পঞ্চাশের দশকের কথাকার মহাশ্বেতা দেবী আমৃত্যু সাহিত্যকর্মে এবং সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সাহিত্যকর্ম এবং সমাজকর্মের মধ্যে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সমাজকর্মকেই। কিন্তু তার মধ্যেও রচনা করে গেছেন একের পর এক উপন্যাস ও গল্প। ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস “ঝাঁসীর রানী” প্রকাশিত হয়। চর্চা করেছেন ড: অমরেন্দ্র মহাপাত্র...
তার সৃজনী শিল্পের একটা প্রায়োগিক দিক রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তা উদ্দেশ্যমুখীন। তবে সাহিত্যরস বিবর্জিত নয়। সাহিত্য-গুণ কখনো ক্ষুন্ন হয়নি। একদিকে সাহিত্য শিল্প, অন্যদিকে সমাজ-সংস্কৃতির প্রেক্ষিতে তার সৃজনী শিল্পের একটা প্রায়োগিক দিকের প্রকাশ-মহাশ্বেতা দেবীর সাহিত্যে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। সেদিক থেকে বিচার করলে বাংলা সমাজ ও সাহিত্যের বাড়তি পাওনা মহাশ্বেতা দেবী এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি অদ্বিতীয় সমাজসেবী সাহিত্যিক। সেজন্য বাংলা সাহিত্য সৃজনে ও সমাজ সেবায় বলতে পারি - তার রচিত গল্পগুলিতে তিনি উচ্চ ক্ষমতাশীল শক্তির বিরুদ্ধে, নিঃস্বজনের হয়ে কলম ধরেছেন, অন্ত্যজ প্রতিবাদী চরিত্র সৃজন করেছেন। দেশীয় সামন্ততান্ত্রিক তথা প্রভুত্বশালী সমাজ ব্যবস্থার শোষণের প্রতিকায়িত রূপ হিসাবে ঐতিহাসিক দলিল। সাহিত্যচর্চার সমান্তরালে তিনি রচনা করেছেন জনবৃত্ত অন্বেষণের বিকল্প ইতিহাস। এহেন একজন উচ্চমার্গের সাহিত্যিক তথা সমাজ দরদি মানুষকে আমরা ২৮শে জুলাই, ২০১৬ সালে হারিয়েছি।
পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতির দফতর রাজনোয়াগড় পুরুলিয়া শহর থেকে বত্রিশ কিলোমিটার দুরে মানবাজার যাওয়ার পথে পড়ে। এক সাক্ষাৎকারে মহাশ্বেতা দেবী বলেছিলেন- রাজনোয়াগড়ই আমাদের বাড়ি, আমার Last Bus Stop। বছর বছর উনি শবর মেলা সংগঠনের কাজ করেছেন, চাল ডাল সংগ্রহ করেছেন। আগেও তুষার তালুকদার (প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার), অরুণপ্রসাদ মুখাজী (প্রাক্তন ডি জি) প্রভৃতিকে বলে শবর মেলার জন্য চাল ডাল ইত্যাদি জোগাড় করে দিয়েছেন। ওর মাধ্যমে বহু লোকের সঙ্গে খেড়িয়া-শরব সমিতির যোগাযোগ হয়েছে, সেইসব ব্যক্তি সমিতির শুভানুধ্যায়ী হয়েছেন। তারা পুরুলিয়ায় এসেছেন। ফলে শবরদের উপকার হয়েছে। এত ভালো ভালো মানুষ এই সংগঠনে আসার ফলে শবরদের উপর পুলিশের সন্দেহ কিছুটা কমেছে। Crminal Tribe বলে শবরদের উপর আগে যে অত্যাচার হত, এখন সেই অত্যাচার অনেক কমেছে। একটা ঘটনার কথা বলি - গত ১৪ জুলাই ২০১১ পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার সুনীলকুমার চৌধুরী ৭৮০ জন (২৬২ পরিবার) শবরকে, প্রত্যেককে ৬কেজি চাল, ৬ কেজি আলু আর ধুতি-শাড়ি-লুঙ্গি দিয়েছিলেন। আগে পুলিশ শবরদের দেখলে চোর বলে হাজতে ঢুকিয়ে দিত। এখন চিত্রটা পাল্টে গেছে। পশ্চিমঙ্গ সরকার শবরদের (১২০০ জনকে ৮৩১ একর জমি) পাট্টা দিয়েছিল। কিন্তু সেইসব জমি শবরদের কোনো কাজে আসেনি। কারণ সরকার সব জমির Possession দেয়নি অথবা শবরদের দেখিয়ে দেয়নি। এছাড়া অধিকাংশ জমিই কৃষির অনুপযুক্ত ডুংরি জমি। এক টুকরো জমি এখানে তো আর এক টুকরো জমি আধ কিলোমিটার দুরে। জমিটা এক জায়গায় নয়। কমপক্ষে দশ বিঘা জমি না থাকলে সারাবছর চাষ করে সেই জমি থেকে একজন চাষি লাভবান হতে পারবে না। আগেই বলেছি শবররা অরণ্যের সন্তান। এরা কৃষিকাজে অভ্যন্ত ছিল না। ব্যবসা করার মানসিকতাও শবরদের মধ্যে নেই। সমিতি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করার ফলে এখন শবরদের মধ্যে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বেড়েছে। শবরদের প্রায় সব শিশুরাই এখন স্কুলে পড়তে যায়। তবে কাজ এখনও অনেক বাকি। শবরদের মধ্যে অনেকে গ্যাজুয়েট হয়েছে। শবরদের মধ্যে চাকুরিজীবিও আছেন। পশুপতি শবর বলে একজন Land Reforms ডিপার্টমেন্টে চাকরি করত, এখন মারা গেছে। দুজন Forest ডিপার্টমেন্টে চাকরি করত, তারাও মারা গেছে। পূর্বে পাচজন শবর ছেলে চাকরির সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু তাদের শারীরিক মাপ-জোক কম হয় তখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন জ্যোতি বসু। মহাশ্বেতা দেবী জ্যোতি বসুকে লিখেছিলেন যাতে মাপ-জোকের ব্যাপারটা Condon করে ওই পাচজনকে চাকরি দেওয়া হয়। এই Condon-টা মুখ্যমন্ত্রী করতে পারেন। তারপর কয়েকটি অনুষ্ঠানে জ্যোতি বসুর সঙ্গে মহাশ্বেতা দেবীর দেখা হয়েছে। তখনও মহাশ্বেতা দেবী জ্যোতি বসুকে সেই চিঠিটার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তারপর তো তিনি মুখ্যমন্ত্রী থেকে চলে গেলেন, কাজটা আর হয়নি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct