আরব থেকে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি কিভাবে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করেছে, সে ইতিহাস সত্যিই চমকপ্রদ। সিসিলি ও স্পেন ছিল এসব বিস্তৃতির প্রধান উৎসস্থল। সিসিলির ছিলেন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত দুজন শাসক। তাঁরা হলেন দ্বিতীয় রজার ও দ্বিতীয় ফ্রেডরিক। এ ছাড়া ছিলেন হোহেনস্টফেন, বিশেষত শেষোক্তজন আলপস পর্বতমালা অতিক্রম করে আরবের মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বহন করে নিয়ে আসে ইউরোপে এবং লোথারিঞ্জিয়া। লিখেছেন সাখাওয়াত উল্লাহ।
আরব থেকে মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি কিভাবে ইউরোপে বিস্তৃতি লাভ করেছে, সে ইতিহাস সত্যিই চমকপ্রদ। সিসিলি ও স্পেন ছিল এসব বিস্তৃতির প্রধান উৎসস্থল। সিসিলির ছিলেন খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত দুজন শাসক। তাঁরা হলেন দ্বিতীয় রজার ও দ্বিতীয় ফ্রেডরিক। এ ছাড়া ছিলেন হোহেনস্টফেন, বিশেষত শেষোক্তজন আলপস পর্বতমালা অতিক্রম করে আরবের মুসলিম শিক্ষা ও সংস্কৃতি বহন করে নিয়ে আসে ইউরোপে এবং লোথারিঞ্জিয়া [(Lotharingia (Lorraine), লাইজি (Liege), জর্জি (Gorge) এবং কোলন (Cologne)]। এই স্থানগুলো ক্রমে আরব থেকে আনীত মুসলিমদের জ্ঞানের লালন কেন্দ্ররূপে পরিচিতি লাভ করে। স্পেন থেকে এই জ্ঞান পিরিনিস ডিঙিয়ে ক্রমে ক্রমে পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম ফ্রান্সে ছড়িয়ে পড়ে। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মুসলমানরা যখন একপর্যায়ে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও কর্মকাণ্ডে স্থিত হয়ে যায়, খ্রিস্টীয় ইউরোপ তখন চিকিৎসাবিজ্ঞান, গণিতশাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র প্রভৃতি ক্ষেত্রে ক্রমেই অগ্রসরমাণ। বিশেষ করে কর্ডোভা, টলেডো, সেভিল ও গ্রানাডার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা দেশে ফেরত আসার পর বর্ণিত বিষয় ও ক্ষেত্রগুলো শনৈঃ শনৈঃ অগ্রগতি লাভ করতে থাকে। বিস্ময়করভাবে মুসলিমদের জ্ঞান তখন পরিশ্রমী অনুবাদকদের দ্বারা অনূদিত হয়ে ইউরোপে স্থানান্তরিত হতে থাকে। এসব অনুবাদকের মধ্যে বিশ্বব্যাপী খ্যাতিমান হয়ে আছেন জেরার্ড অব ক্রেমোনা, অ্যাডেলার্ড অব বাথ, রবার্ট অব চেস্টার, মাইকেল স্পট, স্টিফেন অব সারাগোসা, ইউলিয়াম অব লিউনিস, ফিলিপ অব ত্রিপোলি। অনুবাদের মাধ্যমে লাতিন জনগণের মধ্যে ওই অনুবাদকরা মুসলিম আরবদের জ্ঞান সহজলভ্য করে তোলে। কিছু বই হিব্রু ভাষায়ও অনূদিত হয়। অন্যদিকে কিছুসংখ্যক হিব্রু ও লাতিন গ্রন্থ ইউরোপের নিজস্ব ভাষায়ও অনূদিত হয়। ইউরোপের স্যালার্নোতে চিকিৎসাবিজ্ঞান অধ্যয়ন শুরু হয়।
আফ্রিকার অধিবাসী কনস্টানটাইন চিকিৎসাবিজ্ঞান শেখার জন্য সৌভাগ্যক্রমে সেখানকার মেডিক্যাল কলেজে একজন আরবকে পেয়েছিলেন শিক্ষক হিসেবে। মন্টপেলিয়ার ও প্যারিস খুব শিগগির এই ধারা অনুসরণ করে নতুন নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করে। তখনকার দিনে আরবি ভাষাই ছিল গোটা বিশ্বের বিদ্যাশিক্ষার অন্যতম মাধ্যম। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলগুলোতে আরবি ভাষায়ই পড়ানো শুরু হয়। বিশেষত, টলেডো, নারবোনে, নেপলস, বোলোনা, প্যারিস প্রভৃতি শহরে আরবি ভাষাকে মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করে পড়াশোনার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল স্থাপন করে। নির্ভরযোগ্য লেখক ও গবেষকদের মতে, মুসলিম স্পেন থেকে ফ্রান্স ও তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলো এবং মুসলিম অধ্যুষিত সিসিলি থেকে ইতালিতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির চাষাবাদ বিস্মৃতি লাভ করে। স্পেনের মুসলিম শাসকরা সে সময়ে যে সেচপদ্ধতির প্রবর্তন করেন এবং যে কৃষি-বনায়নপদ্ধতি প্রয়োগ করেন, তা দেশকে শাকসবজি ও কৃষিজাত ফসলে স্বনির্ভর করে তোলে। পাশাপাশি সবুজাভ স্পেনে রূপান্তরিত করে। মুসলিমদের এসব গৌরবময় অতীতের ঘটনাবহুল ইতিহাস ও ঐতিহ্যময় কর্মকাণ্ডের কিছু ঘটনা লিপিবদ্ধ হয়েছে আবু জাকারিয়া ইবনে মুহাম্মাদ আল-আওয়াম ইশবিলি বিরচিত গ্রন্থ ‘কিতাবুল ফালাহাত’-এর মধ্যে। তাঁর গ্রন্থে ন্যূনপক্ষে ৫৮৫টি প্রজাতির উদ্ভিদ নিয়ে আলোচনা সন্নিবিষ্ট হয়েছে। প্রতিটি লেখায় উদ্ভিদগুলো রোপণ ও নার্সিং করার সুস্পষ্ট নিয়মাবলি সুগ্রন্থিত।জ্ঞানের এমন কোনো শাখা নেই, যেখানে মুসলিমদের পারদর্শিতা ছিল না। দার্শনিক আল-কিন্দি, আল-ফারাবি, ইবনে সিনা ও ইবনে রুশদ সমসাময়িককালের ‘জ্ঞানভাণ্ডার’ নামে পরিচিত হতেন। আল-কিন্দি চক্ষুরোগ, রসায়ন, চিকিৎসা ও দর্শনে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী ছিলেন। তিনি শতাধিক পুস্তক প্রণয়ন করেন। ইবনে সিনা মাত্র ১৮ বছর বয়সে চিকিৎসাশাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যে দুটি বিশ্বকোষ ইবনে সিনা রচনা করেছিলেন, সেসব দ্বাদশ থেকে সপ্তদশ শতক পর্যন্ত চিকিৎসাজগতে পথপ্রদর্শক গ্রন্থ বলে বিবেচিত হতো। পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত তাঁর বইগুলো ১৬ বার পুনর্মুদ্রিত হয়। রসায়ন, গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব ইত্যাদি সব বিষয়ই মুসলিম গবেষক ও বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট দখল ছিল। আল-খাওয়ারিজমি, মুসা বিন সাকির, আলবিরুনি, ওমর খৈয়াম, ফেরদৌসি, আল-মাসুদি, আত-তাবারি, ইবনে খালদুন—এমন আরো শত শত বিজ্ঞানী ও জ্ঞানতাপস যুগে যুগে জ্ঞানচর্চা করে বিশ্বকে যে আলোকবর্তিকা হাতে দিয়ে গেছেন, তা আজও তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার কাছে অমূল্য অবদান হিসেবে স্বীকৃত। মুসলমানদের বিজ্ঞানচর্চা হয়েছিল ৫০০ বছর। আর এই সময়ই ছিল ইউরোপের ইতিহাসের অন্ধকারতম যুগ। (ইষৎ পরিবর্তিত)
তথ্যঋণ : সেমিনার প্রবন্ধ সংকলন, বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টার
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct