পঞ্চাশের দশকের কথাকার মহাশ্বেতা দেবী আমৃত্যু সাহিত্যকর্মে এবং সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সাহিত্যকর্ম এবং সমাজকর্মের মধ্যে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সমাজকর্মকেই। কিন্তু তার মধ্যেও রচনা করে গেছেন একের পর এক উপন্যাস ও গল্প। ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস “ঝাঁসীর রানী” প্রকাশিত হয়। চর্চা করেছেন ড: অমরেন্দ্র মহাপাত্র...
১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও উপন্যাসিক। তিনি “যুবনাশ্ব” ছদ্মনামে লিখতেন। মনীশ ঘটকের ভাই ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক খত্বিক ঘটক। মহাশ্বেতা দেবীর মা ধরিত্রী দেবীও ছিলেন লেখক ও সমাজকর্মী। তার ভাইয়েরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ছিলেন। যেমন, শঙ্খ চৌধুরী ছিলেন বিশিষ্ট ভাস্কর এবং শচীন চৌধুরী ছিলেন দি ইকোনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি অফ ইন্ডিয়া পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয়-শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। এরপর তিনি শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে তিনি স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার কর্মজীবনের সূচনা হয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে। তারপর বিজয়গড় জ্যোতিষ রায় কলেজে ইংরেজির অধ্যাপিকা হিসাবে যোগ দেন ১৯৬৪ সালে এবং যুগান্তর পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন তিনি। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে রং মশাল পত্রিকায় তিনি প্রথম লিখলেন। ব্যক্তিগত জীবনের ওঠাপড়ার মধ্যেই অনলস সাহিত্যচর্চায় খামতি আসেনি কখনও। দেড় শতাব্দী আগে বিরসা মুন্ডার ভাতের গন্ধমাখা স্বপ্নটা বাংলা সাহিত্যে ধরা পড়ল ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবীর অরণ্যের অধিকার-এ। ছোটনাগপুরের পাহাড়, জঙ্গল ঘিরে রূপকথার জগৎ বাংলা সাহিত্যে ঘুরে ফিরে আসছে। এসেছে পুরুলিয়ায় না খেতে পাওয়া মানুষদের কথা। জঙ্গলে পড়ে লেখনীর মাধ্যমে, কখনও মিটিং মিছিলের মাধ্যমে। “অরণ্যের অধিকার” এ বাঙালি পাঠককে জোর করে ঝাকুনি দিয়ে দেখিয়েছিল যে জঙ্গলমহল নিয়ে আমাদের ঠুনকো আবেগের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ওই এলাকার রিক্ত মানুষগুলোর কত চোখের জল, কত রক্তঘাম। হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের জুন মাসে মহাশ্বেতা দেবীর আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ঝাড়খন্ড সরকার বিশিষ্ট আদিবাসী নেতা বিরসা মুন্ডার একটি মূর্তিকে শৃঙ্খলামুক্ত করে। তৎকালীন বিটিশ সরকারের শাসনকালে গৃহীত শৃঙ্খলিত বিরসা মুন্ডার একটি আলোকচিত্রের ভিত্তিতে মূর্তিটি নির্মিত হয়েছিল। উল্লেখ্য, বিরসা মুন্ডার জীবনকাহিনি অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে মহাশ্বেতা দেবী “অরণ্যের অধিকার” উপন্যাসটি রচনা করেছিলেন। মহাশ্বেতার সাহিত্যিক জীবন অবশ্য শুরু হয়েছিল আরো অনেক বছর আগে। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে দেশ পত্রিকায় “পদ্মিনী” ও “যশোবন্তী” গল্প দুটি লেখেন মহাশ্বেতা দেবী। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় মহাশ্বেতা দেবী গিয়েছিলেন মধ্যপ্রদেশে। ১৯৫৬ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস “ঝাসির রানি” এই মধ্যপ্রদেশের লোককথা ও ইতিহাসের মিশেলে তৈরি। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় “নটী”। মধ্য-ষাট ও ষাট দশকের গোড়ায় অবিভক্ত বিহারে পালামৌ, হাজারিবাগ, সিংভূমের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে সেখানকার বেগার শ্রমিক প্রথা এবং জনজাতিদের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে লেখেন “অপারেশন বসাই টুডু’’, “অরণ্যের অধিকার” এবং “চোট্টি মুন্ডা ও তার তীর”। ১৯৭৪ সালে নকশাল আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা “হাজার চুরাশির মা” বাংলা সাহিত্যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। পরবর্তীতে ইংরাজি মাধ্যম স্কুলের বিভিন্ন বাংলা পাঠ্য পুস্তকও সম্পাদনা করেন মহাশ্বেতা দেবী। ১৯৭৯ সালে বাবা মনীশ ঘটকের মৃত্যুর পর তার প্রতিষ্ঠিত পত্রিকা “বর্তিকা”র দায়িত্বনেন। ১৯৮৩ সালে পুরুলিয়ার অবহেলিত জনজাতিদের উন্নতির জন্য গড়ে তোলেন পশ্চিমবঙ্গ খেড়িয়া শবর কল্যাণ সমিতি। তিনি তার বহু পুরস্কারের অর্থ দান করেন এই সমিতিকে। তাকে মা হিসেবে মেনে নিয়েছিল শবররাও। পশ্চিম মেদিনীপুরের বিনপুর ব্লকে লোধা শবর, বাঁকুড়া জেলার রানিবাধ, রাইপুর এবং পুরুলিয়ার তেরোটি ব্লকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাসকারী খেড়িয়া শবরদের সমাজের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করেছেন তিনি। এদের উন্নয়নে মহাশ্বেতা দেবীর কর্মসূচি ছিল শিশু শিক্ষা, বয়স্ক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, শবরদের মদ্যপানের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, তাদের হস্তশিল্পে প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বনির্ভর করা এবং ব্রিটিশ যুগ থেকে শবরদের গায়ে লেগে থাকা “অপরাধপ্রবণ জনজাতি”র তকমা থেকে তাদের মুক্ত করা। এজন্য আইনি লড়াইতেও পিছপা হননি তিনি। ২০০৩ সালে এই শবরমাতা ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভূষিত হন। পুরস্কার মূল্যের দশ লক্ষ টাকা পুরোটাই তিনি দিয়েছেন এদের উন্নয়নার্থে। গ্রামে কোন সমস্যা হলেই তিনি সেইসব গ্রামে সমস্যা সমাধানের জন্য ছুটে গেছেন। পঞ্চাশের দশকের কথাকার মহাশ্বেতা দেবী আমৃত্যু সাহিত্যকর্মে এবং সমাজসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন। সাহিত্যকর্ম এবং সমাজকর্মের মধ্যে বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন সমাজকর্মকেই। কিন্তু তার মধ্যেও রচনা করে গেছেন একের পর এক উপন্যাস ও গল্প। ১৯৫৬ সালে প্রথম উপন্যাস “ঝাঁসীর রানী” প্রকাশিত হয়। প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ থেকেই মহাশ্বেতা দেবী পেশাদারি উপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীও যে এ ব্যাপারে ওয়াকিবহল ছিলেন, তা উপন্যাসিকের একটি দীর্ঘ উদ্ধৃতির মাধ্যমে স্পষ্ট করা যেতে পারে:
‘আমার লেখা নিয়ে লক্ষ্য করেছি, বেশ একটা ধারণা আছে সত্তরের পরবর্তীকালের পাঠক সমাজে। “হাজার চুরাশির মা” থেকেই নাকি আমার লেখক জীবনে হঠাৎ এক উত্তরণ। সবিনয় নিবেদন, এই লেখক জানে যে সে “হঠাৎ? শব্দে বিশ্বাস করে না। এবং লেখক হিসেবে তার পথ চলার ইতিহাসটা অন্যরকম। এখানে একটা চিন্তার (অন্যদের) প্রেমিসও পরিষ্কার করা দরকার। আমি কোন অর্থেই কোন দল বা গোষ্ঠীর লেখক ছিলাম না। রাজনীতিক দল তো নয়ই। আমার প্রথম বই “ঝাঁসীর রানী” (১৯৫৬) থেকেই আমি পেশাদারী লেখক। যারা পেশাদারী লেখক, আমি তাদেরই একজন, তা জায়গা যেখানেই হোক না কেন। এটাও সত্য যে আমার চেয়ে তরুণতরোরা অনেক বেশি খ্যাত ছিলেন। আমি সত্তর দশক ও অন্যান্য আন্দোলন নিয়ে লিখতে চেষ্টা করেছিলাম, মনে করিনি অদ্ভুদ কিছু করেছি। পেশাদারী লেখক হয়েই ইতিহাসের একটা অধ্যায়, আদিবাসী ক্ষেত্রে যে অধ্যায়, অন্ধকারেই অবহেলিত, তা যে লেখা যায়, সেটাই হয়তো প্রমাণ করি। এই লেখক যদি সে সময়ে প্রবক্তা হয়, তাও সে পেশাদারী লেখকের অবস্থান থেকেই। বাণিজ্যিক কাগজে লেখালেখি করেই সে লেখক হয়েছে।” “হাজার চুরাশির মা এবং “অরণ্যের অধিকার” উপন্যাস দুটির জন্যই মহাশ্বেতা দেবী সর্বাধিক পরিচিত। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের বাইরে অন্যান্য ভারতীয় রাজ্যে, এমনকি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তিনি এ দুটি উপন্যাসের জন্যই হয়তো সর্বাধিক খ্যাতিও পেয়েছেন। কিন্তু উপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীর যাত্রা শুরু তো হয়েছিল এর অনেক আগে থেকেই। সত্তরের দশকের আগের উপন্যাসগুলির বিষয় বৈচিত্র্য দেখেই তো বিস্মিত হয়েছিলেন সমালোচক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।
ইতিহাসের প্রতি বিশেষ করে বিদ্রোহের বা সংগ্রামের ইতিহাসে মহাশ্বেতা দেবীর আগ্রহ ছিল চিরকালীন। সে কথা বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বীকারও করেছেন তিনি। পাঠক হিসাবে আমরা তার রচনার মধ্যে সে পরিচয়ও পেয়েছি বারবার। প্রথম গ্রন্থ “ঝাসির রানি” মুলত জীবনী গ্রন্থ হলেও যে গণবৃত্তের ইতিহাসে তিনি বিশ্বাস করেন সেই গণবৃত্তের ইতিহাসকে তুলে ধরাই তার উদ্দেশ্য। ইতিহাসের সঙ্গে আখ্যান মিলে গেল পরবর্তী রচনা “নট” উপন্যাসে এবং এরও বেশ কিছুদিন পরে লেখা “অমৃত সঞ্চয়” উপন্যাসে। ১৯৫৭ সালের “সিপাহী বিদ্রোহ” যাকে “ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম” বলে অভিহিত করা হয় তার প্রতি ওপন্যাসিকের আগ্রহই রচনা দুটির মূল প্রেরণা। রাজা-রাজড়ার পাশাপাশি সেই বিদ্োহে সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ ইতিহাসের আড়ালে থেকে গেছে। কিন্তু ইতিহাসনিষ্ঠ ওঁপন্যাসিক তাকে উপন্যাসের পাতার তুলে আনেন অত্যন্ত বিশ্বস্ত ভাবে। রাজনর্তকী মোতির মধ্যেও যে স্বাদেশিকতাবোধের জাগরণ ঘটে, সাধারণ গ্রাম্য নরনারী চন্দন-চম্পা এবং তাদের পরিবারগুলিও যে সেই বিদ্রোহের একটি প্রধান অংশ হয়ে যায় এবং তাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে সিপাহী বিদ্রোহের মতো ঘটনা - এসব অত্যন্ত তথ্যনিষ্ঠ বা বাস্তব সম্মত রূপে উঠে আসে উপন্যাসের পাতায়। দীর্ঘদিন শান্তিনিকেতনে থাকার ফলে শিল্পের প্রতি বিশেষ করে গান এবং নাচের প্রতি ওপন্যাসিকের একটি স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। প্রথম দিকের উপন্যাস “যমুনা কী তীর এবং “মধুরে-মধুর” উপন্যাসে তার পরিচয় মেলে। উপন্যাস দুটিতে শিল্পের সাধনাই বড় হয়ে উঠেছে। সঙ্গীত শিল্পী আনন্দ এবং নৃত্যশিল্পী সাধন-শিল্পের মধ্যেই খুঁজে পায় জীবনের সার্থকতা। প্রথম উপন্যাস “নটা’তেও শিল্পের প্রসঙ্গ এসেছে। প্রাথমিক পর্বের উপন্যাসে শিল্পের প্রসঙ্গ এসেছে বিভিন্ন ভাবে। “বায়োক্কোপের বাক্স” উপন্যাসে যেখানে উচ্চবিত্ত পরিবারের নি:সঙ্গ একজন নারীর কথা বলা হয়েছে সেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার ওপন্যাসিকের শিল্পের প্রতি আকর্ষণের একটি বহিংপ্রকাশ। “নটা” উপন্যাসে গজল আর ভজন এবং “মধুরে-মধুর’-এ বৈষ্ণবপদাবলীর সংযোজন উপন্যাসিকের শিল্পানুরাগেরই পরিচয় দেয়। “প্রেমতারা” উপন্যাসে শিল্প জীবনচেতনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। কারণ সার্কাসের কুশীলবরাও যে একপ্রকার শিল্পী তা মহাশ্বেতা দেবীর আগে কোনও সাহিত্যিক বলেছেন বলে তা আমার জানা নেই। যে শিল্প প্রতিনিয়ত চর্চা করে আয়ত্ত করতে হয় সে শিল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকে আরাধনার প্রসঙ্গটি। কিন্তু সার্কাসের শিল্পীদের শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হয় জীবন-মৃত্যুর ভয়। এ বিষয়টিই ভাবিত করেছিল ওপন্যাসিক মহাশ্বেতা দেবীকে। যে শিল্পের মাধ্যমে তারা দর্শকের মনোরজ্ঞন করে সে শিল্পই অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct