খ্রিস্টীয় নবম শতকের তিন এতিম বালক। তাঁরা ছিলেন গণিতের আরব ধারার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের মাধ্যমে জ্যামিতি ও যন্ত্রবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছিল, বিশেষত জ্যামিতিতে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁদের রচিত ‘কিতাবু কিয়াসিল আশকালিল মুসাত্তাহা ওয়াল কারভিয়্যা’ এখনো গণিত শাস্ত্রের একটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আলোকপাত করেছেন আতাউর রহমান খসরু।
খ্রিস্টীয় নবম শতকের তিন এতিম বালক। তাঁরা ছিলেন গণিতের আরব ধারার প্রতিষ্ঠাতা। তাঁদের মাধ্যমে জ্যামিতি ও যন্ত্রবিজ্ঞানের অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছিল, বিশেষত জ্যামিতিতে তাঁদের অবদান চিরস্মরণীয়। তাঁদের রচিত ‘কিতাবু কিয়াসিল আশকালিল মুসাত্তাহা ওয়াল কারভিয়্যা’ এখনো গণিত শাস্ত্রের একটি মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।বইটির সূত্রগুলো ও তার বিশদ ব্যাখ্যা জ্যামিতি ও গাণিতিক জ্ঞানের শক্ত ভিত প্রদান করে।ইতিহাসের পাতায় মুসা বিন শাকিরের তিন ছেলেই বানু মুসা নামে খ্যাত। তাঁরা হলেন আবু জাফর মুহাম্মদ বিন মুসা, আবুল কাসিম আহমদ বিন মুসা ও আল হাসান বিন মুসা।মুসা বিন শাকির ছিলেন পারস্যের খোরাসান অঞ্চলের অধিবাসী।কিন্তু তিনি বাগদাদেই বসবাস করতেন। তিনি ছিলেন আব্বাসীয় খলিফা আল-মামুনের কর্মী। ছেলেদের অপরিণত বয়সে রেখেই তিনি মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর খলিফা মামুন এতিম তিন বালকের দায়িত্ব নেন।তাঁর তত্ত্বাবধানেই তাঁরা লেখাপড়া করেন। পরবর্তী সময়ে তিন ভাই বায়তুল হিকমার গবেষক হিসেবে নিয়োগ পান। বিজ্ঞান বিষয়ে তাঁদের ২০টিরও বেশি গ্রন্থ রয়েছে। তাঁদের বইগুলো প্রধানত জ্যামিতি, সাধারণ গণিত, দূরত্ব পরিমাপ পদ্ধতি, প্রকৃতিবিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে রচিত।তাঁদের একক ও যৌথ উভয় ধরনের রচনা রয়েছে।
জ্যামিতি ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে তাঁদের মৌলিক অবদান রয়েছে, বিশেষত তাঁরা তাত্ত্বিক জ্ঞানের প্রায়োগিক চর্চায় অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছিলেন। বানু মুসার তিন ভাই যদিও গ্রিক গণিতবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন, তবু তাঁরা মৌলিক সূত্র, পদ্ধতি ও নকশা তৈরিতে মুনশিয়ানা দেখিয়েছিলেন। স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র উদ্ভাবনে তাঁদের পথিকৃৎ মনে করা হয়। স্বয়ংক্রিয় বাঁশিবাদক ছিল তাঁদের প্রথম সফল উদ্ভাবন।তাঁদের সবচেয়ে বিখ্যাত গ্রন্থ ‘কিতাবুল হিয়াল আন-নাফিসা’-এ তাঁদের ১০০ উদ্ভাবনের বিবরণ তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য তাঁদের উদ্ভাবনের সংখ্যা আরো অনেক বেশি। তাঁদের এই বইয়ে স্বয়ংক্রিয় ট্রিক ভ্যাসেল থেকে শুরু করে অন্যান্য ১৫টি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের বিবরণ আছে। এ ছাড়া সাতটি ওয়াটারজেট, তিনটি তেলের বাতি ও একটি উত্তোলন যন্ত্রের বর্ণনা আছে। এই বইয়ের একটি প্রাচীন অনুলিপি ইস্তাম্বুলে তোপকাপি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বানু মুসার একটি মৌলিক উদ্ভাবন হলো ‘ফিডব্যাক কন্ট্রোলার’ ও হাইড্রো-পাওয়ারচালিত স্বয়ংক্রিয় অর্গান। তাঁদের আরেকটি মৌলিক অবদান হলো আয়তক্ষেত্র ও ক্ষেত্রফলকে সংখ্যার সূচকে প্রকাশ করা। গ্রিক গণিতবিদরা যা পরিমাণ ও অনুপাতের মাধ্যমে প্রকাশ করতেন। ‘ফ্লুইড প্রেসার ভাইব্রেশন অ্যান্ড ভালভস’বিষয়ক তাঁদের উদ্ভাবন আধুনিক যুগের গবেষকদেরও বিস্মিত করে।বানু মুসা প্রায় নির্ভুলভাবে পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন এবং নক্ষত্রের গতিপথ ও দুই নক্ষত্রের দূরত্ব পরিমাপের পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছিলেন। তাঁরা নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর পরিধি পরিমাপ করেছিলেন ২৪ হাজার মাইল। আধুনিক বিজ্ঞান যাকে ২৪ হাজার ৯০২ মাইল বলে। তাঁদের উদ্ভাবিত পৃথিবীর পরিধি পরিমাপের পদ্ধতিকে জিয়োডেসিক মেজারমেন্ট বলা হয়। যন্ত্রবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যামিতিতে বানু মুসার উদ্ভাবন ও অবদান পরবর্তীদের জন্য গবেষণার পথগুলোকে প্রশস্ত করেছিল।সমসাময়িক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত সত্যান্বেষী গবেষক ও ইতিহাসবিদরা বানু মুসার অবদানগুলো স্বীকার করে থাকেন এবং তাঁদের উপযুক্ত মূল্যায়নও করেন। ফলে ইতিহাস সাক্ষী দেয় যে বানু মুসার নামে বাগদাদে একটি মানমন্দির নির্মিত হয়েছিল। যেখান থেকে তাঁরা ‘আরসা মেজর’ নামের একটি ভালুক আকৃতির নক্ষত্রপুঞ্জ আবিষ্কার করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে ৩৬তম বিজ্ঞান সপ্তাহ উদযাপন উপলক্ষে সিরিয়া সরকার বানু মুসার নামে ডাকটিকিট চালু করে।বিজ্ঞানের পাশাপাশি বানু মুসা আব্বাসীয় খলিফাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে সহায়তা করতেন। যেমন তাঁরা খলিফা মুতাওয়াক্কিলকে ‘আল-জাফরিয়া’ শহর নির্মাণে সহায়তা করেছিলেন। তাঁরা শহরের পরিকল্পনা ও নকশা তৈরিতে সাহায্য করেন। খলিফা মুতাওয়াক্কিল তাঁদের জাফরিয়া নামের খাল খননেরও দায়িত্ব দিয়েছিলেন।জীবনের শেষ ভাগে বানু মুসা রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যান। এমনকি সিংহাসনের উত্তরাধিকারীদের ক্ষমতা লাভ ও ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণেই সম্ভবত তাঁরা জীবনের শেষ ভাগে অন্তরালে চলে যান। তাঁদের শেষ পরিণতি সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। তাঁদের বড় ভাই মুহাম্মদ জানুয়ারি ৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct