বর্তমান ভারতে সবচেয়ে জটিল সমস্যা হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতাবাদের ব্যাপক উত্থান। বস্তুত রাষ্ট্রিক আর সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িক আচরণ লালিত-পালিত এবং উৎসাহিত হচ্ছে রাষ্ট্রীয় শাসকগোষ্ঠীর দ্বারাই। ভয়ের কারণ, ফ্যাসিবাদের পোষক সরকার সাম্প্রদায়িকতাবাদের বীভৎস প্রকাশ সাম্প্রদায়িক একতরফা দাঙ্গার মারফত দেশস্থ বিশেষধর্মী মানুষজনের জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। তা নিয়ে এই সন্দর্ভ পত্রটি লিখেছেন ইতিহাসবেত্তা খাজিম আহমেদ।
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী একদা বলেছিলেন, ‘আমার কাছে হিন্দু-মুসলমান ঐক্য একান্তভাবে কাম্য, কারণ অন্য বিষয় ছেড়ে দিলেও স্বরাজ লাভের জন্য একটি প্রয়োজনীয়। ’ (‘কমিউনাল ইউনিটি’- পৃষ্ঠা-২২৯-২৩০)। গান্ধীজী এই তরল সিদ্ধান্তে ছিলেন যে ইংরেজ সরকার চলে না গেলে ভারতে হিন্দু মুসলমান ঐক্য স্থাপিত হবে না। ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে প্রায় সাত দশক, কিন্তু দুই সম্প্রদায়ের ঐক্য তো হয়-ই নি, উপরন্তু সন্দেহ ও অবিশ্বাস ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ব্যক্তি জীবনে জওহরলাল নেহরু ও সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ছিলেন এবং ধর্মনিরপেক্ষতা আদর্শকে ভারতের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু জাতীয় জীবনে এই বোধের কোন প্রকাশ লক্ষ্যযোগ্য হয়ে ওঠেনি। আধুনিক ভারতের রাজনীতিতে জীবনযাপনের সাম্প্রদায়িকতাবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ, আঞ্চলিকতাবাদ আর সংহতি বিনষ্টকারী প্রবণতা চিন্তাশীল ব্যক্তিদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর একটি লেখায় মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘কোন বহুজাতিক রাষ্ট্র একটি সম্প্রদায় বা গোষ্ঠী যদি কোন কারণে বেশি প্রাধান্য পেয়ে যায় তাহলে দুর্বলতর সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীগুলি নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন ও স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে। ’ ইতিহাসবেত্তা টয়েনবি’র উপলব্ধি হল, ‘‘অপেক্ষাকৃত সবল জাতিসত্তা দুর্বল অংশের ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে হলে একদিন অপেক্ষাকৃত দুর্বল জাতিসত্তা ক্ষোভে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। বস্তুত একটা সময়ে দুর্বলের মর্যাদাবোধ জাগ্রত হয় এবং সে সবলের সমকক্ষ হতে চায়। ’’ভারত বহু ধর্মবিশ্বাসের দেশ। এই রাষ্ট্রের সমস্ত মানুষ নিজেদের এক জাতি বলে ভাবেন না, বিশ্বাসও করেন না। এটাই বাস্তব। বিষয়টি ভালো কি মন্দ, সে অন্য কথা। বহুকাল যাবৎ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরোধ ছাড়াও সাম্প্রতিককালের উচ্চবর্ণ ও অন্ত্যজ নিম্নশ্রেণির হিন্দুদের মধ্যেও জাতপাতের লড়াই তীব্র হয়েছে। সনাতনপন্থী ব্রাহ্মণ্যবাদীরা আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় হরবখত তৎপর। তাদের ‘মহাকাব্য’-গুলো এই তত্ত্বের ওপরেই নির্মিত। এমন মানবতাবিরোধী ‘বদ আদর্শের’ যশোগানে তারা মুখর। এহো বাহ্য। বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দিন উমর লিখেছেন, ভারতীয় রাজনীতি ক্ষেত্রে শ্রেণিস্বার্থ, সাম্প্রদায়িক স্বার্থ এবং আঞ্চলিক স্বার্থের দ্বন্দ্ব একমাত্র সমাধান সম্ভব ছিল--- একটি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে। কিন্তু ভারতের শ্রমিক ও কৃষকের অনেক শ্রেণিসংগ্রাম সত্ত্বেও সেই সংগ্রামকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি। সোজাসুজি বলতে কি এমন আধা-ঔপনিবেশিক আধা সামন্তবাদী রাষ্ট্র আর সমাজব্যবস্থায় তা সম্ভব ছিল না। সাম্প্রদায়িকতাবাদ আজকের শাসকবর্গের মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। খোদ রাষ্ট্রযন্ত্র খুল্লামখুল্লা সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের প্রশ্রয় দিচ্ছে। ফলত নাগরিকবর্গের এক বিরাট অংশ নির্মম জাতিদাঙ্গায় জড়িয়ে পড়ছে। অন্য জাতিবিধ্বংসী মন আর জাত্যাভিমান তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠছে।
সাম্প্রদায়িকতা আর বিচ্ছিন্নতাবাদ যেমন মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে তেমনি মানুষ ক্রমশ নৈতিক মূল্যবোধও হারিয়ে ফেলছে। রাজনীতির জগতে ক্রিয়াশীল এক বিশেষ দুষ্টচক্র সাম্প্রদায়িক বিরোধ সৃষ্টি করছে। হাল আমলে যে বিপদ বিপদস্বরূপ ধারণ করেছে তা হল ‘সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়িকতা’। উদাহরণ পেশ করছি: - একদা জ্যোতি বসুর সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন বিশিষ্ট সাহিত্যিক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, তাতে জ্যোতি বসু সংস্কৃতি সম্পর্কে মতামত দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে জনৈক গৌরহরি সামন্ত জবাব দিলেন, ‘আমাদের হলো একটাই সংস্কৃতি আর সেটা হলো ভারতীয় সংস্কৃতি বা হিন্দু সংস্কৃতি। ’ এই অর্বাচীন ভদ্রলোক ‘ভারত’ আর ‘হিন্দু’ শব্দদ্বয়কে সমার্থক করে ফেললেন। ফলত হিন্দু ধর্মবিশ্বাসী ব্যতিরেকে অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে একটি অনিরাপত্তা জন্ম দিল। কিন্তু এ কথা তো মনে রাখতেই হবে যে ভারত বহু ধরনের ধর্ম বিশ্বাসী মানুষের দেশ। বহু বিশিষ্ট মানুষও আকছার অপরিণামদর্শী মতামত ব্যক্ত করে থাকেন, যেমন বিশাল জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার। প্রখ্যাত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্মৃতির দর্পণে নামক একটি রচনা লেখেন, ওঁর (রমেশচন্দ্র মজুমদার) ধারণা, ভারত পুরোপুরি যেদিন হিন্দুরাষ্ট্র হবে, সেদিন মুসলমান মুক্ত ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে প্রতিবেশীর সম্প্রীতি নিয়ে সুখে বাস করতে পারবে। এই ধরনের বোধ যত চর্চিত হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সেই পরিমাণেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। জাতীয় সংহতিও বিপন্ন হবে। নানান ঐতিহাসিক কারণে পাক-ভারত উপমহাদেশে এতাবৎকাল হিন্দু-মুসলমানের দ্বন্দ্বকেই সাম্প্রদায়িকতা নামে চিহ্নিত করা হতো। আজ বিষয়টি সেই পর্যায়ে দাঁড়িয়ে নেই। এখন এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ‘শিখ সমাজ’। প্রয়াত খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন, উত্তর ভারতের নানা এলাকায় ‘ত্রিশূল বাহিনী’ গড়া হয়েছে। শিখ বিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তোলাই তাদের উদ্দেশ্য। শিখ সাম্প্রদায়িকতা ঠেকাতে পাঞ্জাবের শহরাঞ্চলে কতকগুলি ভূঁইফোড় অর্বাচীন হিন্দু সাম্প্রদায়িক সংগঠনের নেতৃত্বে সঙ্ঘবদ্ধ হচ্ছে হিন্দুরা। স্বভাবতই উভয়পক্ষই যুযুধান হয়ে উঠছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ৮২.৭২ শতাংশ হিন্দু (সমস্ত শ্রেণি মিলিয়ে), ১২.১১ শতাংশ মুসলমান, ২.৬ শতাংশ খ্রিস্টান, ১.৯০ শতাংশ শিখ ইত্যাদি ধর্মাবলম্বী। দেশটিকে শাসনতন্ত্রে ধর্ম-নিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। এখন শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের সুবাদেই কেউ যদি ভারত দেশকে ‘ভারতমাতা’য় রূপান্তরিত করতে চায়, তাহলে সংহতি বিপন্ন হবেই। শিখ সমাজ তো যুথবদ্ধ জীবনের জন্য ‘‘শিখ হোমল্যান্ড’ বা ‘খালিস্তান’ চেয়ে বসে আছে। কাশ্মীর সমস্যা তো এই উপমহাদেশের সর্বাপেক্ষা তর্ক প্ররোচক সমস্যা। যে পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষ ‘ভারত’ হয়ে গেছিল, জাতি হিসাবে ভারতবাসীর তা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ভারতে মুসলমান সমাজ দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিসত্তা। উপেক্ষার রাজনীতি-সমাজনীতি এবং তথাকথিত সুপার কালচারের চর্চার ফলাফল কি ‘ঘর পোড়া গরু, সিঁদুরে মেঘ দেখেও আঁচ করতে পারছেন না?’ধর্মান্ধতা ও সেক্যুলারিজম একসঙ্গে চলতে পারে না। স্বাধীনোত্তর ভারতের বিশেষ একশ্রেণির মানুষ যাঁরা নিজেদের ‘জাতীয়তাবাদের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে প্রচারিত করেছেন, তাঁদের বিশ্বাস হল, হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থান এই মন্ত্রই দেশের অখন্ডতাকে টিকিয়ে রাখতে পারে। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে রূপদর্শী (১) যেমন লিখেছিলেন, ‘‘হিন্দুকে উগ্র হিন্দু এবং মুসলমানকে উগ্র মুসলমানে পরিণত করার চেষ্টা করলে ভারতের মতো সেক্যুলার দেশে আর যাই হোক একাত্মতা রচনা করা যায় না। ’’ ‘‘...ভারতে হিন্দুরাজ স্থাপন করা সম্ভব হবে না। সেটা করতে গোটা দেশকে সর্বনাশের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে। ভারতের বর্তমান একমাত্র আরএসএস এর স্বপ্নেই হিন্দু রাজ্য নামক ধারণাটি কে কে আছে। ’’ রবীন্দ্র মানসজাত বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য--- এই মহৎ আইডিয়াটিকে এরা নস্যাৎ করতে চান। জাতীয় জীবনে হিমালয় প্রমাণ ট্র্যাজেডি ঘটেছিল ১৯৪৭-এর আগস্টে তার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলেই জাতির সামনে সম্ভাব্য বিপদের স্বরূপ উদ্ঘাটিত হতে পারে। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেন, ‘হিন্দু রিভাইভালিজম’, ‘মুসলিম রিভাইভালিজম’-কে জাগায়; ধ্বনি যেমন প্রতিধ্বনিকে’। হাল আমলের সাম্প্রদায়িকতাবাদ আর বিচ্ছিন্নতাবাদ ভারতীয় ইতিহাসের ট্র্যাজেডিকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এই প্রসঙ্গে রূপদর্শীর একটি সময়োচিত সাবধান বাণী উচ্চারণ করে আলোচনা শেষ করা যাচ্ছে, ‘‘... একেবারে স্রোতে গা এলিয়ে দেবেন না। কোথাকার স্রোত কোথায় কাকে টেনে নিয়ে যায় কিছুই বলা যায় না। ’’অধিক স্মর্তব্য, মানুষ মানুষকে অনেক সময় ক্ষমা করে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। গলতির সাজা মিলবেই।
১. রূপদর্শী প্রয়াত গৌরকিশোর ঘোষ, মানবতন্ত্রী সাহিত্যিক।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct