সুভাষ আজও ঘরে ফেরেনি
সনাতন পাল
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরেও তিনি আজও দেশে ফেরেননি। সবাই ভেবেছিলাম নেতাজি একদিন নেতার বেশেই দেশে ফিরবেন। কমিশনের পর কমিশন বসেছে, ফাইলের পর ফাইল চাপা পড়েছে। কিন্তু তাঁর অন্তর্ধান আজও আমাদের কাছে একটা রহস্যই থেকে গেছে। রাজ্য পাঠ আছে, সিংহাসন আছে, কিন্তু উপযুক্ত রাজা নেই। কতবার কত রটনা রটেছে, কতবার কত জনকে নিয়ে কত গুজব রটেছে! তার আর ঠিক নেই। কিন্তু তাঁর আজও ঘরে ফেরা হয়নি। আজও ২৩ শে জানুয়ারি এলে সবার মুখে একটাই কথা একবার যদি তাঁকে দেখে নিজেকে ধন্য করতে পারতাম! কতজন আজও চোখের জল ফেলেন। তাঁর কথা ভাবতে ভাবতে দেশের কোটি কোটি মানুষ শিশু-কৈশোর-যৌবন পেরিয়ে বার্ধক্যে পরিণত হয়েছেন। আবার অনেকে হয়তো আজ আর আমাদের মধ্যে জীবিত নেই, কালের নিয়মেই চলে যেতে হয়েছে। কিন্তু তাঁর দেখা মেলেনি। আজ শুধু মানুষটা নেই , কিন্তু বিভিন্ন সময়ে- কৃষক আন্দোলন থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রমিক থেকে কৃষক সকলের ক্ষেত্রেই তাঁর কথায় প্রাসঙ্গিকতার সন্ধান পাওয়া যায়। ঘটনা প্রবাহকে মিলিয়ে দেখলে মনে হয় সত্যিই তাঁর পর্যবেক্ষণ কি সাংঘাতিক ভাবে নিখুঁত! তাঁর সমস্ত কথা মেনে নিতে আমাদের মন কোনো আপত্তি করে না। কিন্তু আমারা যে স্বার্থের বেড়াজালে আবদ্ধ, সেই জাল কেটে বেরিয়ে আসতে পারি না, মোহের মায়া আমাদের ঘিরে রেখেছে। তবুও নেতাজির কথা আজও দেশের কোটি কোটি মানুষকে দারুন ভাবে ভাবায়। তিনি দেশে থাকলে এবং তাঁর জীবিত থাকা কালীন, যদি তিনি চাইতেন- তাহলে অন্য কারো হয়তো আর প্রধান মন্ত্রী হওয়াই হতো না। একজন দেশনায়কের প্রতি দেশের মানুষের ঠিক কতটা শ্রদ্ধা-ভালোবাসা থাকলে, যুগ যুগ ধরে তাঁর জন্য দেশের মানুষের চোখ জলে ছলছল করে ওঠে, সেটা নেতাজির জন্ম না হলে আমাদের হয়তো ধারণার মধ্যেই আসত না।
নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বলেছিলেন যে-”রাজনৈতিক দরকষাকষির একটা গোপন দিক হলো যে, এটা দেখতে খুব শক্তিশালী মনে হয় কিন্তু তোমার বর্তমান অবস্থাকে ব্যাখ্যা করে না। ” ব্রিটিশ ভারতের এমন অবস্থা ছিল যে, জনগণের সঠিক পরিস্থিতি কোনো ভাবেই সামনে আসতে দেওয়া হতো না বলেই সুভাষ বসু মনে করতেন। আজকে যাঁরা নেতাজীর ঐতিহ্যকে আত্মসাৎ করে দলীয় রাজনীতি করতে মরিয়া, তারাও স্বাধীনতার ৭৫ বছর অতিক্রম করার পরেও দেশের এমন পরিস্থিতি করেছেন যে, সাধারণ মানুষের প্রকৃত অবস্থা সামনে আসার কোনো উপায় নেই। ধর্ষণ, দুর্নীতি, শোষণ, নিপীড়ন, বঞ্চনা, থেকে আরম্ভ করে দমনপীড়ন নিয়ে গোটা দেশ যখন উত্তাল , তখন শাসক এহেন পরিস্থিতিতেও ধর্ষকের শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা বা খুনের ঘটনাকে চাপা দিতেই বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ বলেন সাজানো ঘটনা, ছোটো ঘটনা। আবার কেউ বলার চেষ্টা করেন -দলিতদের ভোগ করার অধিকার উচ্চ বর্ণের ব্যক্তিদের রয়েছে। কৃষক অনাহারে, ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করলে তাকে অন্য ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। কেউ আবার বলেন সরকারকে বদনাম করতে বিরোধীরা চক্রান্ত করেই কৃষকদের উসকিয়ে দিল্লিতে কৃষক আন্দোলন করিয়েছে। কিন্তু বাস্তবটা ভিন্ন। আসল সত্য তো এটাই যে বর্তমানে এদেশে যে ধরণের শিক্ষা পদ্ধতি চালু করা হয়েছে, তা দিয়ে কখনই বাস্তব পরিস্থিতিকে বিশ্লেষণ করে প্রকৃত সত্য উদঘাটন করা এবং সঠিক অবস্থান গ্রহণ করা ভীষণ কঠিন। দেশের মানুষের কঠিন সময়েও লড়াইয়ের জন্য ঘুমন্ত বিবেক জাগ্রত হয় না। কিছু ঘটনার পরিপেক্ষিতে কিছু আন্দোলনের ক্ষেত্রে নড়াচড়া দেখে মনে হয়েছে যে, তাগিদটা যেন ভেতর থেকে আসছে না, কেউ বোধহয় বাইরে থেকে জোর করে গেলানোর চেষ্টা করছে। একথা আমরা সকলেই জানি যে - কোনো কিছুকে জোর করে গেলানোর চেষ্টা করলে তা গলায় আটকে যায় এবং বিষম লাগার সম্ভাবনা থেকেই যায়। মূলত সেই কারণেই হয়তো এদেশে বহু আন্দোলন দানা বাঁধেনি। যার গ্লানি হয়তো যুগের পর যুগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বয়ে নিয়ে বেড়াতে হবে। আমাদের এখনও ঘুম ভাঙেনি। কিন্ত নেতাজি কখনই এমনটা চাননি। তিনি সব সময়ই চাইতেন শোষিত বঞ্চিত মানুষকে সংগঠিত করতে হলে সবার প্রথমেই যেটা দরকার সেটা হলো- যিনি নিজে শোষিত হচ্ছেন, বঞ্চিত হচ্ছেন সেটা বোঝা। তারপরে কেন শোষিত হচ্ছেন, কার দ্বারা শোষিত হচ্ছেন এটা জানা এবং বোঝা দরকার। এই জানা এবং বোঝার উপরেই আন্দোলনের গতিবিধি যেমন নির্ভর করে, তেমনি অংশ গ্রহণের তাগিদটাও ভেতর থেকে অনুভব করে। আর এসবের উপরেই আন্দোলনের সাফল্য নির্ভর করে।
বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গ সহ ভারতে এই চেতনার মানের ঘাটতি ভালো মতোই রয়েছে। এই ঘাটতিটাই শাসকের মূলধন। এতো কিছু প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও ভারতে ঘটে যাওয়া কৃষক আন্দোলনে বোধহয় সারা দেশের প্রায় ২৩ কোটি মানুষ যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু লড়াইটা শুধু ২৩ কোটি মানুষের ছিল না- ১৩৭ কোটি মানুষের। আর ওঁনাদের দোষ দিয়েই বা কি হবে! বর্তমান সময়ের সস্তা রাজনীতিই হয়তো সুভাষের সেই ঔদার্ত্ত কথা তাঁদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। তাই জন্য মনে হয়েছিল বাংলার কৃষকরা হয়তো শীত ঘুমে রয়েছিলেন। নেতাজী ব্রিটিশ ভারতে দেশবাসীর মনে চেতনা জাগ্রত করতে বলেছিলেন-” একটা আদর্শকে খাড়া করতে একজন মরে যেতে পারে, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর সেই আদর্শ নিজে থেকেই হাজার হাজার মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনাকে জাগিয়ে তোলে”, একথা সুভাষ তাঁর নিজস্ব সুবাসে বিলিয়ে গেছেন এবং নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু একবার কি আমরা একথা ভেবে দেখেছি , যে শুধু মাত্র ব্যক্তি স্বার্থে দল বদলের রাজনীতি নেতাজীর আদর্শকে কথাটা কষাঘাত করে? সবাই যদি ভেবে থাকি তাহলে ঐ দল বদলু নেতাদের এবং যাঁরা এই নিন্মমানের রাজনীতিকে আমদানি করছেন এবং প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের লম্বা চওড়া ভাষণ শুনে চাবি দেওয়া পুতুলের মত হাততালি দিচ্ছেন, তাঁরা কারা ? সুভাষ বসু দৃঢ়তার সাথেই বলেছিলেন যে-” একটা আকাঙ্খাকে আজই আমাদের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর সেটা হল আত্মবলিদানের, যা ভারতকে বাঁচিয়ে রাখবে। ” কিন্তু বাজার অর্থনীতি প্রতিনিয়ত মানুষকে শিক্ষা দিচ্ছে যে -’নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। বর্তমান ভারতে যাঁরা এর পৃষ্ঠোপোষক তারা যদি সুভাষ কে নিয়ে লম্বা চওড়া ভাষণ দেন, তাহলে সেটাই বা আমরা শুনবো কেন? যারা সমাজের যুব সমাজকে দলীয় রাজনীতির স্বার্থে তোলাবাজির বা অপরাধমূলক কাজের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন, নতুন করে রাজনীতিতে আমদানি করা হচ্ছে ‘ঘোড়া কেনাবেচা’ ‘কাটমানি’র মত শব্দ- যা বাংলা অভিধানে নবতম সংযোজন। তাঁদের মুখে আজকের দিনে শুনতে হচ্ছে নেতাজী বন্দনার কথা ! যারা মারিয়ে যাচ্ছেন সুভাষের সেই কথাকে -” ভুলে যেও না গুরুতর অপরাধ অবিচার ও অন্যায়ের সঙ্গেই সমঝোতা করতে শেখায়। তবে স্মরণ করো অন্তরাত্মাকে। যদি কিছু পেতে হয়, তাহলে তোমাকে দিতে হবে। ” আমাদের কে একবার অবশ্যই ভাবা উচিৎ যে আমরা কি দিচ্ছি, আর কি পাচ্ছি ? এটা ভুলে গেলেও চলবে না যে, নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা বিপরীত এবং সমান প্রতিক্রিয়া আছে। সুভাষ বসু বলেছিলেন সেই জাতীয়তাবাদের কথা-” দৃঢ় প্রতিজ্ঞ জাতীয়তা বোধ , সঠিক বিচার ও ন্যায়ের আদর্শেই ইন্ডিয়ান আর্মি অফ লিবারেশন কে তৈরী করতে হবে। ” যা ভারতের জাতীয় সংহতিকে মজবুত করবে, দেশে ঐক্য কে সুদৃঢ় করবে। কিন্তু আগাগোড়ায় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল অখন্ড ভারত। তিনি কখনই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে পছন্দ করতেন না। সুভাষের জাতীয়তাবাদী ভাবনায় রবীন্দ্রনাথের প্রচ্ছন্ন মদত ছিল। রবি ঠাকুরের মতে -” যে জাতীয়তাবাদ জাতির স্বাধীনতার কথা বলে, যে জাতীয়তাবাদ নিজেকে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলে, যে জাতীয়তাবাদ অন্য জাতিকেও সমান মর্যাদা প্রদান করার কথা বলে, তা কখনই সংকীর্ণ নয়। ” আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের সময় সুভাষ বসু, রবীন্দ্রনাথের বলে দেওয়া জাতীয়তাবাদ-কেই আধার করেছিলেন। কিন্তু আজকের দিনে যে শাসক উগ্র জাতীয়তাবাদ কে আশ্রয় করে জাতিকেই ধ্বংস করতে চাইছে এবং জাতির মূল সমস্যাগুলোকেই আড়াল করে দেশের সম্পদ বেচে দিচ্ছেন, তাঁরাই বা নেতাজী কে কি রূপে সম্মান জানাবেন? বর্তমান ভারতে সুভাষ বোসকে নিয়ে যে সস্তা রাজনীতি চলছে, সেটা লজ্জার! নাকি গর্বের? সে বিচারের ভার মানুষের উপরেই রইল। কারণ শেষ কথা মানুষই বলেন। ইতিহাসের কোনো পরিবর্তনই এই সত্যকে আজও পরিবর্তন করতে পারেনি।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct