সামনে ২০২১ বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে ঘিরে উন্মাদনার পারদ চড়তে শুরু করেছে এ রাজ্যে। এই সময়টা খুবই উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘূদের। স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে মুসলমানদের করুণ চিত্র চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে তাদের অবস্থা খারাপ হচ্ছে দিন দিন। বিভেদকামী শক্তি জাতপাতের রেষারেষিটা মনুষ্য সমাজে বাড়িয়ে দিয়ে দেশকে বিপদে চালিত করতে বদ্ধপরিকর হয়েছে। এই অবস্থার নিরসনে এগিয়ে আসছেন সচেতন নাগরিকদের বড় অংশ। বিভেদমূলক নীতির ফলে রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে দিনের পর দিন। ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি অশুভ শক্তি যেভাবে বিদ্বেষ প্রকাশ করছে তাতে ভারতের সংবিধান ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটছে এবং তা পবিত্র ভারত ভূমিতে চরমভাবে আঘাত প্রাপ্ত হচ্ছে। সংবিধানকে রক্ষা করতেই হবে।
ভারতের কল্যাণে মুসলমানদের অবদান অনস্বীকার্য। বৈষম্য দূর করতেই হবে। সাধারণ মানুষকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহস জুগিয়ে দেশ স্বাধীন করতে ভারতীয় আর্য-অনার্যদের সঙ্গে মুসলমানরা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে দেশ স্বাধীন করেছে।
মনে রাখতে হবে ভারতের গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতি আনুগত্য ও ভালবাসা রেখেই দেশ ভাগের পরও ভারতীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষজন তাদের বড় অংশ দেশ ছেড়ে চলে যাননি। ভারতের মাটিকে আগলে রেখেছেন বুকের মধ্যে। ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা করতে মুসলমানরা জোটবদ্ধভাবে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ রেখেছেন এবং অপূর্ব নিদর্শন আজও উপহার দিচ্ছেন দেশবাসীকে।
ভারত একদিন আবারও পৃথিবীকে আলো দেবে। বিভাজন সৃষ্টি করে ভারতীয় আত্মাকে পৃথক করা যাবে না। আমরা জানি এবং ভারতীয় হিসেবে গর্বিত হই, এটা জেনে বিশ্বে সর্বোত্তম ও অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে ভারতীয় নাগরিকদের বড় অংশ।
স্বাধীন ভারতের ৭৩ বছর পরেও মুসলমানদের মধ্যে আর্থিক ও সামাজিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ঘরের ছেলেমেয়েরা বহু সংগ্রাম করে কিছু সংখ্যক উচ্চশিক্ষা নিতে এগিয়ে আসছে। এ বিষয়ে কিছু মিশন স্কুলের অবদান উল্লেখযোগ্য। মুসলিমদের পরিচালিত ট্রাস্ট ও সোসাইটির নিজস্ব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার ফলে বহু ছাত্রছাত্রী আর্থিক অনটনে উচ্চশিক্ষা অর্জনে বহু বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। মেয়েদের ক্ষেত্রে সমস্যা আরও বেশি। রাজ্য সরকার এ বাধা দূর করার জন্য কোনও সরকারি প্রকল্প এখনও গ্রহণ করেনি। পশ্চিমবঙ্গ সংখ্যালঘু উন্নয়ন বিত্তনিগম থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি প্রকল্প অনুযায়ী উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যে ঋণ দেওয়া হয়, তার বিনিময়ে সরকারি চাকুরিরত গ্রান্টার বাধ্যতামূলক করায় বিপদ বেড়েছে। সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকুরিরত মুসলমাদের সংখ্যা খুবই নগন্য, কোথাও আবার শতকরা একজনও নেই। তাহলে সরকারি চাকুরিরত গ্রান্টার পাওয়া যাবে কোথায়? একদিকে প্রচুর ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা নিতে চাইলেও অর্থের অভাবে তা তারা নিতে পারছে না। অন্যদিকে চাকুরিরত মুসলমানের সংখ্যা জনসংখ্যার (৩০%) শতাংশের অনুপাতে খুবই কম। তাহলে এই বৈষম্য ঘুচবে কি ভাবে? মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী শ্রীমতী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দাবি, তারা মুসলমানদের উন্নয়নে প্রবলভাবে আন্তরিক। সভা সমাবেশ ও সমিতিতে এই দাবি জোর কদমে বলে চলেছেন শাসক দলের নেতা-নেত্রী ও মন্ত্রীরা। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুদের জন্য যদি প্রকৃত উন্নয়ন করতে চান তাহলে নানা ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে তিনি দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেন এবং পিছিয়েপড়াদের মন জয়ও করতে পারেন। এই পথেই একটা পিছিয়েপড়া সমাজ আলোর স্পর্শ পাবে - আমার দৃঢ় বিশ্বাস। মুক্ত চেতনা ও সর্বোপরি সম্প্রীতির সেতুবন্ধন রচিত হবে। মুসলিম ও সংখ্যালঘু সমাজ আলোর দিশারী হবে।এটা বড় প্রয়োজন এই মুহূর্তে।
মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমি ও সর্বভারতীয় নিটে চমকে দেওয়ার মতো ফল করছে মিশনের ছাত্র-ছাত্রীরা। বাংলার বিগত চৌত্রিশ বছর বাম শাসনে দেখেছি ইতিহাস ঘেঁটে সংখ্যালঘুদের চাকরি, শিক্ষা, বাসস্থান ও সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোনও চেষ্টাই করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। জ্যোতি বসু ও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের জমানায় সংখ্যালঘুদের সংকট বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল। জ্যোতি বসুর শাসনকালে মুসলিমদের জন্য চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের দাবি তুলেছিলেন জনাব হাসানুজ্জামান। তাতে জ্যোতি বসু বলেছিলেন, ‘জনাব হাসানুজ্জামান কি মুসলমানদের জন্য কারাগারেও সংরক্ষণ চাইছেন?’
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তার জমানায় বলেছিলেন, ‘মাদ্রাসা-মক্তব হল সন্ত্রাসবাদ-এর আখড়া।’ এই চরম অপমানের বদলা বাংলার মানুষ ও সংখ্যালঘু সমাজ ভোটবাক্সে দিয়েছেন।
মনে রাখতে হবে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতা সংখ্যালঘিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে বহুগুণে ধ্বংসাত্মক আর শক্তিশালী। সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাবাদী রাজনীতি মুসলমানদের অস্তিত্বকেই ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে, জহরলাল নেহেরু একথা স্পষ্ট করে লিখেছিলেন। এর সত্যতা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে। গোটা দেশে এই মুহূর্তে সংখ্যালঘু সাংসদ সংখ্যা মাত্র ২৭-এ নেমে এসেছে। ২০১৯ নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর দেখলাম বিজেপির নির্বাচিত সাংসদদের মধ্যে একজনও মুসলিম সাংসদ নেই।দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে বিশেষ করে পশ্চিমবাংলায় সংখ্যালঘু প্রার্থীদের মধ্যে যারা লোকসভা ভোটে বা বিধানসভা ভোটে জিতেছেন, ভাল কাজ করলেও তাদের অনেককেই প্রার্থী করা হয় না বা আসন বদল করা হয়। ভুরি ভুরি উদাহরণ আছে। কখনও-বা ঠেলে দেওয়া হয় হেরে যাওয়া আসনগুলিতে। মুসলিম প্রার্থীদেরকে একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়াও হয় সুচতুরভাবে।
সাধারণ মানুষ কিন্তু রাজনীতির এসব প্যাঁচপয়জার বোঝে না। তারা চায় প্রত্যেক এলাকায় আধুনিক মানের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠুক। এটা সত্য, যে মুর্শিদাবাদ একদা দেশের রাজধানী ছিল, সেই মুর্শিদাবাদে স্বাধীনতার ৭০ বছর পরও একটা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হয়নি রাজ্য সরকারের বদান্যতায়। তাই মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলার দাবি দীর্ঘদিন ধরে জানিয়ে আসছিলেন জেলার মানুষ। সেই দাবি আজও পূরণ না হলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় খানিকটা হলেও সে দিকে অগ্রসর হতে পেরেছেন। বিল পাশ করেছেন মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু আজও পঠন-পাঠন চালু হয়নি বা অর্থ বরাদ্দও করা হয়নি। এখনও উপাচার্য নিয়োগও হয়নি। তবে কৃষ্ণনাথ কলেজ নিয়ে শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিল নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। এর মধ্যেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলের মহাসচিব ও উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী ড. পার্থ চট্টোপাধ্যায় শিক্ষা প্রসারে মহৎ উদ্যোগ নিয়েছেন। অনেকগুলি নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ও বেশ কয়েকটি নতুন কলেজ খুলেছেন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে। তবুও বহু জেলাতেই আরও অনেক সাধারণ স্কুল-কলেজ সহ মহিলা ডিগ্রি কলেজ গড়ার প্রয়োজন প্রকটভাবে দেখা দিয়েছে।
২০১৬ সালে বিধানসভা ভোটে সংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেতে সিপিএম-কংগ্রেস-বিজেপি মরিয়া চেষ্টা চালিয়েছিল।
কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। এখন দেখার ২০২১ সালের নির্বাচনে কোন দল কীভাবে বাজিমাত করে।ংখ্যালঘুদের বিপুল সমর্থন পেতে চাইবেন সব দলই। এখন থেকেই এই সংখ্যালঘুদের মন জয়ে সকল রাজনৈতিক দল নানা কৌশলে বাজিমাত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন।
বাম-কংগ্রেস ও বিজেপি, তৃণমূল কংগ্রেস-এর দিকে থাকা মুসলিম ভোটে থাবা বসাতে চাইছেন। তবে সচেতন সংখ্যালঘু সমাজ সমস্ত অতীত অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে যথাযথ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন বলেই মনে হয়।
বিগত ৩৪ বছর বাংলার মানুষ দেখেছেন সংখ্যালঘুদের সামাজিক সংকটকে গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের কোন চেষ্টাই করেনি তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের ২৩টা জেলায় বামফ্রন্টের পার্টি সম্পাদক আছেন, কিন্তু কোনও মুসলিমকে আজও সম্পাদক পদে বসাতে পারেননি বাম কর্তারা।
তৃণমূল কংগ্রেসও সম্প্রতি যে জেলা কমিটি ঘোষণা করেছে, তাতে অনেকটাই বামেদের পথেই অগ্রসর হওয়ার ইঙ্গিত মিলেছে। সেখানে সংখ্যালঘুদের হারের বিন্যাস অনুযায়ী উচ্চ পদ পাওয়ার দৃষষ্টান্তও অধরা থেকে গেছে। এর কারণ, যোগ্য মুসলিম নেতৃত্ব না পাওয়াও অন্যতম হতে পারে তাতে সন্দেহ নেই। যদি এটা বলতে দ্বিধা নেই, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার বিগত বছরগুলোতে কয়েকজনকে জেলা পরিষদের সভাধিপতির আসনেও বসিয়েছেন। এমনকি কলকাতা মহানগরীর মেয়র পদে অধিষ্ঠিত মুসলিম বলে ব্রাত্য হয়ে যাননি ফিরহাদ হাকিম। তা সত্ত্বেও দলীয় কোন্দলের জেরে সংঘর্ষে মুসলিমদেরই প্রাণ যাচ্ছে বেশি। নির্বাচন এলে তো কথাই নেই।
বলতে দ্বিধা নেই, প্রায় সব রাজনৈতিক দলই ভোটের সময় মুসলিমদের এবং দলিতদের এগিয়ে দেয় সুচতুরভাবে। ভোট লুঠের খেলায় মাতিয়ে দেওয়ার মরে মুসলিমরা। আর তাদের হাতে যাদের মৃত্যু হয় তারই কিন্তু মুসলিম। মুসলিমদের সমতুল ঝটনা প্রায় ঘটে থাকে রাজ্যের দলিত, আদিবাসী সমাজেও। তবুও সংখ্যালঘুদের শিক্ষা হয় না। ‘গণতান্ত্রিক সাম্যতাহীন’ নির্লজ্জ স্বার্থসিদ্ধি আর নানাবিধ ধান্ধাবাজির সওয়ালে দাবার বোড়ে হিসেবে অর্থাৎ ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে মুসলমানদের ব্যবহার করা হয়েছে। তাদের দায়, ভোট দেওয়ার। রাজ্যের ৩০ শতাংশ মানুষের ভোট কে ক্ষমতায় আসবে তো নিরূপণের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা নিলেও উন্নয়নের ক্ষেত্রে দেখা যায় সেই সংখ্যালঘু এলকাগুলিরই বেহাল দশা চোখে পড়ে। গণতন্ত্র ও সংবিধান আজ বহু রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান বাঁচাতে দেশের সাধারণ নাগরিকদের আরও সচেতন হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে। সেই সতর্কতা অবলম্বন কি রাজ্যের সংখ্যালঘুরা নিতে পারবে? সামনে বিধানসভা নির্বাচন। এই নির্বাচনে কি ভোটের ময়দানে মুসলিমদেরকে শুধু বুথের সামনে লড়াই করতে দেখা যাবে, যার পরিণাম হবে মৃত্যু। যদিও একথা সত্যি, বাম আমল থেকে দেখা যাচ্ছে নির্বাচনের দিনে ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে বিশঙ্খলার মাঝে প্রথমেই যে প্রাণটি যায় তা মুসলিমেরই। সেই ঘটনার কি ব্যতিক্রম ঘটবে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে? মুসলিমদের কি এখনও উপলব্ধি হবে না, এভাবে রাজনৈতিক হানাহানি করাটা আসলে সংখ্যালঘু সমাজেরই সর্বনাশ। তাই, একুশের বিধানসভা নির্বাচন হোক রক্তপাতহীন নির্বাচন, যেখানে সংখ্যালঘুদের রক্তে রাঙা হবে না বুথ প্রাঙ্গণ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct