ক ছেড়ে ধর্মভিত্তিক সংঘাত ও সামাজিক বিভাজন ডেকে আনবে কিনা সাধারণ নাগরিকদের কাছে এখন সেটাই বড় প্রশ্ন। প্রশ্ন, প্রাণে বাঁচা আগে না অধিকার অর্জন করা। যারা বাস্তববাদী এবং সচেতন তারা যেকোনও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে সৃষ্টি দলমতের তীব্র বিরোধিতা করছেন। তারা মনে করছেন দাবি আদায়ে সরকারি বঞ্চনা অবহেলার বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টির। প্রতিবাদ করার তেমন কোনও ইতিহাস নেই যাদের তাঁরা রাজনৈতিক দল সৃষ্টি বা সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন দলকে সমর্থন করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ করার চেষ্টা করছে। সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরও বেশি শক্তিশালী করার এই চেষ্টা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কপালে চরম দুঃখ আসতে পারে। ক্ষমতা দখলের মরীচিকার দিকে ছুটতে গিয়ে জান ও মালের সীমাহীন ক্ষতির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। অধিকার অর্জনের সংগ্রামে শামিল হয়ে শত্রুদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিতে চাইছে যারা তারা কি সত্যি সম্প্রদায়ের প্রকৃত বন্ধু না শত্রু এমন জিজ্ঞাসাও সচেতন মানুষের আলোচনার বিষয়। নিজ ব্যক্তিস্বার্থ পূরণ ও কিছু শ্রেণীর মানুষকে বিপথে চালিত করতে যারা সচেষ্ট, তারা এক মহা সংকটকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টির সহযোগিতা করছেন বলে অনেকে মনে করছেন।
আর যাইহোক ধর্মের ভিত্তিতে বেক্তি জীবন সমাজ জীবন গড়ে উঠলেও ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের প্রতি সমর্থন ও রাষ্ট্রপরিচালনায অংশগ্রহণ এক চরম অনাসৃষ্টির সূচনা। নানা মত, নানা ভাষা, নানা পরিধান, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এই দেশের সংবিধানের পথ যা প্রত্যেকটা ভারতবাসীর স্মরণ রাখা একান্ত জরুরি আবশ্যক। আগামী নির্বাচনে তাই আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে আবার ধর্মে ধর্মে বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষ না প্রেম প্রীতি সংহতি-সম্প্রীতির সহবাস্থান কোনটা জরুরি।
এ দেশ তোমার আমার
এ দেশ আপনার আমার সবার
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
(লেখক বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক)
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct