সে যে আজও নিশীথের বাদল, স্বপ্নের মাদল
সনাতন পাল
২৫ শে বৈশাখ মানেই আকুল প্রাণে ব্যাকুল হয়ে তাঁকে খুঁজে বেড়ানোর দিন। কিন্তু কোথায় গেলে পাবো সেই মণিহার? অচিন পাখি খাঁচা ছেড়ে সেই কবে চলে গেছে তবুও তাঁর ভুত আজও আমাদের তাড়া করে বেড়ায়। রাজা নেই ,কিন্তু তাঁর রাজ্যপাটে অমৃতের ভান্ডার সাজিয়ে রেখে গেছেন আমাদেরই জন্য। সে সবের মাঝেই তাঁকে খুঁজে মরি অহর্নিশি। কিন্তু আজও সে রয়েছে আমাদের সকলের মননে, চিন্তায় চেতনায়-এ কথা তো মিথ্যে নয়। বিরহের সুরেও তিনি আবার প্রেমের মধু-মালতির মিলনেও সেই তিনিই। শৈশবে যিনি আবার কৈশোর, যৌবন সবকিছু কে পেরিয়ে বার্ধক্যের দোড় গোড়াতেও সেই তিনিই।বসন্তে যখন রাঙামাটির দেশে লাল টুকটুকে পলাশ ফোটে, চারিদিক থেকে যখন ধেয়ে আসে কোকিলের মধুর কন্ঠ, তারই মাঝে কারো হৃদয়ে যখন প্রেমে পাবার সাফল্যে বেজে ওঠে মিলনের নিক্কন। আবার একই সাথে কারো হৃদয়ে বিরহ, অশ্রু হয়ে নয়ন দুখানি বেয়ে শ্রাবণের ধারার মত ঝরে পড়ে। তখনই হয়তো বেজে ওঠে -” ....ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান. ..তোমার অশোকে কিংশুকে -অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে..”। এখানেও পরম তৃপ্তি উপভোগে যেমন তাঁরই সৃষ্টি, আবার যখন যাবার তাড়া থাকবে তখন বেজে ওঠে তাঁর সেই সুর, “ যেদিন রইবে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে ... “। আবার যখন ভালোবাসাকে ধরতে পারি না, প্রকাশ করতে পারি না তখনই মনে পড়ে -” সখী ভালোবাসা কারে কয়.....আমার মতো সুখী কে আছে, আয় সখী আয় আমার কাছে....”। মনের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থায় কখনও আনন্দে কখনও বিরহে এমনি ভাবেই চুপি-সারে আজও সে আসে মোদের হৃদ মাঝারে। নয়নের বারিধারাতেও তিনি আবার মুক্ত ঝরা হাসিতেও তিনি। বৈশাখের প্রখর রোদ্দুরে ফুটে ওঠা কৃষ্ণচূড়াতে এবং গাছের আগায় নেতিয়ে পড়া লাল শিমূলে যেমন সে, তেমনি শরৎ এর শিউলির গন্ধেও সে। ঘাসের ডগায় শরৎ- তে সে, ঝরা বকুলের গন্ধেও সে। আশ্বিনের শেষে নীল আকাশের মাঝে ভেলার মত উড়ে যাওয়া পেঁজা তুলো-তে আদি অনন্তকাল ধরে সে উঁকি মেরে আসছে। অপর দিকে শ্রাবণের মেঘের গুরগুর শব্দের মাঝেও সে, আবার বর্ষাকালের নিশীথের বৃষ্টির ফোঁটার শব্দ টিনের চালে যখন শুনি তখনও ভাবনায় আসে সে। বাংলার ভরা খেতের মাঝেও মোরা তাঁকেই দেখি আর শুনি-”.. ও মা অঘ্রানে তোর ভরা খেতে কি দেখেছি মধুর হাসি..”। আমের বনে তাঁরই উপস্থিতি পাই যখন ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুলের ঘ্রাণে মোরা পাগল হই। জীবন যুদ্ধেও মোরা তাঁকেই দেখি,যখন বেজে ওঠে-” ...যদি তো ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে..”। “দাদার কীর্তি” তে তাঁকেই অনুভব করি যখন শুনি, “ চরণ ধরিতে দিও গো আমারে-নিও না ,নিও না ,সরায়ে.....”।
জন্ম হতে মৃত্যু, গ্রীষ্ম হতে বর্ষা, শরৎ হতে বসন্ত, বৈশাখ হতে শ্রাবণ, হাসি থেকে কান্না, শিক্ষা থেকে কর্ম কোথায় তিনি নেই? সবখানেই যে রয়েছেন তিনি। মোদের জীবনের অমাবস্যার প্রদীপ তিনি। ’বেলা শেষে’ও তিনি। ‘সোনার তরী’তে যেমন তিনি আবার বিশ্বময় ভাবনার জগতে ‘গীতাঞ্জলি’ তেও তিনি। আমরা আজও তাঁর সৃষ্ট রবীন্দ্রসংগীত শুনি আর জীবনের না বোঝা অর্থ কে বোঝার চেষ্টা করি। জীবনের ছন্দ বোধকে অনুভব করি কিন্তু অনেক সময় সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না তখনও মনে পড়ে সেই রবীন্দ্রনাথ কেই। তাঁর লেখা পড়ে জীবনের ভার বোধ কে যেমন অনুভব করি তেমনি চাওয়ার এবং পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য কেও বুঝি। আর এই দুটোর তফাৎ থেকে সৃষ্ট জীবন যন্ত্রণাকে তাঁরই ভাষাতে বুঝি। কারণ জীবনের বহু ক্ষণে আমরা বলার ভাষা খুঁজে পাই না, বোঝার চেতনা থাকে না। তখন তাঁরই ভাবনার আলোকে আলোকিত হয়ে আমরা চেতনায় শান দিই। কখনও যেমন তাঁরই গানের সুরে ভুলে যাওয়া দুঃখময় অতীতকে স্মরণ করি আবার তাঁরই গানে প্রেমের সুখে মুধুর রস আস্বাদন করি। সবেতেই যদি তিনি তাহলে তাঁকে বিনে মোরা থাকি কি রূপে? কিন্তু উপায় নেই ,এ যে থাকতে হবে বলেই থাকা। একথা বহুবার বহুজনের মনে হয়েছে -” ইসসস যদি একটা বার তাকে স্পর্শ করার সুযোগ পেতাম ! তাহলে জীবন টা ধন্য হয়ে যেত”। কিন্তু তার আর কোনো উপায় নেই কারণ ২২ শে শ্রাবণ আছে। শুধু বাংলা নয়,সারা বিশ্বের মানুষের ভাবনায়,চিন্তা চেতনায় রবির কিরণ আলোকিত করছে জীবন বোধকে। তাই সেদিনও যেমন তিনি ছিলেন আমাদের হৃদয়ে,আজও আছেন- ভবিষ্যতেও থাকবেন।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct