“জননী,তোমার শুভ আহ্বান গিয়েছে নিখিল ভুবনে /নতুন ধান্যে হবে নবান্ন
তোমার ভবনে ভবনে /অবসর আর নাহিকো তোমার –আঁটি আঁটি ধান চলে ভারে ভার”
নবান্ন উৎসবের কথা এভাবেই কবির কলমে ব্যক্ত হয়েছে । “নবান্ন” শব্দের অর্থ হল “ নতুন অন্ন”। নবান্ন হল নতুন অন্নের উৎসব। ইংরেজীতে যাকে বলে “New Rice Festival” নবান্ন মানে নতুন অন্ন। গ্রাম বাংলার লোকেদের এক প্রাণের উৎসব নবান্ন। সুদূর অতীত থেকে আজ পর্যন্ত গ্রাম বাংলায় কৃষিজমির সঙ্গে প্রজাদের এক আত্মিক সম্পর্ক বর্তমান। নবান্নের সেই ঐতিহ্যকে আজও ধরে রেখেছে গ্রাম বাংলার লোকেরা। পয়লা অঘ্রাণে মূলত: নবান্ন হলেও অন্য তিথিতেও অনেকে নবান্ন উৎসব পালন করেন। নবান্নের প্রাতে: নতুন ধুতি পরে মাঠে গিয়ে নতুন ধান কাঁটা, ঢেঁকিতে সেই ধান কোটা, চালের গুঁড়োতে হয় নবান্ন উৎসব। বাড়ির বারান্দা আর উঠোনে ভরে ওঠে আলপনায় যেন খুশির উৎসবের এক স্রোত বয়ে যায়। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে বাঙালির নানা সামাজিক রীতিনীতি ও লোকবিশ্বাস জড়িয়ে আছে। নবান্নের দিনে নতুন অন্ন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যেও উৎসর্গ করা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, নতুন চালের তৈরি খাদ্যসামগ্রী প্রথমে কাককে নিবেদন করা হবে। কারণ কথিত আছে,কাকের মাধ্যমে ওই খাদ্য মৃতের আত্মার কাছে পৌঁছে যাবে। এই নৈবেদ্যকে বলে “কাকবলী”।নবান্নের সেই বিশেষ দিনে বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েরা ছড়া কেটে দাড় কাককে নিমন্ত্রণকরত:
“কো কো কো,
আমাগো বাড়ি শুভ নবান্ন।
শুভ নবান্ন খাবা, কাকবলি লবা,
পাতি কাউয়া লাঠি খায়....”
নবান্নের দিনে বাড়ির সকলে এক সাথে বসে চলে পেট পুরে মুড়ি, দই, চিঁড়ে, মুড়কি দিয়ে ভোজনপর্ব। নবান্নের দিনে অনেকেই দিনের শেষে একেবারে ভাত খান। গ্রাম বাংলায় আজও দেখা যায় বাসি নবান্নে বা নবান্নের পরের দিন অনেকের বাড়িতে দুপুরে খাসির মাংসের চল আছে। নবান্ন উৎসবও গ্রামবাংলায় এক আনন্দমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। নতুন অন্নের সঙ্গে পিঠা পায়েস, ক্ষীরসহ হরেক রকম নানা সুস্বাদু খাবারের গন্ধে ভরে ওঠে চারিপাশ। নবান্ন উৎসবের সঙ্গে যেন মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস,ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির নানা দিক। যেন জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের এক মিলনোৎসব এক নবান্ন উৎসব। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছে নবান্ন উৎসব। সময়ের সাথে সাথে গ্রাম বাংলায় ছোঁয়া লেগেছে শহরের কৃত্রিমতাও। এই উৎসবের রং ক্রমশ যেন ফিকে হয়ে এসেছে ।তবুও নবান্নের সেই চেনা ছবি আজও দেখা যায় এই গ্রাম বাংলায়। পশ্চিমবঙ্গের কিছুকিছু জায়গায় আজও নবান্ন উৎসব আজও যেন উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি করে। সেই আবহমান কাল থেকে নবান্ন উৎসব যেইভাবে পালিত হয়ে এসেছে আগামী প্রজন্মেও যেন এর ঐতিহ্য বজায় থাকে পরম্পরায়। কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় যেন আজও বলতে হয়, ‘আবার আসিব ফিরে ধান সিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে।’
লেখক প্রাবন্ধিক ও নাট্যশিল্পী
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct