মুর্শিদাবাদ জেলাঞ্চলে বিভিন্ন ধর্মানুসারী জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সদ্ভাব আর মিলে মিশে থাকার ঐতিহ্য বহমান ছিল। আজও তা বহুলাংশে বহাল রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে নানা শ্রেণির ধর্মান্ধ ব্যক্তিরা এই মানবীয় পরিবেশকে ধ্বংস করতে উদ্যত হলেও তা কখনও বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি। প্রাচীনকালে শৈব ও বৌদ্ধ জন গোষ্ঠীর অবস্থানও ছিল সাধারণত স্বাভাবিক। সেই শহরের সমসাময়িক প্রেক্ষাপট নিয়ে লিখেছেন ইতিহাস বেত্তা খাজিম আহমেদ।
বিশ শতকে ইংরেজদের ভেদনীতির ফলে হিন্দু আর মুসলমানের মধ্যে তিক্ততার সৃষ্টি হল। ১৯০৫ সালে ইংরেজরা দেশ শাসনে সুবিধার অজুহাতে অখণ্ড বাংলাকে দুভাগে ভাগ করে ফেলে। পূর্ববঙ্গকে আসামের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মুসলিম প্রধান প্রদেশে পরিণত হয়। পশ্চিমবঙ্গ হয় হিন্দু প্রধান প্রদেশ। এই বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল এক্যবদ্ধ জাতীয় আন্দোলনকে দুর্বল করা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিকাশ সাধন। ফলতঃ জেলার হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। শহর বহরমপুরে উত্তেজনাময় ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলনের নেতৃত্ক দিয়েছিলেন আব্দুল আহমেদ ইউসুফ জিলানি। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদাবাদ জেলায় মুসলিম লীগের জেলা কমিটি তৈরি হলেও ১৯৩২-এ পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী ঘোষণার আগে তক রাজনীতি প্রভাবিত সাম্প্রদায়িকতা এই জেলায় ক্রিয়াশীল ছিল না। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য ১৯৩০-এর দশকে আর. এস. এস. প্রতিষ্ঠাতা গুরু গোলওয়ালকার বহরমপুর সন্নিহিত সারগাছি রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে বেশ কয়েক বছর কাটিয়ে যান ছাত্র হিসেবে। এই সময়ে মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে সাম্প্রদায়িক সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছিলেন । প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সারগাছি অনাথাশ্রমের জন্য ভূসম্পত্তি দিয়ে সহায়তা করেছিলেন ভাবতার হাজি মহরম আলী ও মিঞা আব্দুল আজিজ নামক দুই জমিদার। সাকুল্যে ৫০ বিঘে জমি ও ২০০ টাকা দিয়েছিলেন। এখানে আগ্রহ উদ্দীপক একটি বিষয় নিয়ে কিঞ্চিৎ আলোচনা করা গেল। বিদ্রোহী কবি কাজি নজরুল ইসলাম ১৯২৩ এর ডিসেম্বরে বহরমপুর জেল থেকে মুক্ত হন। অতঃপর উভয় বাংলার বিভিন্ন স্থানেই তিনি যেতেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদে প্রায়শই তিনি আসতেন এবং বহরমপুরের বিশিষ্ট কয়েকটি হিন্দু পরিবারে সম্মানিত আপনজন হিসেবে দিনের পর দিন থেকেছেন এবং সেই সুবাদে জেলার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতৃবর্গের সঙ্গে তাঁর সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে, বন্ধুত্ব হয়েছে- তার প্রভাব পড়েছে বহরমপুরের জনজীবনে। জেলা কংগ্রেসের ডাকে তিনি বহরমপুরের জনসভায় বক্তৃতা করেছেন সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ ও জাতপাতের বিরুদ্ধে । তাঁর উদাত্ত দেশপ্রেমের গান বহরমপুরের যুব সমাজকে উদ্বেলিত করেছে। তাঁর অসাধারণ বর্ণময় জীবন ও ব্যবহার জেলাবাসীর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে মুর্শিদাবাদ জেলার রাজনৈতিক নেতৃত্ব ক্রমশ রাজা ও মহারাজা ও ভূস্বামীদের হাত থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হাতে চলে আসতে থাকে। বিশিষ্ট আইনজীবী ব্রজভূষণ গুপ্ত অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা হিসেবে উত্থিত হন। তিনি ’মুর্শিদাবাদ অ্যাসোসিয়েশন’ এর সম্পাদক ছিলেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে কংগ্রেসের জিলা কমিটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সময়ে তিনিই ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি । ১৯২১-এর কোন এক সময়ে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ বহরমপুরে এসেছিলেন । তাঁর অনুরোধে ব্রজভূষণ গুপ্ত অসহযোগ আন্দোলনের নেতৃপদ গ্রহণ করেন । চিত্তরঞ্জনের স্নেহভাজন ছিলেন ব্রজভূষণ গুপ্ত। এই সময়ের, মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকে উদ্ভূত নেতৃবর্গের মধ্যে শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, মৌলভী আব্দুস সামাদ, বিজয় কুমার ঘোষাল, শশাংক শেখর সান্যাল, রেজাউল করীম, দুর্গা শংকর শুকুল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা ছিলেন স্বদেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী। জেলার সাম্প্রদায়িক সংহতি ও সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে এঁদের ভূমিকা শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার্য। খেলাফত আন্দোলনের সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলার হিন্দু মুসলমানরা মিলিতভাবে প্রথম শোভাযাত্রা করে। এই আন্দোলনের সর্বভারতীয় নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলির রাজনৈতিক স্লোগান ছিল ‘Free Islam in free India’ (মুক্ত ভারতে মুক্ত ইসলাম)। তিনি দেশভাগ চাননি । তাঁর নামে মুর্শিদাবাদে হিন্দু মুসলমান আওয়াজ তুলেছিল ‘খোদা কা প্যার মোহাম্মদ আলী, সাক্ষাৎ ধরম মহাত্মা গান্ধী’। ১৯২৫ এবং ১৯২৭-এ যথাক্রমে মহাত্মা গান্ধী আর সরোজিনী নাইডুর আগমন জেলাবাসীকে অসাম্প্রদায়িক চিন্তাভাবনায় অনুপ্রাণিত করে। জে. এম. সেনগুপ্ত এবং সুভাষ চন্দ্র বোসের মতো উদার অসাম্প্রদায়িক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষের এই জেলায় বারবার আগমন অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে জোরদার করেছে।৮
বিশ শতকের প্রথমার্ধে ব্যাপক কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা মুর্শিদাবাদের জনজীবনকে দীর্ণ করেনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রায় অটুট ছিল। ১৯২৪-২৫, ১৯৪২-৪৩ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু প্রতিমা বিসর্জনকে কেন্দ্র করে জঙ্গীপুর মহকুমার সুতী ও রঘুনাথগঞ্জে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। ৩০ ও ৪০ দশকে বেলডাঙ্গা ও হরিহরপাড়ায়, ‘বকর-ঈদ’কে কেন্দ্র করে বিচ্ছিন্ন হাঙ্গামার খবর পাওয়া যায় সরকারি ও বেসরকারি রিপোর্টে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে কালিয়াগঞ্জে মহরমের শোভাযাত্রাকে কেন্দ্র করে দাঙ্গার উপক্রম হয়েছিল। ১৯৩৭-১৯৪৭ এও মুর্শিদাবাদ দাঙ্গা মুক্ত ছিল। বিশিষ্ট আইনজীবী তথা ১৯৩০-তক মুর্শিদাবাদ জেলায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক নেতা ব্রজভূষণ গুপ্ত (১৮৬৯-১৯৩৪) তাঁর স্মৃতিকথায় লিখছেন, ‘জঙ্গীপুরের মুসলমান উপাসনা স্থানের সম্মুখ দিয়া হিন্দু দেব-দেবীর বিসর্জন শোভাযাত্রা (বাদ্যসহ) গমনা গমনে বাধা প্রদত্ত হওয়ায় তুমুল বিরোধ এবং বহু সংখ্যক ফৌজদারী মোকদ্দমা হয়। তন্মধ্যে কোনো কোনোটি হাইকোর্ট পর্যন্ত যায়। ঐ বিরোধ এরূপ তুমুল আকার ধারণ করে যে শান্তি স্থাপনের জন্য জঙ্গীপুর মহকুমা অফিসে জেলার ম্যাজিস্ট্রেট Free W.B. Addie সাহেবের সভাপতিত্বে একটি Conference হয় এবং জঙ্গীপুর মহকুমার বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ সমবেত হোন। সেই Conference-এ আমিও নিমন্ত্রিত ও উপস্থিত হইয়াছিলাম। জঙ্গীপুর মহকুমায় উক্তরূপ সাম্প্রদায়িক বিরোধ উপস্থিত হইলেই তাহার মীমাংসার জন্য তিনজন হিন্দু এবং তিনজন মুসলমান লইয়া একটি Standing Arbitration Board (স্থায়ী সালিশী কমিটি) উক্ত Conference-এ গঠিত হয়। এবং কোনও বিরোধ বিষয়ে হিন্দু ও মুসলমান সালিশীগণের মত সমান সমান সংখ্যায় বিভক্ত হইলে আমি তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করার জন্য Umpire অর্থাৎ চূড়ান্ত সালিশ নির্বাচিত হই। মুসলমান মহাশয়গণের প্রস্তাব অনুসারেই আমি সব বাদি সম্মতক্রমে Umpire নির্বাচিত হইয়াছিলাম। Umpire রূপে আমি যে মীমাংসা করিব তাহাই Final বা চূড়ান্ত হইবে। Conference-এ এইরূপ নির্ধারিত হইয়াছিল। আমার প্রতি আমার দেশবাসীগণের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের ইহা একটি গৌরবময় দৃষ্টান্ত মনে করি এই ঘটনা বোধহয় ১৯২৪ কি ১৯২৫ সালে হইয়াছিল।’৯ অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে সালারের জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা মাকসুদাল হোসেনের ডাকে রেজাউল করীম ‘ন্যাশনাল স্কুলে’ যোগ দিয়েছিলেন। ঈশ্বরকুন্ডু, রমনীমোহন দাস এবং কিছুদিন পর সরোজ রায়চৌধুরী উক্ত স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। গ্রামীণ লোকদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ছিল তাঁদের অন্যতম উদ্দেশ্য। ন্যাশনাল স্কুল বন্ধ হয়ে গেলে রেজাউল করীম বহরমপুরের রাজনৈতিক স্কুল ‘কর্ম কুটিরে’ যোগ দেন। ‘কর্ম কুটির’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ব্রজভূষণ গুপ্ত। ১৯২৪-২৬ এ রেজাউল করীম সম্পাদনা করেন ‘সৌরভ’ নামক একটি পত্রিকা। গান্ধীবাদ এবং কংগ্রেসের জাতীয়তাবাদী আদর্শ প্রচারই ছিল পত্রিকাটির উদ্দেশ্য। আর্থিক সংকটে ‘সৌরভ’ বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর বাদে সম্পাদক এবং প্রকাশক হিসেবে রেজাউল করীম প্রকাশ করেন ‘দূরবীণ’ নামক একটি কাগজ। এটি ছিল জেলা কংগ্রেস কমিটির মুখপত্র। অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিস্তারের ক্ষেত্রে ‘সৌরভ’ এবং ‘দূরবীণ’-এর ভূমিকা ছিল প্রশংসার যোগ্য। মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ কৃষক ছিলেন গরীব মুসলমান এবং নিম্নবর্ণের হিন্দু। সঠিক সময়ে সাধ্যাতীত খাজনা শোধ করার সমস্যাটি এই গরীব কৃষকদের পক্ষে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। এই সমন্ত গরীব কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে যে আন্দোলন হয়েছিল তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সনৎ রাহা, শচীন বাগচী, যশোদা ভট্টাচার্য, জীতেন রায়, অবনী দত্ত এবং মধুসূদন ঘোষ। যদিও সীমিত অঞ্চলে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই আন্দোলন ছিল অসাম্প্রদায়িক এবং হিন্দু-মুসলিম কৃষকদের স্বার্থের অনুকূল। আব্দুস সামাদ, শশাঙ্কশেখর সান্যাল, নলিনাক্ষ সান্যাল কৃষকদের স্বার্থ সংরক্ষণের পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন বাংলার ব্যবস্থাপক সভায়। ভেবে বিস্মিত হতে হয় মুর্শিদাবাদ জেলার অন্যান্য কংগ্রেস, হিন্দু মহাসভা এবং মুসলিম লীগের সদস্যরা কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার বিলের পক্ষে ভোট দেয় নি। ১৯২৯ এর নির্বাচনে (Legislative Council of Bengal) মৌলভী আব্দুস সামাদ, ফরহাদ মুরতাজা রেজা চৌধুরী এবং ১৯৩৭ এর সাধারণ নির্বাচনে শশাংক শেখর সান্যাল, নলিনাক্ষ সান্যাল এবং মৌলভী আব্দুল বারীর জয় মুর্শিদাবাদ জেলায় উগ্র সাম্প্রদায়িকতাবাদের উত্থানকে রুখে দেয়। মৌলভী আব্দুল বারী এবং ফরহাদ মুরতাজা রেজা চৌধুরী মুসলিম লীগের প্রতিনিধিত্ব করলেও এঁরা ছিলেন সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে অসাম্প্রদায়িক। ১৯৪১-এ আব্দুল বারীর মৃত্যু হলে উপনির্বাচনে জয়লাভ করলেন সৈয়দ বদরুদ্দোজা। যুব নেতা হিসেবে মুর্শিদাবাদের মুসলিম রাজনীতিতে সৈয়দ বদরুদ্দোজার উত্থান অসাধারণ গুরুত্ববাহী ঘটনা। তিনি ‘শেরে বঙ্গাল’ এ. কে. ফজলুল হকের প্রিয়পাত্র ছিলেন। যদিও তিনি নির্দল প্রার্থী হিসেবেই জয়ী হয়েছিলেন। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে এবং পরবর্তীকালে সৈয়দ বদরুদ্দোজা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করেছেন অসাধারণ জনপ্রিয়তার সঙ্গে। মুর্শিদাবাদ (দক্ষিণ) মুসলিম নির্বাচন ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন প্রিন্স কাজেম আলি মীর্জা। তিনি তাঁর পিতা নবাব বাহাদুর ওয়াশিফ আলি মির্জার মতো অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন না। পিতা পুত্রের এমন বৈপরীত্য বিস্ময়কর। ১৯৪৬ এর সাধারণ নির্বাচনে (Bengal Legislative Assembly) কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের প্রভাবের ভারসাম্য প্রায় বজায় থাকে। দেশ বিভাগের প্রাক মুহূর্তে ১৯৪৬ এর নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক প্রচার ভীষণ তীব্র হয়ে উঠেছিল। এতদসত্ত্বেও নির্দল প্রার্থী হিসেবে মোহাঃ খোদা বখশ মুসলিম লীগের প্রার্থী মৌলভী আব্দুল গনিকে ‘বহরমপুর রুরাল মোহামেডান কন্সটিটিউয়েন্সি’তে পরাজিত করেন। স্বর্তব্য জনাব গনি ছিলেন মুসলিম লীগের ক্ষমতাধর নেতা। মোহাম্মদ খুদা বখশের মতো উদার হৃদয় এবং ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তির জয় এমন দুর্যোগপূর্ণ সময়ে খুবই জরুরি ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই কেন্দ্রে সৈয়দ বদরুদ্দোজা ন্যাশনালিস্ট মুসলিম দলের প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। বেলডাঙ্গা তনয় মোহাঃ খুদা বখশ স্বাধীনতা পরবর্তীকালের মুর্শিদাবাদের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৪৬-এর এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে কংগ্রেসের শ্যামাপদ ভট্টাচার্য, কুবের চাঁদ হালদার, সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তী বিজয়ী হয়েছিলেন। এঁরা প্রত্যেকেই হিন্দু মহাসভার প্রার্থীদের পরাজিত করেন। খুব সম্ভব এই রাজনৈতিক ভারসাম্যই মুর্শিদাবাদ জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতে দেয়নি।
১৯২৩ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বিস্তর স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা মুর্শিদাবাদ জেলায় প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির ধারাটিকে সযত্নে টিকিয়ে রেখেছিলেন। তার ফলে জেলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হতে পারেনি। এঁদের মধ্যে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা হলেন কালিদাস বসু, ত্রিদিব চৌধুরী, তারাপদ গুপ্ত, শশাংক শেখর সান্যাল, ছত্রপতি রায়, অবিনাশ ভট্টাচার্য, সনৎ রাহা, নীরোদ সরকার, মিহির মুখার্জী, অনন্ত ভট্টাচার্য, শৈলেন অধিকারী, জগদানন্দ বাজপেয়ী, রেজাউল করীম, প্রফুল্ল গুপ্ত এবং নিরঞ্জন সেনগুপ্ত প্রমুখ। নিরঞ্জন সেনগুপ্ত কৃষ্ণনাথ কলেজ ‘স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’-এর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক (১৯২৫) ছিলেন। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজকে কেন্দ্র করে বহু বিপ্লবী বিপ্লবের সামনের সারিতে উপস্থিত হয়েছিলেন। যেমন সূর্য সেন (মাস্টারদা), নলিনী বাগচী, যোগেন্দ্রনাথ দে সরকার এবং নলিনাক্ষ সান্যাল, ত্রৈলক্য চক্রবর্তী, প্রতুল গাঙ্গুলী, প্রভাস লাহিড়ী, শচীন সান্যাল এবং নিরঞ্জন সেনগুপ্তের গভীর প্রভাব বহরমপুরের তরুণ ও যুব মনে পড়েছিল। কৃষ্ণনাথ কলেজ বাংলার বিপ্লবী আন্দোলনের কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়। ভূপেশ চন্দ্র নাগ, অনাদি সান্যাল, অমূল্য গাঙ্গুলী, নরেন সরকার একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে বিপ্লববাদে আসক্ত হন। এই কলেজের শিক্ষকদের মধ্যে থেকে মোহিনীমোহন রায়, যোগেশচন্দ্র নাগ, ভূপেনচন্দ্র নাগ এবং প্রভাসচন্দ্র দে ছাত্রদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। বহরমপুর শুধুমাত্র শিক্ষাকেন্দ্র ছিল না। বিপ্লবীদের নানান কার্যকলাপে অনুপ্রেরণার উৎসস্থল ছিল এই শহর। ‘স্মৃতির দিনগুলি’ নামক একটি রচনায় নিরঞ্জন সেনগুপ্ত এই রকমের মতই প্রকাশ করেছেন। ১৯৩৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার বিশিষ্ট বিপ্লবী বহরমপুরবাসী তারাপদ গুপ্ত কমিউনিস্ট লীগ-এর শাখা স্থাপন করেন। সবিতা শেখর রায়চৌধুরী ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। শৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এই দলটির প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে ‘কমিউনিস্ট লীগ’ আর. সি. পি. আই. নামে পরিচিত হয়। ১৯৩৮ সালে অনন্ত ভট্টাচার্য মুর্শিদাবাদ জেলায় ‘কম্পিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার’ পতাকা তোলেন। ১৯৪০ সালে ত্রিদিব চৌধুরী আর. এস. পি. দলের নেতৃপদ গ্রহণ করেন। এই তিনটি মার্কসিস্ট দলের মুর্শিদাবাদ জেলাভিত্তিক রাজনৈতিক কার্যকলাপ বহরমপুর থেকেই পরিচালিত হত। পান্নালাল দাশগুপ্তের সহযোগী হিসেবে প্রুফুল্ল গুপ্ত আর. সি. পি. আই. দলে যোগ দিয়েছিলেন। তাঁর বৈপ্লবিক আন্দোলনের জন্য তাঁকে ৮ বছর কারাবাস করতে হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে তিনি ছিলেন অকৃতদার, উদার অসাম্প্রদায়িক স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ। বিশিষ্ট লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষ জীবনচর্যার প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন আজীবন। প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয় মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৯৩৫ সালের পর থেকে। বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজকে কেন্দ্র করেই এই আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে বামপন্থী মনোভাবাপন্ন ছাত্র গোষ্ঠী, তরুণ নেতা বিজয় কুমার গুপ্তকে তাঁদের প্রতিনিধি হিসেবে ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের পদে নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনীত করেন ৷ তিনি কমিউনিস্ট লীগের পক্ষ থেকে তাঁর ছাত্র রাজনীতির জীবন শুরু করেছিলেন। সর্বোপরি তাঁর এই প্রার্থীপদকে সমর্থন করেছিল ‘বেঙ্গল প্রোভিন্সিয়াল স্টুডেন্টস ফেডারেশন’ । বিজয় কুমার গুপ্ত তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী তপেন্দ্র মোহন সেনকে পরাজিত করেন। মনে রাখা দরকার তপেন্দ্র মোহন ছিলেন স্থানীয় অভিজাত গোষ্ঠী আর কলেজ কর্তৃপক্ষের মনোনীত প্রার্থী । তরুণ ছাত্রনেতা বিজয় গুপ্তর এই জয়কে ‘অ্যারিস্টোক্রাসী’র বিরুদ্ধে ‘ডেমোক্রাসি’র জয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয় ৷ অতঃপর দীর্ঘকাল অর্থাৎ ১৯৯০ সালে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত জেলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন তিনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৫৩ সালে কংগ্রেস পরিত্যাগ করে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ায় যোগ দিয়েছিলেন শ্রী গুপ্ত । ১৯৩৮ সালে বহরমপুরে স্টুডেন্টস ফেডারেশনের প্রথম জেলা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় । এই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন ভারতবর্ষের অনন্যসাধারণ সমাজবাদী নেতা অধ্যাপক এন. জি. রঙ্গ। এই সম্মেলনে ৭টি দাবি উত্থাপন করা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি দাবি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সেটা হচ্ছে ‘Abolition of any organisation fostering communal and sectarian spirit’। ১৯৪৭ সালে বহরমপুরে ‘অল বেঙ্গল স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন’-এর দশম বার্ষিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন অবিভক্ত ভারতবর্ষের দুই বিশাল ব্যক্তিত্ব শওকত ওসমানী এবং ড. রামমনোহর লোহিয়া। পচাগলা সমাজ আর্থ ব্যবস্থাকে ভেঙ্গে ফেলার আবেদন জানানো হয়েছিল ছাত্রদের প্রতি। সাম্রাজ্যবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছিল। ছাত্র আন্দোলনের এমনতরো ধর্মানিরপেক্ষ-অসাম্প্রদায়িক প্রকৃতি জেলাবাসীর মনে তথা বহরমপুরের যুব সমাজের ওপর গভীর রেখাপাত করে। দেশভাগের প্রাক্কালে উত্থিত সাম্প্রদায়িক মনোভাব অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যায় ।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct