আঠারো মিনিটের কালবৈশাখী ঝড়
দিলীপ মজুমদার
ঈশানের পুঞ্জমেঘ অন্ধবেগে ধেয়ে চলে আসে বাধাবন্ধহারা। মধ্যদিনের রক্তনয়ন অন্ধ করে আসে কালবৈশাখী। লণ্ডভণ্ড করে দেয় সাজানো বাগান। মনে হয় বুঝি পৃথিবীর শেষ দিন সমাগত। কিন্তু এত যে ভীষণ তবু তারে হেরি ধরার ধরে না হর্ষ। কেননা ওরই মাঝে আছে কালপুরুষের সুগভীর পরামর্শ।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণকে তুলনা করতে ইচ্ছা করে কালবৈশাখীর সঙ্গে। মানুষের হৃদয়কে দলিত মথিত উদ্বুদ্ধ উজ্জীবিত করে তুলেছিল সেই ভাষণ। সেই ভাষণের সূত্র ধরে এসেছিল পরমাকাঙ্খিত স্বাধীনতা ১৯৭০ সালে আওয়ামি লিগ জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় নি। তারই প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে মুজিবর রহমানের ভাষণে। ঢাকা রমনার রেসকোর্স ময়দানে বেলা ২.৪৫ থেকে ৩.০৩ পর্ষন্ত অর্থাৎ মোট আঠারো মিনিটের ভাষণ। এই মৌখিক ভাষণে উচ্চারিত হয়েছিল মোট ১১০৮ টি শব্দ; অর্থাৎ প্রতি মিনিটে নির্গত হয়েছিল ৪৮-৫০টি শব্দ।
বক্তা পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকদের ভূমিকা পর্যালোচনা করেন ; সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানান, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সার্বিক হরতাল পালনের উপর জোর দেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, “ ভায়েরা আমার, আজ দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন ও বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহি, রংপুরে আমার ভায়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় আমরা করেছিলাম ? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামি লিগকে ভোট দ্যান, আমরা ভোট পাই। আমরা দেশের একটা শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব, আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব। এ দেশের মানুষ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস ; বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বৎসরের নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। ”মুজিবরের এই ভাষণে ভাষার ফুলঝুরি ছিল না, উপমা-রূপকের জৌলুস ছিল না, কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল অন্তরের উপলব্ধির অকপট, আটপৌরে প্রকাশ। ভাষণের শেষে তিনি মানুষকে ডাক দিয়ে বলেন, “ এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এ বারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। ” এই ‘জয় বাংলা’ সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ঋণধ্বনিতে পরিণত হয়। মুজিবরের এই ভাষণ ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়। ইউনেস্কো এই ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল বলে স্বীকৃতি দেয়। দিন বদলের পালা তৈরি করতে সাহায্য করেছে পৃথিবীর যে সব ভাষণ, শেখ মুজিবর রহমানের ভাষণ তার একটি এবং বোধহয় সবচেয়ে স্বল্প দৈর্ঘ্যের। এই ভাষণের ভাষা আলঙ্কারিক না হলেও এর মধ্যে আছে সহজ কবিত্ব। তাই ‘নিউজউইক’ পত্রিকা মুজিবরকে ‘রাজনৈতিক কবি’ আখ্যা দিয়েছেন।
[লেখক সিনিয়র ফেলোশিপপ্রাপ্ত গবেষক]
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct