নায়ীমুল হক,আপনজন : "ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ" .....কবি কাজী নজরুল ইসলামের কথার রেশ ধরে একমাস রোজার শেষে সত্যিই খুশির আবহে মঙ্গলবার ঈদের দিন রাতে অনলাইনে মিলিত হলেন সমাজের বিশিষ্ট গুণীজনেরা, সঙ্গে ছিল ছাত্র ছাত্রীরাও। তবে কেবলমাত্র মুসলিম-সমাজেরই নয়, ঈদের এই মজলিসে উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিদ্বজ্জনেরাও। যুদ্ধ-বিগ্রহে যখন নাজেহাল বিশ্ব-পরিস্থিতি, কঠিন প্রশ্নচিহ্নের মুখে যখন সামাজিক-বন্ধন, ঠিক সেই সময়ে ঈদ উপলক্ষে অনলাইনে এই পারিবারিক মজলিস ছিল প্রকৃতই এক আলোকবর্তিকা। উপস্থিত সকলেই একবাক্যে স্বীকার করলেন এ কথা, এমনকী সহমত পোষণ করলেন অনলাইন বিভ্রাটের কারণে উপস্থিত না হতে পারা অনেক গুণীজনেরাও। ঘরোয়া পরিবেশে উৎসবের আমেজ নিয়ে এদিনের অনুষ্ঠান মূলত ছিল তিনটি অংশে বিভক্ত - হালকা চালে সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে গুণীজনদের মূল্যবান কথা, তেহরান থেকে উপস্থিত হওয়া বিশিষ্ট ছাত্রী ও লেখিকা নায়েলা মাহমুদ উপমার প্রত্যয়ের কথা, আর ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গন।
পবিত্র ঈদের এ দিনটি ছিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিন-ও। আলোচনার সূত্রপাত করে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত ভাইস-চ্যান্সেলর ড.বাসব চৌধুরী বলেন মনুষ্যত্বের ধর্মই হলো প্রকৃত ধার্মিকতা। ধর্ম কখনো ভেদাভেদ ঘটাতে আসেনি। সেই পরম ধর্ম অর্থাৎ প্রকৃত মানবিকতার উন্মেষ ও তার যথার্থ পরিচর্যা আজ বড় প্রয়োজন। এ বিষয়ে আমাদের সবিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ ধরনের ছোট ছোট মিলন অনুষ্ঠান সেই দূরত্ব ঘুঁচিয়ে আমাদের প্রকৃত ভাতৃত্বের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে তিনি তাঁর দৃঢ় মত প্রকাশ করেন। এদিন এই অনুষ্ঠানে একদম প্রথম থেকে সাগ্রহে অংশ নিয়েছিলেন ত্রিপুরা থেকে বিশিষ্ট রসায়নের শিক্ষক অধ্যাপক অর্জুন দে। তিনিও বাসব চৌধুরীর বক্তব্যের সমর্থন করে মত ব্যক্ত করেন। তিনিও বলেন ধর্মের এই বিভাজন রেখা মুছে ফেলতে আমাদের আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন। ভারতের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য আমাদের সে পথই দেখায়। তিনি বারবার করে স্মরণ করিয়ে দেন, গোটা বিশ্বে ভারতের গরিমা এখানেই। ঈদ উপলক্ষে এই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন বিশিষ্ট চিকিৎসক মইনুদ্দিন চিশতী, বিশিষ্ট রসায়নের শিক্ষক ও দমদম শহীদ রামেশ্বর বিদ্যামন্দির এর প্রধান শিক্ষক শাশ্বত কর, শিক্ষক আনোয়ার হোসেন প্রমূখ। রোজার মাসের আকর্ষণীয় খাবার হালিমের উৎপত্তির ইতিহাস ও তার রসালো রেসিপি নিয়ে বলেন বিশিষ্ট শিক্ষিকা ও গবেষিকা রত্না সেনগুপ্ত।'তিনি আজও ভাস্বর : বীর সেনানী টিপু সুলতান' শীর্ষক এক সংক্ষিপ্ত অথচ মনমুগ্ধকর জীবন-কথা তুলে ধরেন বিশিষ্ট গবেষক ও মাতৃভাষা পত্রিকার সম্পাদক সজল রায় চৌধুরী। এদিনের মুখ্য আকর্ষণ ছিল ইরানের তেহরান প্রদেশ থেকে অংশ নেওয়া ক্লাস ইলেভেনের ছাত্রী ও লেখিকা নায়েলা মাহমুদ উপমা। সে যখন ক্লাস এইটে পড়ে, তখন ক্লাসের একটি অ্যাসাইনমেন্ট থেকে লিখে ফেলে একটি বই। যা পরবর্তীকালে স্কুলের পক্ষ থেকে প্রকাশিত হয়। বইটির নাম - LESS DOUBT MORE EFFORT, এত অল্প বয়সে এই বই লেখার অনুপ্রেরণা সে কোথায় পেয়েছিল, এই বই লেখার পর তার অনুভূতিই বা কেমন হয়েছিল? সমস্ত প্রশ্নের জবাবে সে বলে তার পিতার কথা এবং অবশ্যই তার মায়ের ভূমিকার কথা, আর তার অনুপ্রেরণা ছিল স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। সে জানায় জীবনের পদে পদে ঘাত প্রতিঘাত আসাটাই স্বাভাবিক। সেখানে থমকে দাড়ালে চলে না বরং সাহস নিয়ে নিষ্ঠার সঙ্গে এগিয়ে চললে সাফল্য কিন্তু আসবেই। এভাবেই ইলেভেনের ছাত্রী নায়েলা তার প্রত্যয়ের কথা ব্যক্ত করে।
ঈদের আবহে এদিন সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কর্মকাণ্ড ছিল যথেষ্ট মজবুত। রাজহাটি বন্দর হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও বিশিষ্ট লেখক নভেন্দু সামন্ত- এর দরাজ কন্ঠে দু'খানি রবীন্দ্র সংগীত এবং অরিত্রি সাহুর নজরুল গীতি অনুষ্ঠানে এক অন্য মাত্রা বয়ে আনে। ঠিক একইভাবে অসম রাজ্যের তিনসুকিয়া থেকে সাহিত্যের বিশিষ্ট অধ্যাপিকা দিপশ্রী দাস সরকার শেয়ার করে নেন তাঁর অনুভূতির কথা স্বরচিত দুখানি কবিতার মধ্যে দিয়ে।
তবে এদিন সব কিছুকে ছাপিয়ে যায় একদম অনুষ্ঠানের সূচনা লগ্নে দুই কিশোর-কিশোরীর পবিত্র কোরআন থেকে পাঠ। ক্লাস এইট-এর ছাত্র তামিম তার সুললিত কন্ঠে কোরআনের সূরা রুম পাঠ করে এবং তার অনুবাদ শোনায় ক্লাস টেন-এর ছাত্রী তাহসিনা। এদিন নাফিসা ইসমাতের অনুষ্ঠান সঞ্চালনা ছিল অনবদ্য। ঈদ উপলক্ষে পারিবারিক এই সম্মিলনীর কথা বহুদিন সকলে মনে রাখবে।
All Rights Reserved © Copyright 2024 | Design & Developed by Webguys Direct